রাজধানীর যানজট নিরসনে কিছু পথ

মোহাম্মদ জমির
 | প্রকাশিত : ০৪ মার্চ ২০১৮, ১০:৫৩

গত কয়েক মাসে রাজধানী ঢাকার যানজট বেড়েছে বলে মনে হয়। ঢাকার আশপাশের সব মহাসড়কই মাঝেমধ্যে অচল হয়ে পড়ছে। যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। এই পরিস্থিতিতে নাগরিক জীবন স্থবির হয়ে থাকছে। যানজটের কারণে ঠিক অফিস-আদালতে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের দোকানের বদলে সময় নষ্ট হচ্ছে রাস্তায়। শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে যেতে পারছে না সঠিক সময়ে। এমনকি যানজটের কারণে জরুরি চিকিৎসার জন্য রোগীদের দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শুধু সড়কের এই পরিস্থিতি পুরো একটি নগরকে বলা যায় অচল করে দিচ্ছে।

এই তো কদিন আগে, আমার ধানমন্ডির বাসা থেকে বারিধারা যেতে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। বাসায় ফিরতেও সেই ঘণ্টা দুয়েক সময় লেগেছে। অথচ এই পথটুকুর দূরত্ব মাত্র ৯ মাইল। পান্থপথ-সোনারগাঁও হোটেল এলাকা পার হয়ে এই পথ যেতে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ মিনিট লাগার কথা। অথচ সময় লেগেছে দ্বিগুণের বেশি। এভাবেই ঢাকা শহরে সময়ের অপচয় হচ্ছে। যানজট এড়াতে এবং সময় বাঁচাতে অনেকেই আজকাল গাড়ি বা অন্য কোনো যানবাহন ছেড়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে যেতে চান। শিক্ষার্থীরা এই চেষ্টা বেশি করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঢাকা শহরে যথাযথ হাঁটার সুবিধা নেই। পথচারীদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কোথাও ফুটপাত ভাঙা, কোথাও মলমূত্র। কোথাও ফুটপাত দখল করে আছে হকারের দল।

ঢাকা শহরে যানজট হওয়ার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত, তারাও নিজ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে না বলে আমি মনে করি। ক্রসিংগুলোতে সড়কবাতি আছে, কিন্তু সেগুলো অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রিত হয় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের হাতের ইশারায়। তাই জনগণ প্রশ্ন করতেই পারে, সড়কবাতি যদি ব্যবহার না করা হয়, তবে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে এগুলো বসানোর প্রয়োজন কী? তারপরও আমরা দেখি সড়কবাতি সংস্কার হয়। আবার কখনো বসানো হয় সময় নির্ধারণী যন্ত্র। অথচ সেই ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতি তথা হাতের ইশারায় চৌরাস্তার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার দৃশ্য আমাদের দেখতে হচ্ছে।

আমাদের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যানজট নিরসনের আরো কিছু বিষয়ে কাজ করতে পারেন। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় স্ট্যান্ড বানিয়ে রেখেছে বাসচালকরা। যেমন ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, বিজয় সরণি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সোনারগাঁও হোটেলের সামনে প্রায়ই দেখি যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানোর কাজটি করা হয়। এতে একদিকে পেছনের যানবাহন সব থেমে যায়। আবার যাত্রীদেরও দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়তে হয়। এই যেখানে-সেখানে যানবাহন থামানো, পার্কিং করাÑ এগুলো যদি দায়িত্বরত ট্রাফিককর্মীরা বন্ধ করতে পারেন, তবে ঢাকার যানজট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। আরো একটি বিষয় ঢাকার যানবাহনের গতি থামায় তা হচ্ছে পথচারীদের রাস্তা পারাপারে যথেচ্ছাচার। এ বিষয়ে ঢাকায় কোনো শৃঙ্খলাই নেই। পথচারীদের জন্য ফুটওভারব্রিজ থাকলেও তারা সেটা ব্যবহার করতে চায় না। দৌড় দিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে চায় তারা। এতে যানবাহনের গতি শ্লথ করতে হয়, কিংবা থামিয়ে দিতে হয়। অথচ পথচারীরা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করলে এই অবস্থা হয় না। আবার ঢাকায় বেশিরভাগ ফুটওভারব্রিজ এমন স্থানে করা হয়েছে, যেখানে পথচারীর সংখ্যা কম। উল্টোদিকে যেখানে দরকার সেখানে ফুটওভারব্রিজ করা হয়নি। আবার রাস্তা পারাপারে জেব্রাক্রসিং ব্যবস্থা দিন দিন যেন উঠে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় সাদা দাগ উঠে গেছে। কোথায়ও কিছুটা দেখা যায়। আবার চালকরাও জেব্রাক্রসিং মানতে চান না। তাই পথচারীদের পার হতে গিয়ে পড়তে হয় ঝুঁকির মধ্যে। এক্ষেত্রে চালক-পথচারী উভয়কেই ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তৎপর হতে হবে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগকে। তাদের উদ্যোগে মাঝেমধ্যে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করার জন্য পথচারীদের জরিমানা করতে দেখা যায়। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না।

ঢাকার যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলার অনেক দিক আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সড়কে রকমারি যানবাহন দেখে মনে হয় কোনো লেন সিস্টেম আছে। বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেল প্রভৃতি কে কোন্ দিক দিয়ে, কোন্ লেনে চলবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বাজে অবস্থা দেখি মিরপুর সড়কে। এই সড়কে যানজটের নৈরাজ্য যেন লেগেই থাকে। যার যার ইচ্ছেমতো এলোপাতাড়িভাবে যানবাহন চালায়। এটা যদি উত্তরণ করা যায়, তবে মিরপুর সড়কে যানবাহন কিছুটা কমবে, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি।

ঢাকার সড়কপথে বড় একটি সমস্যা হচ্ছে একই সড়কে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহনের চলাচল। কিছু বড় রাস্তা বন্ধ থাকলেও বেশিরভাগ সড়কেই সাইকেল, রিকশা, রিকশাভ্যান, ঠেলাগাড়ি চলাচল করে। এগুলোর সঙ্গে চলতে গিয়ে যান্ত্রিক যানবাহনের গতি স্বাভাবিক কারণেই ধীর রাখতে হয়। আবার ট্রাফিক নিয়ম না জানায় এবং সচেতনতার অভাবে রিকশা, রিকশাভ্যান ও ঠেলাগাড়ি চালকরা আইন-কানুন মানে না বললেই চলে। তাদের জন্য সড়কে আলাদা লেন করা দরকার। ঢাকার উত্তরায় কিন্তু আমরা বড় সড়কের পাশে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা দেখতে পাই।

অন্যদিকে ঢাকার রাস্তার আরেক সমস্যা মোটরসাইকেল। এর চালকদের প্রায় সবাই শিক্ষিত। কিন্তু তারা আইন ও জীবনের চেয়ে সময়কে বেশি দাম দেয়। তাই কে কার আগে যাবেন, তার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। এতে বড় বড় যানবাহন যে থেমে যাচ্ছে সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। তারা ট্রাফিক সিগন্যাল, রেল সিগন্যাল কিছুই মানতে চায় না। তাদের অনেকেই পথচারীদের ঝুঁকিতে ফেলে ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল এগিয়ে নেয়। মোটরসাইকেল চালকদের নিয়মের মধ্যে আনতে পারলে সড়ক অনেকাংশে ঝুঁকিমুক্ত হবে, কমবে যানজটও। আর এর বিকল্প হিসেবে অযান্ত্রিক সাইকেল জনপ্রিয় করতে হবে। এখন অনেকেই সাইকেল চালাতে আগ্রহী। কিন্তু আলাদা কোনো লেন না থাকায় সবার পক্ষে সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামা সম্ভব হচ্ছে না। সাইকেলের লেনটা করা জরুরি। তা হলে ঢাকার রাস্তায় যানবাহন কিছুটা কমতো। এতে পরিবেশও সুরক্ষিত হবে, কমবে যানজটওÑ তা আমি হলফ করেই বলতে পারি।

রিকশা ও রিকশাভ্যানের মতো অযান্ত্রিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের জন্য আমার একটি ভাবনা আছে। এখানে আমি তা তুলে ধরছি। ট্রাফিক বিভাগকে অবশ্যই অযান্ত্রিক যানবাহনকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য একটি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য কিছু রাস্তায় রিকশা ও রিকশাভ্যান চলাচল বন্ধ থাকবে। যেমন অফিসপাড়াকেন্দ্রিক সড়কগুলো সকাল ৯টা থেকে ৬টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা যেতে পারে। আবার মার্কেট অধ্যুষিত এলাকার রাস্তা রাত ৮টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা যায়। এটা হলে নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত মোড় এলাকার যানজট যে অনেকাংশে কমবে, এর নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি।

ঢাকা মহানগরের রাস্তাঘাটে একটি জটিলতা আমাকে আতঙ্কিতই করে তোলে। তা হচ্ছে দ্বিমুখী সড়কের যানবাহনের অসংখ্য সারি বা লেন। অথচ সর্বোচ্চ তিনটি লেন হলেই যথেষ্ট। কিন্তু রাস্তা পাঁচ-ছয়টি লেন করিয়ে যানবাহনগুলো চলাচল করে। এ কারণে সড়কের পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে বাসগুলো যখন আচমকা মাঝখানে দাঁড় করায়, তখন ট্রাফিক ব্যবস্থা যেন ভেঙে পড়ে। তারা সেই অবস্থায় যাত্রী নামায়, যাত্রী উঠায়। এমনকি যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করতে থাকে বাসের হেলপাররা। এর জন্য যানজট বাড়ে। আর দুর্ঘটনার ঝুঁকিতো আরো বেশি করে তৈরি হয়। এই পরিস্থিতি উত্তরণে ট্রাফিক পুলিশদের সক্রিয় হতে হবে। বিশেষ করে আইন অমান্যকারী বাসচালকদের ধরতে প্রয়োজনে সিসিটিভির ক্যামেরা বসাতে হবে। যাতে করে নিয়ম লঙ্ঘনকারী চালকদের শনাক্ত করা সহজ হয়। এটা হলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে বলে আমি মনে করি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ নিষ্ক্রিয় সে কথা আমরা বলব না। তারা সক্রিয় আছে বলেই জনবহুল এই শহর এখনো যানজটের মধ্যেও এগিয়ে চলছে। তাদের বড় একটি পদক্ষেপ আমরা সম্প্রতি দেখেছি। তা হচ্ছে গিয়ে ভিআইপি নামধারী ব্যক্তিদের উল্টোপথে চলাচলরত গাড়ি ঠেকানো। এই ভিআইপিদের মধ্যে পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা যেমন আছেন, তেমনি আছেন সরকারের অন্যান্য বিভাগের বড় কর্তারাও। আছেন সমাজের বিভিন্ন সুধীজনও। তাই এই কাজ করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। তবু তারা পিছপা হননি। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তারা সঠিক পথে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এই কর্মকা- অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। শহরবাসী পুলিশের উদ্যোগ স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু হালে এসে তা আর অতটা আলোচিত হচ্ছে না। ভিআইপিদের রং-সাইডের গাড়ি কী আবার ছাড় পাচ্ছে? আমরা কিন্তু এর উল্টোটাই দেখতে চাইবো।

ঢাকা একটি মেগাসিটি। জনবহুল শহর। যেখানে দেড় থেকে পৌনে দুই কোটি মানুষ বসবাস করে। উন্নত বিশ্ব তো দূরের কথা, এশিয়াও বাদ রাখলাম, এই দক্ষিণ এশিয়ার হিসেবে ধরলেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ঢাকা সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। অবস্থার উন্নতি করতে সরকার অবশ্য বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের জোরালো পদক্ষেপের মধ্যে আছে উড়ালসেতু নির্মাণ। দুঃখজনক হলেও সত্যি সবক্ষেত্রে তা সুফল দিচ্ছে না। বিশেষ করে উড়ালসেতু থেকে যখন যানবাহন নেমে আসে, তখন তাদের অন্তত ২০ মিনিট বসে থাকতে হয় সামনের ক্রসিং পেরিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে। উড়ালসেতুর এই সমস্যা এড়াতে বেলজিয়াম, ফ্রান্সে ও জার্মানিতে কার্যকর একটি পন্থা বের করা হয়েছে। গাড়ি যখন ফ্লাইওভার থেকে নিচে নেমে আসে, তখন সে যাতে সোজাসুজি বেরিয়ে যেতে পারে, এর জন্য পাতালপথ তৈরি করা হয়েছে। এতে করে ক্রসিংয়ের অন্যান্য পথ আর বাধাপ্রাপ্ত হয় না।

আমেরিকাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি ঢাকার যানবাহনের অবস্থা নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তারা দেখেছেন মোটের ৬-৮ শতাংশ যাত্রী ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি ও অটোরিকশা ব্যবহার করে থাকে। অথচ এই যানবাহন ৬৫ শতাংশ সড়ক দখল করে রাখে। অন্যদিকে ৬০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করলেও গণপরিবহনের দখলে আছে ঢাকার মাত্র ১০ শতাংশ সড়ক। তার মানে ঢাকায় পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে করে গণপরিবহন ব্যবহারে মানুষ উদ্বুব্ধ হয়, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমে যাতে বাসের মতো পরিবহন বৃদ্ধি পায়।

ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার ঢাকায় আরো একটি সমস্যা তৈরি করছে। এটা হচ্ছে পার্কিং সমস্যা। যেই সংখ্যক প্রাইভেট কার চলাচল করে সেই পরিমাণ গাড়ির রাখার জায়গা এই শহরে নেই। তাই লোকজন যেখানে-সেখানে গাড়ি রাখছে। এটা অনেকের কাছেই ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী ও তাদের সন্তানরা এক্ষেত্রে ট্রাফিক সার্জেন্টদেরও মানতে চান না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা যেখানে-সেখানে গাড়ি রাখছেনই। বিশেষ করে সড়কের জায়গায় গাড়ি রাখার কারণে যানবাহন চলাচলের জন্য স্থান কমে যায়। যার কারণে যানজট তৈরি হয়। যেখানে বিপণিবিতান ও অফিস বেশি সেখানে এই প্রবণতা বেশি। কারণ অনেক বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবনে রাজউকের নকশা লঙ্ঘন করে গাড়ি রাখার জায়গা অন্য কাজে ব্যবহার করছে। মতিঝিল ও গুলশানের মতো এলাকায় এই পরিস্থিতি দেখা যায়।

ফুটপাত ও সড়কে পর্যন্ত কোনো কোনো মার্কেট বা অফিসের পেভমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের ঢাকা শহরে। যার কারণে জনগণের চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে হকারদের কারণেও। ঢাকা শহরের গুলিস্তানসহ অনেক এলাকার ফুটপাত ও সড়কে হকাররা দোকান নিয়ে বসে। এই কারণে সড়কের যানবাহন চলাচলে জায়গা কমে যাচ্ছে। এমনকি পথচারীদের পর্যন্ত রাস্তায় নেমে চলতে হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে যানজট।

রাস্তায় সভা-সমাবেশ-মিছিল-মানববন্ধন; এ ধরনের কর্মসূচির কারণেও যানজট তৈরি হয়। যানজটের পেছনে আমি দুর্নীতিকেও দায়ী করব। সড়কে আইন লঙ্ঘন করছে যারা, তারা প্রায়ই কিছু টাকা-পয়সা ব্যয় করেই পার পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধাদাতা কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ, কখনো স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বরা। বিশেষ করে ফুটপাতের হকার বসানোর কাজটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীরা যৌথভাবে। আমরা সম্প্রতি দেখেছি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গুলিস্তান এলাকা থেকে হকার উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু প্রভাবশালী একটি মহলের বিরোধিতার কারণে দক্ষিণের মেয়র তা পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেননি। হকার ঘুরেফিরে ফুটপাত ও রাস্তায় চলে আসছে। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, এটাই আশার কথা।

যানজটের জন্য শহরের পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকেও অনেকাংশে দায়ী করা যায়। বিশেষ করে বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে থাকে। যার কারণে জ্যাম তৈরি হয়। মিরপুর সড়ক, ধানমন্ডি-২৭, শান্তিনগর, মালিবাগে বর্ষায় যা নিয়মিতই দেখা যায়। আবার সেবা সংস্থার যখন-তখন খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও যানজট লেগে থাকে সড়কে। কোথাও কোথাও খোলা ড্রেনের অপরিকল্পিত কাঠামোর কারণেও সড়ক সংকুচিত হয়ে আছে। এগুলো সচল করার জন্য প্রায়ই ময়লা তুলে সড়কের ধারেই রাখা হয়, যা যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। এই চিত্র দেখা যায় বাড্ডার প্রগতি সরণিতে। তবে বৃষ্টিজনিত জলজট কমাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কাজ করছে। এই কাজ শেষে নগরবাসী সুফল পাবে। তবে কাজ চলার সময় উত্তর ও দক্ষিণÑ দুই অংশের নাগরিকদেরই ভোগান্তি মেনে নিতে হচ্ছে। বিশেষত ঢাকা উত্তরের বনানী, গুলশান, বাড্ডায় পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা নিয়ে কাজ হয়েছে, তাতে চলতি বছরের বৃষ্টি মৌসুমে জলাবদ্ধতা অনেকখানি কমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

আমি মনে করি, ঢাকা শহরের যানজট কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। কিছু উড়ালসেতুর মাধ্যমে তা দেখিয়েছে বর্তমান সরকার। এছাড়া তারা মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ করছে। এটা চালু হলে অবশ্যই যানবাহনজনিত সমস্যার উত্তরণ হবে। হাতিরঝিলের চক্রাকার সড়ক এবং জিয়া কলোনি ও কুড়িলের উড়ালসেতু ঢাকার পূর্ব-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করে দিয়েছে। আবার হাতিরঝিলের তীরের বাসের পাশাপাশি পানিতে নৌযান চলছে জনসাধারণের জন্য। যার কারণে যানজট এড়িয়ে চলাচল করা যাচ্ছে। এভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হবে। যেসব পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে ঢাকা অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। তার জন্য শুধু অল্প কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। এই অপেক্ষার শেষে অবশ্যই যানজটমুক্ত একটি শহর পেতে চাইব আমরা।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :