প্রশ্নফাঁস: জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা?

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ০৬ মার্চ ২০১৮, ২১:৩০

আলোচনা-সমালোচনায় সম্প্রতি শেষ হলো এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এপ্রিলের শুরুতেই দেশে একযোগে শুরু হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমকি (এইচএসসি) বা সমমান পরীক্ষা। সমাপনী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত পরীক্ষা এলেই যেন বিবেকবানদের ভাবিয়ে তোলে। আমার মতো ছোট মানুষ এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। কিন্তু কিছু ভাবনা ঘুমাতে দেয় না। বাধ্য হয়েই জড়িয়ে যাই ভাবনায়। আজ যারা স্কুল কলেজের ব্রেঞ্চে বসে পড়ছে কাল তারা দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসে দেশ পরিচালনা ফাইল নিয়ে পর্যালোচনা করবে। সুতরাং তাদের নিয়ে না ভাবার সুযোগতো নেই।

অতীতে পাবলিক পরীক্ষায় নকলের মহোৎসব দেখা যেত। পরীক্ষার আগের রাতে দুর্বল শিক্ষার্থী লম্বা কাগজে লিখতো কমন প্রশ্নের উত্তরগুলো। পরীক্ষার শুরুতে কক্ষে-কক্ষে দপ্তরি এসে বলতেন অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে দাও। কেউ মনে করতো নকল জমা দিতে হবে, কেউ মনে করতো কমন প্রশ্নের উত্তর রেখে অপ্রয়োজনীয়গুলো জমা দিতে হবে। সব মিলিয়ে বস্তা ভরে যেত নকলে। পরে পুড়িয়ে ফেলা হতো। পরীক্ষার মাঝে প্রিয় বন্ধুকে নকল দিতে ভবন বেয়ে সহযোগীদের উপরে উঠতে দেখা যেত। পরীক্ষার শেষ পনের মিনিটের ঘণ্টা বাজলে স্বজনরা ভিড় করতো কক্ষের সামনে। শেষ সময়টুকুতে একটু সহযোগিতা করা যায় কি না। আপনজনের এইটুকু অসততা অনেকেই মাথা নিচু করে হলেও স্বীকৃতি দিতেন।

সম্প্রতি নকলের প্রবণতা আগের অবস্থানে নেই। তবে আসছে আরও ভয়াবহতা। প্রশ্নপত্র ফাঁস। এটা মেধাবী শিক্ষার্থী, সচেতন অভিভাবক ও আদর্শ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে একটি আতঙ্ক। আর এই প্রশ্নপত্রের ফাঁসকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী নেই পড়ার টেবিলে। শিক্ষক শিক্ষিকাদের কেউ কেউ এর যোগান দিতে গিয়ে শিক্ষকের মর্যাদা নিজেরাই ক্ষুণ্ন করছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকেরই বইয়ের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। প্রশ্নপত্র পাচ্ছে। কী প্রয়োজন পরিশ্রম করার। বছর শেষে পরীক্ষা। ফলাফলে পাস। হোক সেটা ‘সি’ গ্রেড। পাস করলেই কি চাকরি অপেক্ষা করছে? না। চাকরির জন্য চাই যোগ্যতা। আর যোগ্যতা অর্জনের জন্য চাই নিয়মিত স্কুলে উপস্থিতি আর নিয়মিত চর্চা। প্রশ্নপত্র পাবে এই প্রত্যাশায় বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে না অনেকেই। অনেকের ধারণা চাকরি নেই। তাহলে পড়ালেখা করেই বা লাভ কী! আসলে দেশ চাকরি দেওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাচ্ছে না। পরীক্ষার ধরণ যদি এরকম হয়, যোগ্যতা সৃষ্টি হবে কীভাবে?

আসা যাক মূল কথায়। প্রশ্নপত্র ফাঁস। এটা স্বাভাবিক। মন্ত্রীরাও বলছেন এটা নতুন কিছু না। আগেও ঘটেছে। আমরাও মেনে নিলাম। আতঙ্কের বিষয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের পদ্ধতি পাল্টে যাওয়া। প্রয়োজনের তাগিদে শিক্ষার্থীরা কক্ষের তালা ভেঙে প্রশ্নপত্র ফাঁস করবে এটাও মেনে নেওয়া যায়। ভাবতে হবে নিজ প্রয়োজনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা হতে পারে। হোক সেটা দেশীয় চক্র। হোক বা বাইরের চক্র। প্রশ্ন যদি নিজের বা স্বজনদের জন্য ফাঁস করে থাকে তাহলে সেটা পৌঁছে দেওয়ার কথা গোপনে। হতে পারে সেটা হাতে-হাতে। হতে পারে ইন বক্সে। হতে পারে মেইলে বা ফোন কল করে। প্রকাশ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া এটাতো নিজের স্বজনদের দেওয়া হলো না। ফেসবুকে প্রশ্নপত্র আপলোড করা সাধারণ অর্থে ধারণা করা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হলে অত্যাধিক গোপনীতা রক্ষা করা হতো। শুধু গোপনে কাছের মানুষদেরকে দেয়া হতো। মিডিয়াতে প্রচার হয় পৌনে এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র ফেসবুকে। কোনো কোনো মিডিয়াতে জানা যায়, আগের রাতে প্রশ্নপত্র ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও অসহায়ত্ব বোধ করছে। বিজি প্রেস হতে শুরু করে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী এবং এর সাথে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর কড়া নজরদারি রাখার পরও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বন্ধ হয়নি। এমনকি পরীক্ষার দিন যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়, এজন্য পরীক্ষার্থীদের আধাঘণ্টা আগে পরীক্ষার হলে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার পরও কোনো পরিবর্তন নজরে আসেনি।

তবে চক্রটি কতটা শক্তিশালী? এবার লক্ষ্য করা গেছে প্রশ্নপত্র পাইতে বিস্ময়করভাবে বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞাপন। কোথাও কোথাও বলা হয়েছিল, প্রশ্ন পেতে হলে এই গ্রুপটিতে লাইক দিন। যারা লাইক দিয়েছে, তাদেরকে ম্যাসেঞ্জারে প্রশ্ন ও উত্তর পাঠানো হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা সংঘবদ্ধ ও সুচতুর। তারা নিজের জন্য নয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অপকৌশল অবলম্বন করছে। তাদের মোকাবিলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ততোধিক কৌশলী হতে হবে।

শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে দৌড়ানো যায় তাহলে ওই জাতিকে মেধাশূন্য করা কঠিন হবে না। যারা দেশ আর জাতিকে ভালোবাসে তারা অবশ্যই নিজ জাতিকে মূর্খ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগার কথা নয়। তাহলে ওরা কারা? হতে পারে দেশের বাইরের কেউ। দেশের মানুষকে মেধাহীন করে রাখতে পারলে আমাদেরকে গোলাম করে রাখাটা অনেক সহজ হবে। দেশের ভেতরেও কেউ থাকতে পারে। অবশ্যই দেশের কোনো সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে সেই ব্যক্তির তেমন কোনো ভাবনা নেই। হতে পারে সরকারকে বেকায়দায় ফেলাটাও প্রশ্নপত্র ফাঁসের আরেকটি উদ্যেশ্য। দূর থেকে এটা সম্ভব নয়। অবশ্যই ওই চক্রটি প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারীদের খুব কাছে অবস্থান করে।

হতে পারে মন্ত্রণালয়ের নিজেদের ভেতরের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা আরেকটি উদ্দেশ্য। সফল হতে বাধা দেওয়ার একটা হাতিয়ার হতে পারে প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রশ্নপত্র ফেসবুক ফাঁস করতে পারে না। এটা একটা মাধ্যম মাত্র। অথচ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বারবার ফেসবুককে দায়ী করছে। ফেসবুক বন্ধের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রণালয়। ফেসবুক বন্ধ করলে কতটা সফল হওয়া যাবে এই নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। ফেসবুক বন্ধ করলে চক্রটি হয়তো নতুন কোনো মাধ্যমের আশ্রয় নেবে। এভাবে কতদিন?

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা গোটা জাতির জন্য উদ্বেগজনক। দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার যে সাফল্য, সেটা এই কেলেঙ্কারিতে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরে দিতে পারলে শুধু পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়াই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনে আরও কঠোর হতে হবে। এই সম্পর্কিত পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) ও আইসিটি আইনের যথাযথ প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। এই ধরনের অপরাধ বন্ধে দরকার মোবাইল নম্বরের যথাযথ রেজিস্ট্রেশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁস আগেও হয়েছে, কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বিস্ময় আর সহ্যের সীমাও অতিক্রম করেছে। সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজে একবার বিষয়টি চিন্তা করে দেখুন, সারা বছর সততার সঙ্গে সন্তানকে পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করেছেন, সে লেখাপড়া করেছে, কিন্তু পরীক্ষার দিন সে জানতে পারছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তারই কোনো সহপাঠী ‘ভালো’ পরীক্ষা দিয়েছে। জানতে পারছে, তার সেই সহপাঠীরই হয়তো অভিভাবক, হয়তো শিক্ষক, হয়তো কোনো নিকটজন এর ব্যবস্থা করেছেন! এরপর তার বিশ্বাস বা আস্থার কি কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট থাকে? শুধু এটুকুই নয়, এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, ‘জিপিএ-৫’ নামের প্রজন্ম একটি অন্তঃসারশূন্য প্রজন্ম হয়ে বেড়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোয় যার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটছে। মিডিয়াতে আমরা দেখেছি গত এসএসসি পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। অথচ শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, প্রমাণ পেলে ওই পরীক্ষা বাতিল করা হবে। তাহলে কি গণমাধ্যমগুলো মিথ্যা বলছে? আর কীভাবেই বা প্রমাণ করতে হবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

এখন শোনা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন এক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর তা কার্যকর করা হবে আগামী এইচএসসি পরীক্ষার সময় থেকেই। পরীক্ষার দিন সকাল ৭টায় শিক্ষাবোর্ডগুলো তাদের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সংশোধন ও চূড়ান্ত করবেন। প্রশ্নপত্রের চারটি সেট করবেন তারা। প্রতিটি পরীক্ষা কেন্দ্রে থাকবে কেন্দ্র সচিবের তত্ত্বাবধানে একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার, একটি মডেম এবং একটি আইপিএস থাকবে। পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টা আগে, সকাল সাড়ে ৯টায়, শিক্ষাবোর্ডে লটারি করে প্রশ্নপত্রের সেট নির্বাচন করবেন। তারপর তা শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান ই-মেইল করে সবগুলো পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেবেন। প্রশ্নপত্র উন্মুক্ত করার পাসওয়ার্ড বা কোড থাকবে প্রত্যেক কেন্দ্রসচিবের কাছে। তিনি তার ল্যাপটপে ই-মেইল খুলে কোড উন্মুক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে সেটি প্রিন্ট করিয়ে নেবেন এবং বিতরণ করবেন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে। বিড়ালের ভয়ে নিরামিশ খাওয়া কতটা যৌক্তিক? এখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের হাত বেশি হওয়ার সুযোগ থাকবে। হ্যাকারতো আর বসে নেই। তারাও পাসওয়ার্ড খুলতে নতুন নতুন স্টাডি করবে নিশ্চিত।

এভাবে চলতে থাকলে জাতি একসময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। সুতরাং এভাবে চলতে দেওয়া উচিত হবে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবুও সফলতা তেমন কোনো দৃষ্টান্তের দেখা মেলেনি। সেহেতু আরো নতুন পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

লেখক: সংবাদকর্মী, শিক্ষক মানবাধিকারকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :