যুগের দাবি ফোরজি, কারো কারো পোয়াবারো
আমরা এখন ফোরজি যুগে বসবাস করছি।
এ নিয়ে ঢাকঢোল কম হয়নি। এটা যে একটা বিশাল বড় সাফল্য, সেটাও ঘটা করে বলা হয়েছে। কর্তা ব্যক্তিরা হাসিমুখে ছবি তুলেছেন। সাধারণ মানুষ সেই সাফল্যের দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে, পত্রিকার পাতায় পড়েছে। কিন্তু অনেকের মতো আমার মনের ধন্দ দূর হয়নি। আমি আসলে বুঝতেই পারছি না, ফোরজি বা ফোর্থ জেনারেশন জিনিসটা আসলে কি? এটা হলে বা না হলে কি এমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো আমাদের জীবন যাপনে?
তবে বিষয়টা যে বড় কিছু, সেটা বুঝতে পারি। কিছুই না হলে কি আর দুনিয়াজুড়ে এ নিয়ে এত হইচই হয়? অথবা গুরুত্ব না থাকলে নিশ্চয়ই মোবাইল অপারেটরগুলো এর পিছনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতো না। দিন কয়েক আগে যে ফোরজি তরঙ্গের নিলাম হলো, তা থেকে সরকার আয় করেছে পাঁচ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা! মাত্র দুটি মোবাইল কোম্পানি, গ্রামীণ এবং বাংলালিঙ্ক দিয়েছে এই অর্থ। রবি এবং এয়ারটেল এই নিলামে অংশ নেয়নি, কারণ এই দুটি প্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়ার পর দুজনে মিলে আগে থেকেই অন্যদের চেয়ে বেশি তরঙ্গ ছিল।
এই যে বিপুল টাকা পেল সরকার, সরল দৃষ্টিতেই বোঝা যাচ্ছে, এতে সরকারের লাভ হয়েছে, আগামীতে আরও হবে। আর এই মোবাইল কোম্পানিগুলো, ওরা তো ব্যবসায়ী, নিশ্চয়ই এই বিশাল অঙ্কের অর্থ তারা তাদের বিনিয়োগ হিসাবেই বিবেচনা করবে। টাকাগুলো তারা উঠিয়ে নেবে আমজনতার কাছ থেকে। তার মানে, টাকার এই অঙ্ক যত বড়ই হোক না কেন, সেটা আসলে দিচ্ছি আমরা সাধারণ মানুষ। বিনিময়ে কিভাবে কি পাচ্ছি আমরা?
এই পর্যায়ে আমি নিজে কিছু অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৩ ফেব্রুয়ারি নিলাম হলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হলো। ফোরজি পেতে যাচ্ছি, কিছু না বুঝেই আরো অনেকের মতো উত্তেজিত আমি। অনলাইনে দেখি গ্রামীণফোনের একটা বিজ্ঞাপন, সিম পাল্টে ফোরজি সিম নেওয়ার বিজ্ঞাপন। সেখানে বলা হলোÑসিম পাল্টাতে ১১০ টাকা লাগবে, আর নতুন সিম নিলে দেড় জিবি ডাটা ফ্রি পাওয়া যাবে। আবার দেখলাম, অনলাইনেই সিম পাল্টানোর অর্ডার দেওয়া যায়। সে রাতে তেমন কোনো কাজ ছিল না, অবসরই ছিলাম, বসে বসে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দিলাম। ওদের দেখলাম একটা অনলাইন শপিং প্রতিষ্ঠানও আছে, ‘জিপি শপ’। বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাড়তি দিতে হলো আরও ৮০ টাকা। ওরা আমার অর্ডারের প্রাপ্তি স্বীকার করে মেসেজও দিল। জানালো দুদিনের মধ্যে আমার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে নতুন ফোরজি সিম। আমি অর্ডার করলাম ১৬ তারিখ দিবাগত রাত ১২টা ২ মিনিটে, সে অনুযায়ী ওটাকে ১৭ তারিখ ধরা যায়। তাহলে ১৯ তারিখের মধ্যে আমার সিম পাওয়ার কথা। ১৯ এর পর ২০, ২১ এবং ২২ তারিখও পার হয়ে গেল। সিম এখনো পাইনি। আমি পুরোই হতাশ। এ হতাশা বেড়ে যায় আরো, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের একটা বক্তব্যে। উনি বললেন, সিম পাল্টে দেওয়ার জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলো যে বাড়তি অর্থ নিচ্ছে, সেটা অনৈতিক! আরে, তাহলে কি আমি অনৈতিকতার ফাঁদে ঢুকে পড়লাম? গ্রামীণফোন এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান, তারা কেন এমন অনৈতিক আচরণ করবে? তবে আমার দুঃখের শেষ কিন্তু এখানেই নয়, আরও একটু আছে। আজ হঠাৎ করেই জানতে পারলাম, সকলের সিমই পরিবর্তন করার দরকার নেই। কিছু কিছু সিম নাকি আগে থেকেই ফোরজি এনাবেল আছে। এটা চেক করারও পদ্ধতি আছে, *১২১*৩২৩২# লিখে সেন্ড করলে ফিরতি এসএসএম জানা যাবে। কৌতূহল থেকে করলাম। এসএমএস পেলাম, আমার সিম নাকি ফোরজি এনাবেল, তাই সিম পরিবর্তন করা লাগবে না। নিশ্চয়ই এটা একটা সুখবর, কিন্তু আমার ১৯০ টাকার কি হবে? ওটা কি আর ফেরত পাবো? পাবো যে না, সেটা বুঝতে কোনো কষ্ট হলো না। ওরা কাউকে কখনো টাকা ফেরত দিয়েছেÑ এমন কারও কাছ থেকে শুনিনি। অথচ এই ঝামেলা থেকে আমি কিন্তু শুরুতেই রেহাই পেতে পারতাম। যখন আমি সিম পাল্টানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলাম, আমার নম্বরটা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ওরাই বলতে পারতো, আমার সিম পাল্টানোর কোনো দরকার নেই। কিন্তু তা তারা করেনি। বরং আমার ১৯০ টাকা মেরে দেওয়ার জন্য চুপ থেকেছে। শোনা যায়, গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা নাকি বর্তমানে ৭ কোটি। এর মধ্যে শতকরা একজনও যদি আমার মতো কৌতূহলী এবং আগ্রহী হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রক্রিয়াতেই ওদের আয় কত দাঁড়ায়? পুরো ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা! আমার বিবেচনায় এটা পুরোই বাটপারি, আর নিদেনপক্ষে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের দৃষ্টিতে ‘অনৈতিক।’ এখানে একটা কথা বলা জরুরি, গ্রামীণ ছাড়া অন্য দুটি মোবাইল কোম্পানি কিন্তু সিম বদলের জন্য বাড়তি অর্থ দাবি করেনি। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো কি? আমরা ওদের কাছ থেকে সিম কিনে ধরা খেয়ে গেছি, এখন ওরা যা বলবে তাই করতে হবে? আর কেবল ‘অনৈতিক’ বলেই সরকার তার দায় সারবে?
একটি প্রতিষ্ঠানের কথা বাদ দিয়ে আমরা বরং ফোরজি সেবা নিয়ে একটু কথা বলি। এর মধ্যে ফোরজি বিষয়টা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। প্রযুক্তিগত নানা টার্ম শুনেছি, কিছু বুঝেছি কিছু বুঝিনি। কিন্তু সব মিলিয়ে যতটুকু উপলব্ধি করেছি সেটা হলোÑ ফোরজিতে স্পিড বাড়বে মোবাইল নেটের, অনলাইন কল বা ভিডিও কলের ছবি বা শব্দ ভেঙে ভেঙে যাবে না, দ্রুত ডাটা ট্রান্সফার হবে। কত দ্রুত? তারও একটা হিসাব দেওয়া হয়েছে, থ্রিজির চেয়ে দশগুণ দ্রুত। এই পর্যন্ত শুনতে ভালোই লেগেছে। এবার একটু বাস্তবতার দিকে তাকাই।
দেশে থ্রিজি নেটওয়ার্ক চালু হয় ২০১২ সালে। এরপর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। দেশের সব জায়গায় কি পাওয়া যায় থ্রিজি নেটওয়ার্ক? নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার গ্রামের বাড়ি মুক্তাগাছায়। ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। মুক্তাগাছা মোটেই প্রত্যন্ত কোনো এলাকা নয়। ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর কিংবা টাঙ্গাইল যেতে হলে মুক্তাগাছার উপর দিয়েই যেতে হয়। সেই ১৮৭৮ সাল থেকে এটি পৌরসভা। ঢাকা থেকে যখন মুক্তাগাছায় যাই, কখনোই আমার মোবাইলে থ্রিজি নেটওয়ার্ক পাই না। সেটে নেটওয়ার্কের টাওয়ারেই লেখা থাকে টুজি। ওখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে দেখি স্ক্রিনে একটি বৃত্তের মতো কেবল ঘুরছে আর ঘুরছে।
এই ঘুরপাকের মধ্যেই চালু হলো ফোরজি। ঢাকায় বসেই বা এই ফোরজির প্রত্যাশিত স্পিডের কতটুকু আমরা পাবো? এতদিন থ্রিজির পুরো স্পিডই কি পেয়েছি কখনো? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে বরং পূর্ববর্তী জেনারেশনের অন্য সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে কেবল ডাউনলোড স্পিডের দিকে একবার তাকাই। তত্ত্বগতভাবে ১জি নেটওয়ার্কের সর্বোচ্চ স্পিড ছিল ২৮ থেকে ৫৬ কেবিপিএস। টুজিতে সেটি বেড়ে হলো ২৫০ কেবিপিএস। থ্রিজি তে এসে একটা বড় পরিবর্তন হলো এই স্পিডে। শুরুতে থ্রিজির ডাউনলোড স্পিড ২এমবিপিএস ছিল, পরে থ্রি পয়েন্ট ফাইভজির ডাউনলোড স্পিড ১৪.৪ এমবিপিএস পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু আমরা কি সেটা কখনো পেয়েছি? কখনোই পাইনি। আমাদের দেশে যারা মোবাইল ব্যবহার করেন, গত কয়েক বছর ধরে যারা থ্রিজি সিম ও নেটওয়ার্কের জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলোকে টাকা দিয়ে আসছেন, তার কেউই কখনো ২০০ কেবিপিএসের চেয়ে বেশি স্পিড পেয়েছেন বলে জানা নেই। অর্থাৎ যা পাওয়ার কথা তার দশভাগের একভাগও পাননি। আর এবার যখন ফোরজি নেটওয়ার্কে থ্রিজির দশগুণ, অর্থাৎ ১০০ এমবিপিএস থেকে শুরু করে ওয়ান জিবিপিএস পর্যন্ত পাওয়ার কথা, তখন সেটা শেষ পর্যন্ত কততে গিয়ে দাঁড়াবে, তা হয়তো আর কিছুদিন পরেই টের পাওয়া যাবে। তবে এদের চরিত্রের যে নমুনা আমরা এরই মধ্যে পেয়েছি, তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে তো মনে হয় না।
আর এর পাশাপাশি, বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হবে এলাকাভিত্তিক বৈষম্যের বিষয়টি। আমি যখন ঢাকা থেকে মুক্তাগাছায় যাবো, ফোরজি তো দূরে থাক থ্রিজি স্পিডও পাবো না। আমার জন্য এটা হয়তো সাময়িক সমস্যা, কিন্তু যারা ওখানেই থাকেন নিয়মিত, এই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা বঞ্চিত থাকবেন ফোরজি সেবা থেকে।
সরকার অবশ্য একটা সময়সীমা ঠিক করে দিয়েছে। বলেছে ফোরজি লাইসেন্স পাওয়ার দিন থেকে ৩৬ মাসের মধ্যে সব জেলা শহরে ফোরজি সেবা দিতে হবে। এছাড়া লাইসেন্স পাওয়ার ৯ মাসের মধ্যে সব বিভাগীয় শহরে এবং ১৮ মাসের মধ্যে ৩০ শতাংশ জেলায় ফোরজি সেবা দিতে হবে। এরকম নীতিমালা থ্রিজির সময়েও ছিল। সে নীতিমালা কতটুকু মেনেছে মোবাইল কোম্পানিগুলো? যদি মানতো তাহলে তো দেশের কোথাও আর এখনো টুজি স্পিডের উপর নির্ভর করতে হতো না মোবাইল গ্রাহকদের।
আরও একটা চিন্তার বিষয় কিন্তু আছে। সেটি হচ্ছে, ফোরজি সেবা চালু হলে কেমন চার্জ দিতে হবে গ্রাহকদের? তত্ত্বগতভাবে কিন্তু চার্জ বৃদ্ধির কোনোই কারণ নেই। একাধিক বিশেষজ্ঞের মতে, ফোরজিতে বরং সার্ভিস প্রোভাইডারদের খরচ কিছুটা কমে যাবে। কিন্তু এত বছর যাবৎ মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে নৈতিকতার যে নমুনা আমরা দেখেছি, তাতে খরচ কমার কথা তো ভাবাই যায় না। বরং বর্তমান খরচের মধ্যে থাকলেও নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান ভাবতে ইচ্ছা করবে।
মোবাইল কোম্পানিগুলো এত এলোমেলো আচরণের পরও আমাদেরকে মেনে নিতে হবে, আমরা এখন ফোরজি যুগে বাস করছি। এই ফোরজির কারণে আপনার জীবন যাত্রার কি পরিবর্তন হয়েছে, সেটা হয়তো আপনি বোঝেন না, অথবা আপনার হয়তো বোঝার ক্ষমতাই নাই, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। ফোরজির মহিমা প্রচার করাই এখন যুগের দাবি। চলুন সেটাই করি সবাই মিলে।
মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক