সংসারের কাজ যেন নারীর বাধ্যতামূলক না হয়

জহির রায়হন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৮, ১০:১৭ | প্রকাশিত : ০৮ মার্চ ২০১৮, ০৮:২২

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এরপর ২০১৭ সালের আগ পর‌্যন্ত ৪৫ বছরে মোট ২৩ জন নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও নারী ছিলেন না। গত বছরের ১৫ অক্টোবর গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনে প্রথমবারের মতো একজন নারী নির্বাচন কমিশনার হলেন। বেগম কবিতা খানম। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস সামনে রেখে ঢাকাটাইমস কথা বলেছে দেশের প্রথম নারী নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন চাকরি ও সংসারে নারীর অবস্থান, তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা বিষয়। বলেছেন নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক জহির রায়হান

ঢাকাটাইমস: আপনি দেশের এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির প্রথম নারী নির্বাচন কমিশনার। নারীর ক্ষমতায়নে এটা কী ভূমিকা রাখছে?

কবিতা খানম: হ্যাঁ, এর আগে দায়িত্ব পালন করা ২৩ জন নির্বাচন কমিশনার মধ্যে একজনও নারী ছিলেন না। এবার সেটা হয়েছে। এটা নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।

ঢাকাটাইমস: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। সে ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী?

কবিতা খানম: নারীরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ পাচ্ছেন। তার পরও নারীদের অবস্থানকে একজন নারী হিসেবে দেখা হয়। একজন পুরুষকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয় নারীকে সে হিসেবে দেখা হয় না। এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সহকর্মী নারী কিংবা পুরুষ যে-ই হোক না কেন, তাকে শুধু একজন সহকর্মী হিসেবেই দেখা উচিত। তিনি নারী না পুরুষ এটা বিবেচনায় নেয়া অনুচিত।

আমাদের এখানে সিইসি (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) স্যারসহ পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার আছেন। আমাদের চারজন নির্বাচন কমিশনারকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়, আমাকে ডাকা ‘আপা’। কেন আর চারজনকে ব্রাদার বলা হয় না। ‘আপা’ ডাকটা যেমন অত্যন্ত মধুর, ‘ভাইয়া’ ডাকটাও কিন্তু অনেক মধুর শোনায়। এমনও হয়- আপা ডাকা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে বলা হয়- আপা ডাকটা এত মধুর, এত স্নেহের, তারপরও এ ডাকে বিরক্তি কেন! তাহলে কেন ভাই ডাকছেন না পুরুষ সহকর্মীদের। চেইন অব কমান্ড রাখতে হলে কিন্তু এই বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

শুধু নারী হওয়ার কারণে একজন আপা হয়ে যাচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। একটা অফিসিয়াল ডেকোরাম মেইনটেন করতে হলে দায়িত্বে নারী-পুরুষ যে-ই থাকুক না কেন, তাকে মর‌্যাদা দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষকে যে মর‌্যাদা দেয়া হয়, নারীকে তা দেয়া হয় না।

নারীকে কোনো কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে বা দেয়ার পর সব সময় সংশয় প্রকাশ হয় সেটা তারা পারবে কি না। এই হীনম্মন্যতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। তা না হওয়া পর‌্যন্ত নারীরা যতই শ্রম দিক না কেন, যতই পরীক্ষা দিক না কেন, নারীর অবস্থানের উন্নতি হবে না।

তবে এখন যেভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, আমার মনে হয় এ দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগসহ প্রতিটি জায়গায় নারীর পদচারণ এখন। কোথাও কি পাওয়া গেছে অযোগ্যতার কারণে কারও পদোন্নতি হয়নি? বরং নারীরা সব ক্ষেত্রেই ভালো করছেন। আমি মনে করি, নারীরা এখন এগিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ারও অনেক অবদান আছে। মিডিয়া অনেক সহায়তা করে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। এই সহযোগিতা সব সময় থাকলে নারীর মর‌্যাদা বৃদ্ধি পাবে। সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারবে প্রতিটি জায়গায়।

তৃণমূলে এখনো নারীদের প্রতি অনেক বৈষম্য করা হয়। যারা শ্রমিকের কাজ করছে, গার্মেন্টসে কাজ করছে- পুরুষের পাশাপাশি একই ধরনের কাজ করলেও তাদের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়।

ঢাকাটাইমস: নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে ২০২০ সালের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল- সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদে নারী রাখার কথা বলা হয়েছে। এটা নারীর ক্ষমতায়নে কেমন ভূমিকা পালন করবে?

কবিতা খানম: অবশ্যই নারীর ক্ষমতায়নে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরা এই শর্ত বেঁধে দিয়েছি এই জন্য যে, যাতে রাজনৈতিক দলে নারীদের নেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়। এই ৩৩ শতাংশ নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে তখন আর কোটার প্রয়োজন হবে না। মেয়েদের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তি এমনিতেই বেড়ে যাবে।

আমরা নারীরাই এখন অনেক সময় বলি চাকরির ক্ষেত্রে কোটাগুলো যেন না থাকে। কারণ চাকরিতে নারীদের নেয়ার একটা চর্চা তৈরি হয়ে গেছে। বিচার বিভাগে এখন প্রচুর নারী। ভবিষ্যতে রাজনীতির ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যাবে।

ঢাকাটাইমস: চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের ১০ শতাংশ কোটা রয়েছে।

কবিতা খানম: এটা দেয়া হয়েছে নারীদের নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করার জন্য। আমি কিন্তু বলছি সবার দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বদলায়নি। দেখা যায় কর্তৃপক্ষ একজন ছেলে ও একজন মেয়ের ভেতর থেকে ছেলেকে যোগ্য মনে করছে। তাকে চাকরি দিচ্ছে। ১০ জন ছেলে ও ৫ জন মেয়ে চাকরিতে অবেদন করলে শুধু ছেলেদের প্রাধান্য যেন না দেওয়া হয়, নারীকেও যেন এর মধ্যে বিবেচনায় রাখা হয় সে জন্যই এই কোটার ব্যবস্থা। নারীরা তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিতে থাকলে এই কোটা ব্যবস্থা একসময় থাকবে না।

ঢাকাটাইমস: অনেক নারীর অভিযোগ- তাদের ঘরের কাজকে কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।

কবিতা খানম: অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নারীরা শ্রমের স্বীকৃতি পায় না, মর্যাদা পায় না। আমরা চাই মর্যাদার সঙ্গে নারীরা বসবাস করবে। দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাইরে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরছেন। স্বামী বিশ্রাম নিচ্ছেন, টিভি দেখছেন, পেপার পড়ছেন; স্ত্রী তখন রান্নাঘরে চলে গেছেন, বাচ্চাদের সামলাচ্ছেন। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, আগে থেকে তৈরি করে রাখা যে- একজন নারী সে তো সংসারের কাজ করবেই। হ্যাঁ, মেয়েরা রান্না করবে, সংসারের কাজ করবে, কিন্তু এটা যেন বাধ্যতামূলক না হয়। এটা যেন স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে করেন। স্বামীও কাজ করবেন, স্ত্রীও করবেন। এ কাজটা যেন শুধু নারীর কাজ হিসেবে দেখা না হয়। আমি রান্না করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রান্না করছেন- সে ছবি আমরা দেখছি পত্রিকায়।

যত দিন সংসারের কাজকে নারীর কাজ হিসেবে দেখা হবে তত দিন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে না। তবে এখন এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস: এই পরিবর্তন কতটা আশাব্যঞ্জক?

কবিতা খানম: খুবই আশাব্যঞ্জক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। একসময় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদেও নারী ছিলেন। এখন অনেক স্বামী তার স্ত্রীকে সংসারের কাজে সহায়তা করেন। অনেকে এখন ‌বলেন, তাদের স্বামীরা সংসারের কাজে সহায়তা করেন। সন্তানদের দেখাশোনা করেন। দিন-দিন পরিবর্তন আসছে।

ঢাকাটাইমস: আমরা আশা করতে পারি একসময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদেও নারীকে দেখা যাবে।

কবিতা খানম: অবশ্যই হবে ইনশা আল্লাহ। কারণ নারীরা ভালো করছে। কোথাও তো তারা খারাপ করছে না।

ঢাকাটাইমস: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

কবিতা খানম: ঢাকাটাইমসকেও ধন্যবাদ।

একনজরে বেগম কবিতা খানম

১৯৫৭ সালে নওগাঁয় জন্ম নেওয়া বেগম কবিতা খানম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি, এমএসসি ও পরে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি ৩১ বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন। কবিতা খানম বর্তমান দায়িত্বের আগে সর্বশেষ রাজশাহীতে জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান কবিতা খানম।

(ঢাকাটাইমস/৮মার্চ/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

সাক্ষাৎকার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সাক্ষাৎকার এর সর্বশেষ

‘স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে সরকারকে ভারসাম্যমূলক নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে’: ড. আতিউর রহমান

প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে: ফরিদা খানম সাকি

দাম বাড়ালে এতক্ষণে কার্যকর হয়ে যেত: ক্যাব সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন

জন্ম থেকেই নারীদের যুদ্ধ শুরু হয়: নারী উদ্যোক্তা ফরিদা আশা

নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই

ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম করা উচিত: কাউন্সিলর আবুল বাশার

তদারকি সংস্থা এবং ভবন নির্মাতাদের দায়িত্বশীল হতে হবে: অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান

বেইলি রোডের আগুনে রাজউকের ঘাটতি রয়েছে: মো. আশরাফুল ইসলাম

নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ভবন অনুমোদন দিতে হবে: ইকবাল হাবিব

বীমা খাতে আস্থা ফেরাতে কাজ করছি: আইডিআরএ চেয়ারম্যান জয়নুল বারী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :