আদর্শের বঙ্গবন্ধু ও ইতিহাসের মার্চ

ফারুক নওয়াজ
 | প্রকাশিত : ০৭ মার্চ ২০১৮, ০৮:১২

এই মার্চ বাঙালির মাস। প্রতিবাদের, বিপ্লবের, জ্বলে ওঠার, আত্ম-উন্মোচনের, চেতনার, যুদ্ধের ও মুক্তির মাস। বাঙালির ইতিহাসের পরতে-পরতে জ্বলজ্বলে এ মাসের ঘটনাকণিকা। সবচেয়ে বড় ঘটনা বঙ্গবন্ধুর জন্ম। ১৭ মার্চ ১৯২০, বাংলার অখ্যাত এক অজ-গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম যখন হয় তখন চলছে বিদেশিপ্রভুদের হাতে ১৬০ বছর ধরে চলে আসা স্বদেশের পরাধীনতার দুর্বিষহ পীড়নপর্ব। ১০০ বছরের ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের পর তখন সরাসরি ইঙ্গ-মহারানির হাতে বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষের ৬০ বছরের শাসন-দণ্ড চলে আসে।

এই শাসন-শোষণের ইতি ঘটেÑ যখন বঙ্গবন্ধু ২৭ বছরের যুবক; তবে তখনই তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জাতীয় নেতাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কলকাতার জনপ্রিয় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের অসাম্প্রদায়িক মানবিক-সত্তার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর মহৎ কর্মযজ্ঞের জন্য। নজরুলের কাব্যবাণীÑ ‘হিন্দু না ওরা, মুসলিম নয়Ñ সন্তান মোর মা’র’ এই সত্য-সুন্দর ভাবনাটি তিনি সার্থক করে তুলেছিলেন নিজের জীবন বিপন্নের আশঙ্কা জেনেও জাতি-ধর্মনির্বিশেষে দাঙ্গা-পীড়িত শঙ্কিত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে।

এরপর তো দেশ ভাগ হয়ে বাঙালির জীবনে নয়া শোষণের ক্রান্তিকাল শুরু হলো পাকিস্তানের মতো একটি বিষবৃক্ষের শেকড়ে জড়িয়ে। ইতিহাসের অনিবার্যতায় যে-শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তান কায়েমের স্বপ্নে বিভোর মুসলমান ছাত্রদের দিক-নির্দেশক; সেই শেখ মুজিব এই পাকিস্তান পয়দার পর বুঝলেনÑ ভুল সবই ভুল! ধর্মের নামে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক শাসনের সূত্রপাত শুরু হলো সাধের পাকিস্তানে। শুধু ধর্মই নয়; ভাষাও হয়ে ওঠে ওদের শোষণের আর এক উলঙ্গ। ওরা যারা নতুন দেশ পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায়Ñ তারা সংখ্যায় অল্প এবং তাদের একাংশের ভাষা উর্দু। তাদের বাস পাকিস্তানের পশ্চিমাংশÑ পশ্চিম পাকিস্তানে। এই পশ্চিমে আরো অনেক ভাষাভাষী নাগরিক বাস করেÑ যারা পশতু, সিন্ধি... এমন নানা ভাষায় কথা বলে। আর দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাঙালি। তাদের সবার ভাষা বাংলা এবং তারা সবাই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ এই বাংলাদেশ ভূখ-ের অধিবাসী।

তারুণ্যে দীপ্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী থাকাকালেই নতুন দেশ পাকিস্তানের চেহারা চিনে ফেলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায়সংগত দাবির আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রথম গ্রেপ্তার বরণ এবং আপসহীনতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়ার ক্ষত নিয়ে তাঁর দুর্দমনীয় রাজনৈতিক জীবনের অভিযাত্রা শুরু হয়। মাত্র ৫৫ বছরের আয়ুষ্কালের বঙ্গবন্ধুর বিশাল রাজনৈতিক জীবনের আলোকপাতে না গিয়ে শুধু মার্চ মাসকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুময় বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসের যৎকিঞ্চিৎ আলোচনাই এ-নিবন্ধে তুলে ধরতে চাই। সবচেয়ে বড় ঘটনা ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম। তাঁর জন্ম না হলে এ-নিবন্ধ লেখার প্রশ্নই আসতো না। দ্বিতীয় ঘটনাÑ পাকিস্তান পয়দার সাত মাসের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহম্মদ আলী জিন্নার ঢাকা আগমন এবং এবং ঘোড়দৌড় মাঠে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে উপস্থিত ছাত্রদের না-না-না... প্রতিবাদে জিন্নার থমকে যাওয়া।

১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ-নির্বাচনে শাসকদল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় এবং যুক্তফ্রন্টের যে বিজয় সূচিত হয় সেখানে অন্যতম শরিকদল আওয়ামী লীগই পায় ১৪০ আসন। ১১ মার্চ, ১৯৬৪, প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু সে-সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই স্বাধীনতা বা মুক্তির সোনালি সনদ-ঘোষিত হয় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন। সেই সনদের নামÑ ছয় দফা। অনেকে এই ছয় দফার ভিত্তিসূত্র ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক গৃহীত ‘লাহোর প্রস্তাব’ বলে মনে করেন। বাস্তবে কিন্তু লাহোর প্রস্তাব আর ছয় দফার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

ভারত বিভক্তির মাধ্যমে সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্রভাবনা থেকেই ‘লাহোর প্রস্তাব’ উঠে আসে। বাস্তবে এটির মধ্যেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা বা সাম্প্রদায়িক গন্ধ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ছয় দফা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তিভাবনার আকাক্সক্ষা থেকে প্রণিত। ১ মার্চ, ১৯৬৬Ñ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশে সারা দেশে গণসংযোগ শুরু করেন। এই স্বাধীনতা বা মুক্তির সোনালি সনদ ঘোষিত হয় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন। অনেকে এই ছয় দফার ভিত্তিসূত্র ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক গৃহীত ‘লাহোর প্রস্তাব’ বলে মনে করেন। বাস্তবে কিন্তু লাহোর প্রস্তাব আর ছয় দফার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

১০ মার্চ, ১৯৬৯Ñ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে যান আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গণ-অসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানি শাসক-গোষ্ঠী ও রাজনীতিকরা এই দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করে ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন।

৩ মার্চ, ১৯৭১Ñ সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করলে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট এদিন ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ১ মার্চ ও ৩ মার্চের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এদিনই দলের কার্যকরী কমিটির জরুরি সভায় ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। হরতাল-শেষে তিনি অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে দাবি জানান। এইদিনই পল্টন ময়দানে সমাবেশে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন।

মার্চের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনারা দেশের নানা স্থানে বাঙালির প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালাতে থাকে। হতাহতের খবর আসতে থাকে নানা জায়গা থেকে।

৭ মার্চ, ১৯৭১Ñ বঙ্গবন্ধুর দুনিয়া কাঁপানো ৭ মার্চের সেই মহাভাষণ আজ জাতিসংঘের সংরক্ষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের সর্বশক্তি নিয়ে জাতিকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান।

২৬ মার্চ, ১৯৭১Ñ একাত্তরের ২৫ মার্চ দিন শেষে রাতের প্রথম প্রহরেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে রাতের মধ্যপ্রহরে অর্থাৎ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেন এবং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ প্রদান করেন। সেই ঘোষণা চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে ইথারে-ইথারে ভেসে যায় দেশে-বিদেশে মানুষের কাছে। এর কিছুক্ষণ পরই বঙ্গবন্ধুকে পাকবাহিনী বন্দি করে নিয়ে যায় তাদের পশ্চিমের কসাইখানায়।

বঙ্গবন্ধুময় মার্চ আরো নানা ঘটনায় আবর্তিত হয়েছেÑ সবই আজ বাঙালির ইতিহাসের গৌরবময় অংশ। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় জিন্নাহ সাহেবের ঘোষণাÑ উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষাÑ এর বিরুদ্ধে না-না বলে তীব্র প্রতিবাদ করা ছাত্রদের মধ্যে যেমন বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তেমনি জাতির যাবতীয় সংগ্রামী সাহসী স্বপ্নময় ঘটনায় মূল নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং এসবে অধিকাংশই ঘটেছে মার্চ মাসে। তাই মার্চ বাঙালির ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মাস।

দুই.

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বগুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন নানাভাবে। তিনি যখন শুধুই শেখ মুজিব, তখন তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী এস আর পাঠকে বলেছিলেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, মুজিব একদিন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিখ্যাত আমেরিকান মিশনারি জেনিন লকারবি তাঁর অনডিউটি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যে অনগ্রসর বাঙালি জাতিকে মুক্তির আস্বাদ দেবে। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

একাত্তরের ২ মে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছিল, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর কাপড় স্পর্শ করা ছিল তাবিজে শুভফল পাওয়ার মতো। তাঁর বাক্যই হয়ে ওঠে আইন। তাঁকে বিশ্বের সেরা সংবাদ সাপ্তাহিক নিউজ উইক রাজনীতির কবি আখ্যা দিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল। এই পত্রিকার সম্পাদক লোরেন জেনিকন্স মন্তব্য করেন, একরাশ চুল, ঝোঁপসদৃশ গোঁফ এবং সতর্ক কালো চোখের অধিকারী মুজিব দশ লক্ষ শ্রোতার সমাবেশে আবেগপূর্ণ বাগ্মিতার উত্তাল ঢেউয়ের মাধ্যমে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে সক্ষম। আর মহাবিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মন্তব্য তো আমরা জানিই। তাঁর সেই মন্তব্যÑ আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।

এতগুলো উদ্ধৃতি টানার একমাত্র উদ্দেশ্য আমারÑ সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব চিনলেও আমরা তাঁকে আজো চিনিনি। ১৫ আগস্ট ঘাতকরা জাতির পিতাকে হত্যা করার পর যারা একটি ছোট্ট অনুশোচনা করারও সৎসাহস দেখাননি, বরং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দু-চারটি নিন্দা জ্ঞাপন করে ঘাতক-শাসকচক্রের প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন বা ভয়ে মুখ লুকিয়েছেনÑ তারাই আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার শাসনামলের সবচেয়ে বড় চাটুকার এবং সুবিধাভোগী হয়ে উঠেছেন। তাঁরা আজ বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা আর বন্দনাগানে মুখর। আমার অবাক লাগে তাদের কীর্তি দেখে। অর্থ-পদ-পদবি-তকমা-জমি সবই তারা নয়া চাটুকারিতার পারিতোষিক হিসেবে নিরন্তর পেয়ে চলেছেন। এইতো সেদিন, বিবিসি যখন বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঘোষণা করল, সেদিনও আজকের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী এবং শ্রেষ্ঠ লেখক বনে যাওয়া কেউ-কেউ মিডিয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেনÑ এটা কি করে হয়! রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আর কাউকে কি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ভাবা যায়?... তাদের সেই মন্তব্যটি এতো শিগগিরই কি সবাই ভুলে গেল? দুঃখ এটাই যে, এরাই থাকে সবসময় প্রাপ্তির ফর্মে, সামনের আসনে এবং হালুয়া-রুটির স্বাদ এরাই শুধু নিয়ে যাচ্ছে। জানি না এই তোষামোদকারী সুবিধাভোগীরা আবার কোনো বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে?

সবশেষে বলব, বঙ্গবন্ধু যে সদ্যস্বাধীন ভাঙাচুরা দেশটা পেয়েছিলেন তাকে গড়ে তুলতে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। টাকা নেই, প্রাযুক্তিক মেধা নেই, সামর্থ্য নেই। তার ওপর চারপাশে শত্রু, লুটেরা, চোর। বঙ্গবন্ধুর আক্ষেপ তখন বাতাসে ভেসেছেÑ আমার চারপাশে চোর। ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে-পেছনে শুধুই চোর! সেই চোরদের মধ্যে থেকেই তিনি বারবার বলতেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। না সেই সোনার মানুষ খুঁজে পাননি আর। তারপর-তো তাঁর ‘আপনজন’ বিশ্বাসঘাতকেরাই তাঁর জীবন সংহার করে মেতে উঠলো পৈশাচিক উল্লাসে। বঙ্গবন্ধু জাতিকে সুখী করতে চেয়েছিলেন। শিশুদের গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নিরাপদ পরিবেশে। কোষ শূন্যÑ তবুও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়েছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন, নারী শিক্ষার প্রসারে নানা প্রকল্প প্রণয়ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এত কাজ এবং শুভ ভাবনার প্রচার বা বিশ্লেষণ কেউ করেনি। উল্টো গোপনে ষড়যন্ত্র করেছে। কারণ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের টাকা ছিল না। আমেরিকা, চীন, সৌদিÑ এরা বাঙালির স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। তারা সাহায্য-ঋণ কিছুই তো দেয়নি, বরং বঙ্গবন্ধুর ক্ষতিসাধনে বিশ্বাসঘাতকদের ইন্ধন জোগাতে তখন তৎপর ছিল। টাকা ছিল না বলে দেশীয় বুদ্ধিবেচা চামচারা তাঁর সম্পর্কে ভালো কিছু লিখতে প্রয়াসী হয়নি। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার বাংলাদেশে টাকার অভাব নেই। ডিজিটাল দেশ উচ্চ-আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। ফলে ডিজিটাল চামচা, ডিজিটাল বুদ্ধিবেচা খোশামোদকারী ‘বুদ্ধিজীবী’রা স্বার্থের গন্ধে ঠেলেঠুলে এগিয়ে আসছে। কথায় বলে, ভাত ছিটালে কাকের অভাব নেই।

বঙ্গবন্ধুর মতোই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশপ্রেমী, উদার, সাহসী, প্রাজ্ঞ, মানবিক, সৎ এবং আবেগপ্রবণ। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্মাতা। পিতার আদর্শই তাঁর আদর্শ। কিন্তু সেই আদর্শ তাঁর চারপাশের লোকজনদের মধ্যে কতটুকু আছে সেটা ভাবার বিষয়। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি করে দিব্যি বুক উঁচিয়ে চলে লুটেরারা। তাঁর অর্থমন্ত্রীর কাছে এই শতকোটি, হাজার কোটি কিছুই না। তাঁর শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরদের উদ্দেশে আন্তরিক মন্তব্য করেনÑ যা তাদেরকে অন্যায়ে আরো উৎসাহী করে তোলে। প্রশ্ন ফাঁসের কেলেঙ্কারি তাঁকে স্পর্শ করে না। ইন্টারনেট-ফেসবুককে তিনি কি করে রোধ করবেনÑ এটাও একটা ব্যাপার। তবে সারা বিশ্বের কোথাও, কোনো দেশে কি এমনটি ঘটছে? তাদের দেশে কি ফেসবুক, ইন্টারনেট নেই? জাতি মনে করে সর্ষের ভেতরেই ভূত ঢুকে বসে আছে। এই ভূতদের বঙ্গবন্ধু চিনতে পারেননি এবং বিষয়টিকে নিয়ে ভাবারও অবকাশ পাননি। ফলে যা ঘটার ঘটে গেছে। আর এখন তো ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাল বাংলাদেশের ভূতগুলো আরো চালাক। আরো ধূর্ত। তবে ডিজিটাল সিস্টেম প্রয়োগ করে এদের সন্ধান করা কঠিন নয়। আর এখন যখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন ডিজিটাল বিশেষজ্ঞ একজন নতুন মন্ত্রীÑ তখন এসব জাল-জালিয়াতের রহস্য উন্মোচনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা চাই ক্ষতিকারক ভূতগুলো থেকে সরকারকে সচেতন হবে। এদের চি‎িহ্নত করে এগিয়ে যেতে হবে উন্নয়নের সোনালি পথে। নইলে ভবিষ্যতে জাতির খারাবি আছে।

ফারুক নওয়াজ: কবি-কথাসাহিত্যিক কলাম লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :