নওগাঁর ১৫ হ্যান্ডবল কন্যা

নওগাঁ প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৭ মার্চ ২০১৮, ২১:৫২

সুনাম কুড়িয়েছে নওগাঁর বদলগাছীর হ্যান্ডবল কন্যারা। বাংলাদেশে এখন এক বাক্যে তাদের চিনছে। এক সময় এসব কন্যাদের এলাবাসীর মুখ থেকে শুনতে হতো নানান আজেবাজে মন্তব্য। এমনকি পরিবার থেকেও ছিল বাধা। মেয়েরা কেন খেলাধুলা করবে। কেনই বা তারা দূর দেশে গিয়ে খেলবে। বিভিন্ন কথা। শত বাধা আর গুঞ্জনকে পেছনে ফেলে এসব কন্যারা যখন সুনাম কুড়াতে শুরু করেছে। তখন সেই বাজে মন্তব্যগুলো ধুলোয় লুটোপুটি খেয়েছে। এখন সেসব লোকজনই এসব কন্যাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ করে রাখছে।

হ্যান্ডবল কন্যারা কেউ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। এদের সবাইকে শত অভাব-অনটনের মধ্যদিয়ে কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। কারো বাবা ভ্যানচালক, কেউবা দিনমজুর। আবার কারো বাবা কৃষক। এরা সবাই নিম্নবৃত্ত পরিবারের সন্তান। তবু তাদের চোখে মুখে স্বপ্ন। এক বুক ভরা আশা নিয়ে কাঁটা ভরা দুর্গম পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যাশা।

হ্যান্ডবল কন্যাদের শহরের খেলোয়াড়দের মতো প্রশিক্ষক বা অভিজ্ঞ কোন কোচ নেই। চঞ্চল প্রকৃতির ও দুরন্তপনা হ্যান্ডবল কন্যারা ‘বদলগাছী লাবণ্য প্রভা পাইলট ও কমিউনিটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ এ স্কুলের ছোট মাঠেই তাদের অনুশীলন। আর কোচ হিসেবে তাদের সহযোগিতা করে থাকেন, সুলতান আলী কবির বিয়ার নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি। তারা সবাই তাকে কাকু বলে সম্মোধন করে।

আর এ মাঠেই তারা রপ্ত করেছে হ্যান্ডবল খেলা। যে মাঠটিতে বর্ষকালে থাকে কাঁদাযুক্ত। প্রতিদিন বিকালে সেখানে চলে অনুশীলন। আর মাঠে শিক্ষা নিয়ে তারা সমানে কাপাচ্ছে বাংলাদেশ। এমনকি বিদেশের মাঠেও খেলার সৌভাগ্য হয়েছে এদের। নানান সমস্যার মধ্য দিয়েও তারা হ্যান্ডবল খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যান্ডবল খেলার যেসব সরঞ্জাম (কেট্স ও পোশাক) প্রয়োজন তা তাদের নেই। এমনকি অনুশীলন ও খেলার পর যে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে সেটাও সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে।

প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের অবহেলার শিকার হতে হয়েছে তাদের। কারণ তারা বয়সে ছোট এবং গ্রামের মেয়ে বলে। এরাও অনেকটা ঘাড়বে গিয়েছিল প্রতিপক্ষরা বয়সে বড় ও খেলার কৌশল দেখে। কিন্তু যখন খেলা আরম্ভ হয়, তখন হ্যান্ডবল কন্যাদের পরপর গোলিতে বলের আঘাতে প্রতিপক্ষরা এদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। ছিনিয়ে এনেছে বিজয়ের মুকুট।

আর এতো কিছুর পেছনে অবদান রেখে চলেছেন সমাজসেবী রজত গোস্বামী। যিনি দলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। যাকে হ্যান্ডবল কন্যারা কাকু বলে সম্মোধন করেন। সঠিক পৃষ্টপোষকতা পেলে এসব হ্যান্ডবল কন্যারা সামনের দিকে আরো এগিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা এলাকাবাসীর। সমাজে অনেক সহযোগিতা করার হৃদয়বান ব্যক্তি আছেন যারা চাইলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। আর একটু খানি সহযোগিতায় পারে তাদের উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে।

আর এসব কন্যাদের স্বপ্ন, আশা ও ভাবনা একেকজনের একেক রকম। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের সন্তান পূর্ণিমা রাণী। বদলগাছীর চকআলম গ্রামের মহেন্দ্র সরদার ও ফুলমনির কৃষক পরিবারের ছোট মেয়ে সে। বদলগাছী মহিলা কলেজের কারিগরি বিভাগের ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আদিবাসী এসব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারের অভাব-অনটন থাকায় বাবা-মায়ের সাথে কৃষি জমিতে কাজ করতে। আবারও অল্প বয়সে তাদের বিয়ে দেয়া হয়। লেখাপড়ার সুযোগ তেমন তাদের হয়ে উঠে না। কিন্তু পূর্ণিমা রাণীর ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেছে।

পরিবারের দৈন্যদশার মধ্যে খেলার প্রতি প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহ নিয়ে সামনে এগিয়ে চলা।

শত বাধা আর বিপত্তিকে পেছনে ফেলে আজ একজন সুনামধন্য হ্যান্ডবল কন্যা হতে পেরেছেন। ২০১৭ সালে ঢাকায় জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়ান খেলায় সেরা খেলোয়ার নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া জাতীয় দল হয়ে ২০১৫ সালে থাইল্যান্ড এবং ২০১৭ সালে ভিয়েতনামে আন্তর্জাতিক আসরে হ্যান্ডবল খেলায় অংশ নিয়েছেন।

পূর্ণিমা রাণীর মেঝ বোন আঁখি লাকড়ি হ্যান্ডবল টিমে ভাল খেলায় বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি হয়েছে।

পূর্ণিমা রাণী জানান, ভবিষ্যতে খেলোয়াড় হিসেবে ডিফেন্সে যোগ দেয়া এবং খেলায় আরো ভাল পারফমেন্স করা।

পরিবারের ছয় সদস্যসের মধ্যে সবার ছোট মেয়ে শাহনাজ পারভীন। বদলগাছী সদরের দিনমজুর ও হোটেল কর্মচারী আব্দুস সামাদের মেয়ে। মা দেলোয়ারা বেগম একজন গৃহিনী। শাহনাজ পারভীন বর্তমানে বদলগাছী মহিলা কলেজে কারিগরি বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছেন।

বদলগাছী লাবণ্য প্রভা পাইলট ও কমিউনিটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকে হ্যান্ডবল খেলা শুরু। এরপর প্রতিযোগিতায় উপজেলা পর্যায়ে এবং জেলা পর্যায়ে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম খেলা শুরু করে।

শাহনাজ পারভীন জানান, পড়াশোনা শেষ করে পরিবারকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া। সমাজে সবচেয়ে বড় সমস্যা বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের কারণে আমার মতো অনেক মেয়ে অসময়ে ঝরে পড়ছে। যারা এখনো নিজেকে বুঝতে শিখেনি। তারা বিয়ের পর স্বামী-সংসার কিভাবে করবে। একটি হ্যান্ডবল টিম গঠন করা এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে।

উপজেলার জিওল গ্রামের বাদশা শেখ ও মিনা বেগমের ছোট মেয়ে নূর জাহান ভাবনা। বদলগাছী মহিলা কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বিভাগে পড়াশোনা করছে। ছোটবেলায় তেমন খেলাধুলা করা হয়ে উঠেনি। বদলগাছী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় মনোনিবেশন করে। তখন ২০১০ সাল। সমাজসেবক রজত গোস্বামী তখন প্রতিটি স্কুলে হ্যান্ডবল খেলার একটি করে টিম গঠন করেন। টিমটি মাস তিনেক চলার পর হঠাৎ করেই টিমের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়। তখন একা হয়ে যায়।

তারপর একাই নওগাঁ জেলা টিমে খেলাধুলা করতেন। আর জেলা পর্যায়ে বেস্ট-৭ এর মধ্যে তার নাম ছিল। কিন্তু স্কুলে আর অনুশলীন করা হয়ে উঠেনি টিম না থাকায়। কিন্তু সে ছিল নাছোড় বান্দা। হ্যান্ডবল খেলার জেদ চাপে মাথায়। এরপর বদলগাছী লাবণ্য প্রভা পাইলট ও কমিউনিটি উচ্চ বিদ্যালয়ের টিমের সাথে যোগ দেয়ার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এ স্কুলের মেয়েরা অন্য স্কুলের মেয়েকে কেন টিমে নেবে এ নিয়ে রেসারেসি বা মনোমানিল্য শুরু হয়। অবশেষে ২০১১ সালে তাদের দলেই যোগ দিয়ে আবার নতুনভাবে খেলা শুরু।

নূর জাহান ভাবনা জানান, ২০১৭ সালে জাতীয় দলে চান্স পেলেও অসুস্থতার কারণে খেলা শুরুর তিন দিন আগে বাদ পড়ে যায়। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব ১৬ খেলায় নির্বাচিত হয়। ভবিষ্যতে পড়াশোনা শেষ করে পরিবারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। এছাড়া ডিফেন্সে চাকরি করারও ইচ্ছে আছে।

পরিবারের ছোট মেয়ে নাজনীন নাহার আশা। উপজেলা সদরে মাষ্টারপাড়া মহল্লার মৃত আফজাল হোসেন ও সুরাইয়া বেগমের মেয়ে। মা বদলগাছী মহিলা কলেজে আয়া পদে চাকরি করেন। আর এ আয় থেকে চলে সংসার। মায়ের কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ইন্টারমিডিয়ে প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করা হয়।

বদলগাছী লাবণ্য প্রভা পাইলট ও কমিউনিটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি থেকে হ্যান্ডবল খেলার সাথে যুক্ত হয়। বর্তমানে জেলা দলের হয়ে খেলা হয়। বেস্ট ৭ এর মধ্যে তার অবস্থান রয়েছে। মেধা ক্যাম্প তৃনমূল অনূর্ধ্ব-১৬ চান্স পেয়েছে।

নাজনীন নাহার আশা জানান, ভাল ভাবে লেখাপড়া শেষ করা। এরপর সরকারি একটা চাকরি করা। জানি না চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে কিনা। সমাজে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে নারীদের নিয়ে সচেতনামূলক কাজ করা।

নওগাঁ জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোচ, সমাজসেবী ও দলের সমন্বয়ক রজত গোস্বামী বলেন, ক্রীড়ার সাথে সম্পৃক্ত এবং নিজেদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে ১৯৯৬ সালে মহিলাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘মহিলা হ্যান্ডবল টিম’। ২০০৬-০৭ সাল থেকে হ্যান্ডবলের উপর ভাল একটা ফলাফল পাওয়া শুরু হয়। এর সিংহভাগ সহযোগিতা করে আসছিল ‘কিউট’ কোম্পানির কাজী মহাতাব উদ্দিন স্যার। তার নির্দেশনায় আমরা ভালভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

এ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে দুইবার চতুর্থ, দুইবার তৃতীয়, একবার রানার আপ এবং ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করা এসব মেয়েরা তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পারে না। তারপরও তাদের নিয়ে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কিছুদিন পর অনেকেরই বিয়ে হয়ে যায়। যা রোধ করা সম্ভব হয় না। যারা এখন টিমের হয়ে খেলছে তাদের যদি উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তাহলে আরো এগিয়ে যাবে। প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা।

বর্তমানে টিমে ১৫ জন মেয়ে খেলোয়ার আছে। টিমের জন্মলগ্নে গত বছর ৩ জন খেলোয়াড় সাহিদা বানু রনি, পূর্নিমা রাণী ও শাহনাজ পারভিন জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে খেলছেন। এছাড়া ৫ জনের মধ্যে দুইজন পুলিশে, দুইজন বিজেএমসি এবং একজন আনছার বাহিনীতে চাকরি করছেন।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও নওগাঁ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল বলেন, হ্যান্ডবল কন্যারা আমাদের নওগাঁর গর্ব। এদের খেলোয়ার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শুধু ক্রীড়া সংস্থা বা হ্যান্ডবল ফেডারেশন নয়। সমাজের বৃত্তবানদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতাসহ উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের আশাব্যক্ত করেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৭মার্চ/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :