রাস্তায় নারী নিপীড়ন ও জয়বাংলা বিরোধী অপপ্রচার

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৯ মার্চ ২০১৮, ১০:৫৯

সাত মার্চের মত মহান ও ঐতিহাসিক দিনে ঢাকার বাংলা মোটরসহ কয়েকটি স্থানে নারী নির্যাতনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ বিরোধীরা যেন হাতে ঈদের চাঁদ পেয়ে গেছে। দেশের ভেতরে, বাইরে অবস্থানকারী জামায়াত-বিএনপির অনলাইন যোদ্ধারা মনের মাধুরী মিশিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই অপপ্রচারকারীদের উদ্দেশ্য নির্যাতিত মেয়েদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নয়; এদের টার্গেট সাত মার্চ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ। কিছু দুর্বৃত্তের অপকর্মের সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাশের অপচেষ্টায় মত্ত হয়েছে। বস্তুত রাস্তায় নারী নির্যাতনকারী বখাটে ছেলের দল আর ইতিহাস বিকৃতিকারী অনলাইন যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। এরা সকলেই ডুবে আছে অনাচারের চোরাবালিতে।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এর আমলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত স্মৃতি, ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। আরেক সামরিক শাসক এরশাদের আমল কিংবা পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার দুই আমলেও ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা ছিল বেপরোয়া। এভাবে বিকৃত ইতিহাস-সৃষ্ট একটি বখাটে প্রজন্ম জন্ম দিতে পেরেছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। তবু বাংলার, বাঙালির মানস থেকে শেখ মুজিবকে জাতির পিতার আসন থেকে নামাতে পারেনি বিকৃতি-জীবীরা। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হয়েই সিংহভাগ বাঙালির মন ও মগজে রাজ করে চলেছেন।

পিতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রতিটি সৎ, দেশপ্রেমিক নাগরিকের হৃদয়ে ও মানসে সম্মানীয় হয়ে থাকবেন আজীবন। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর কথা বলে, জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে একদল মানুষ অমানুষের মত কাজ করে শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এরা মুখে জয়বাংলা বলে ঠিকই, কিন্তু অন্তরে দুনম্বরি ছাড়া, অসততা ছাড়া আর কিছু নেই। এই চেতনা ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এমন এক সংস্কৃতি চালু করেছে, যেখানে আদর্শিক কর্মীর কোনো স্থান নেই। এই অপরাজনীতিকরা নিজেদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শনে সক্ষম মেরুদণ্ডহীন কিছু মানুষকে নিয়ে কোটারি করে দল এবং সরকার থেকে বড় কিছু বাগিয়ে নেয়ার ধান্দায় থাকেন। দল ভারী করতে এই অপরাজনীতিকগণ নিম্নরুচির কর্মীদের প্রশ্রয় দেয়, নিজেদের দিকে টানেন। প্রভাবশালীর আশ্রয়ে এই বখাটেরা রাস্তাঘাটে, ঘরে-বাড়িতে, সরকারি-বেসরকারি নানা অফিসে বেপরোয়া হয়ে উঠে। এরা চাঁদাবাজি করে, মাস্তানি করে, টেণ্ডারবাজি করে, অন্যের জমি দখল করে, ঘুষ, বদলি বাণিজ্য করে কালো টাকার মালিক হয়। এরা ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে, টং দোকান থেকে, ফেরিওয়ালা থেকে চাঁদা নেয়। এরা যে রাস্তায় মেয়েদের উপর অত্যাচার করবে না, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনা।

অদিতি বৈরাগী নামের মেয়েটি সেদিন রাস্তায় নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেসবুকে লিখেছিল। বার বার ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান নেতা-কর্মীরাও সন্দেহ করে লিখেছে, এ ধরনের ফেসবুক পোস্ট কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না? এমন সন্দেহ অমূলক কিছু নয়। জামাত-বিএনপির অন্যতম রাজনৈতিক কৌশল হল, নানা বিষয়ে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। যাইহোক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বিষয়টি ক্লিয়ার করেছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন, বাংলামোটরে মেয়েটির উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, বাংলা মোটরের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরাও বলতে চাই, ব্যবস্থা নিতে না পারলে সমাজ টিকবে না। বখাটে আর সন্ত্রাসীদের কবলে সমাজ চলে গেলে, ভালো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। সেদিন মেয়েটির সাথে এতটাই বর্বর আচরণ করা হয়েছে যে, সে লিখেছে-‘এই শুয়োরের দেশে সে থাকবে না’।

আমরা আসলে কী চাই? আমরা নিশ্চয় চাই এই বখাটেগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক? যদি আমরা তাই চাই, তাহলে এখানে কোনো অপরাজনীতি কাম্য নয়। সাত মার্চের দিনে ঢাকায় ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার সাথে আদর্শিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ বা জয়বাংলার কোনো সম্পর্ক নেই। জয় বাংলার আদর্শ যদি কারও ভেতরে থাকে, তাহলে সেই মানুষ হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোকিত। অথচ আজ কিছু কুলাঙ্গারের জন্য স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের বীর যোদ্ধাদের শক্তির আধার ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে কলঙ্ক দেয়ার পাঁয়তারা করার সুযোগ পেয়েছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগ যেন কেউ আর সৃষ্টি করতে না পারে কিংবা বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি যেন এই সুযোগ আর না পেতে পারে সেইজন্যই সরকারের তরফ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে অপরাধীদের ধরে ফেলতে হবে। আইনের হাতে তুলে দিতে হবে এই নারী নির্যাতনকারীদের।

দলীয় প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে যদি সমাজের দিকে তাকাই, তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় সকলকে নিতে হবে, পুরুষতন্ত্রকে নিতে হবে। নারী এদেশের কোথায় নির্যাতিত হয় না বলুন। ফুটপাতে, বাসের ভেতরে, বৈশাখী মেলায়, কনসার্টে, ঘরের ভেতরে, অফিসে, সর্বক্ষেত্রে নারী নির্যাতিত। পরিবারে নিজের চাচা/মামার দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার মত ঘটনাও ঘটে। বাংলাদেশে কেন, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মত উন্নত দেশেও নারী নির্যাতনের প্রচুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব উদাহরণ দিয়ে, ঢাকার পরিস্থিতির কষ্ট বোঝানো যাবে না। ঢাকা চরম অরাজকতার শহর। এই শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। দুই কোটি মানুষ থাকে এই শহরে। এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়নি, হাতে গোনা কিছু পাবলিক বাস, তাও ভাঙাচোরা। ব্যক্তিগত গাড়িওয়ালা ছাড়া বাকিদের অবস্থা খুবই করুণ।

বিষয় যদি হয় বাংলাদেশে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে নিজের কাছেই নিজেকে অদ্ভুত ঠেকে। এদেশের পুরুষ সমাজের বড় একটা অংশ নারীর প্রতি যে বিশ্রী চাহনি দিয়ে থাকেন, সেটি বিশ্বের খুব বেশী অঞ্চলে দেখা যায় না। যদিও পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে ধর্ষণের হার বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। কিন্তু এদেশে নারীর প্রতি পুরুষ সমাজের একাংশের দৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই নিম্নরুচির যে, এর থেকে উত্তরণে কত বছর লাগবে সেটি ভাবতে গেলে অথৈ সাগরে ভাসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মেয়ে দেখলেই তাঁর শরীর দেখার চেষ্টা করা, ভিড়ের মধ্যে কৌশলে গায়ে হাত দেয়া, শিস বাজানো, নোংরা মন্তব্য করা এগুলো এদেশের হরহামেশা ঘটনা। ঘর থেকে বের হলে নারী সারাক্ষণ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে।

অদ্ভুত এক সমাজ এখানে তৈরি হয়েছে। একদিকে বকধার্মিকে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে যৌনতা-সর্বস্ব তথাকথিত স্মার্ট কালচার চর্চাকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। নারীকে শুধু যৌনতা আর গুনাহর ডিসকোর্সে বর্ণনা ও কল্পনা করা হচ্ছে। বকধার্মিকের দল নারীকে ঘরে বন্দি রেখে, পর্দার নামে নারীর সমস্ত শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়ে, নারীকে অবরোধবাসিনী বানিয়ে রেখে সমাজের অর্ধকে কর্মশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ওয়াজ-মাহফিলে পুরুষকে শেখানো হচ্ছে নারী গুনাহের উপাদান। সমস্ত গুনাহ যেন নারীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অন্যদিকে আরেক দল আধুনিক হতে গিয়ে আগ-পিছ না ভেবে পশ্চিম এবং বলিউডকে অনুসরণ করে নোংরামি শিখছে এবং করছে। বনানীর হোটেলে নারী ধর্ষণ এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হতে পারে। এমনকি এ পর্যন্ত দেশে যত জঙ্গি ধরা পড়েছে, তাদের বেশীরভাগই হয় মাদ্রাসার, নয় ইংলিশ মিডিয়াম থেকে পাশ করা। আবার এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশ ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপির প্রভাবে দিন দিন মৌলবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সব মিলে একটি আদর্শবান জাতিগঠনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।

নারী হোক, পুরুষ হোক সকলের অধিকার আছে রাস্তাঘাটে নিরাপদে চলাফেরা করার। তবে বাংলাদেশে নারী যত অনিরাপদ, পুরুষ তত নয়। চূড়ান্তভাবে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেদিন রাস্তায় অদিতি নামের মেয়েটিকে হায়েনাদের কবল থেকে উদ্ধার করেছে এক পুলিশ অফিসার। উদ্ধার করে একটি বাসে উঠিয়ে দিয়েছে বলে অদিতি তাঁর ফেসবুকে জানিয়েছে। কিন্তু আক্রান্তকে উদ্ধার করাই শুধু পুলিশের কাজ নয়, আক্রমণকারীকে গ্রেপ্তার করে আইনের কাছে সোপর্দ করা পুলিশের আরও বড় দায়িত্ব। সরকার যদি মনে করে, মানুষ এগুলো ভুলে যাবে, তাহলে ভুল করবে। মানুষ কিছুই ভুলেনা, বিশেষ করে বছরটি যখন হয় নির্বাচনের।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :