গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হারালে করণীয়

মো. সাব্বির রহমান
 | প্রকাশিত : ০৯ মার্চ ২০১৮, ১৫:১৯

আমার সবাই চেষ্টা করি নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র/সার্টিফিকেটগুলো যত্ন করে রাখতে। কিন্তু অসাবধানতাবশত অনেক সময় আপনার গুরুত্বপূর্ণ কোনো জরুরি কাগজপত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পরিচয়পত্র, অন্যান্য দরকারি নথি, পাসপোর্ট, চেকবই, লাইসেন্স, মূল্যবান রশিদ, স্বর্ণালঙ্কার, নগদ অর্থ, গুরুত্বপূর্ণ কোন সার্টিফিকেট, এটিএম বা ক্রেডিট কাড, মোবাইল ফোনের সিম, জমির দলিল, অন্যান্য দলিল প্রভৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন। হারিয়ে ফেলা জিনিস যদি গুরুত্বপূর্ণ না হয় তাহলে পুনরায় খুঁজে পাওয়ার জন্য অনেকের প্রচেষ্টা থাকে না। কিন্তু এই বিষয়ে আইনগত সহায়তা না নিলে জীবনে চলার পথে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় আপনি মিথ্যা মামলা মোকদ্দমার আসামি কিংবা কোনো অনাকাঙিক্ষত বিপদের মুখোমুখি হতে পারেন। যেকোনো জরুরি ডকুমেন্ট হারালে তা পাওয়ার জন্য আপনাকে কয়েকটি কাজ করতে হবে। এই হারানো কাগজ ফিরে পাওয়ার জন্য বা কাগজের নকল সংগ্রহ করার জন্য পুলিশের সাহায্য নেয়া যাবে। কাগজপত্র হারিয়ে গেলে অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে জিডি করতে হবে। জিডি করার পর পুলিশ অভিযোগকারীকে জিডির একটা নম্বর সরবরাহ করবেন। এরপর পুলিশ হারিয়ে যাওয়া কাগজ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন অথবা নকল বা নতুন কাগজপত্র বা দলিল প্রদান করার জন্য অনুমতি প্রদান করবেন। তবে ধাপে ধাপে যদি আপনি কাজগুলো করেন তবে সেটি বুঝতে সুবিধা হবে।

প্রাথমিক পদক্ষেপ (সাধারণ ডায়েরি করা)

উপরোক্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সমুহের যেকোনো একটি হারালে আপনাকে সর্বপ্রথম থানায় জিডি করতে হবে। জরুরি কোনো ডকুমেন্ট হারানো গেলে কোনো রকমের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যদি থাকে তা হলে তাৎক্ষণিক থানায় লিখিত আকারে জানালে পুলিশ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা থাকলে কিংবা কোনো ধরনের অপরাধের আশঙ্কা থাকলে, কোনো রকমের অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যদি থাকে তা হলে থানায় লিখিত আকারে জানালে পুলিশ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য জিডি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক সময় আদালতেও জিডিকে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিডি করার অর্থ হলো সমস্যার বিষয়ে থানাকে অবগত করা। যাতে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। জিডি করার পর পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। প্রয়োজনবোধে তদন্ত করা, নিরাপত্তা দেয়া ছাড়াও জিডির বিষয়টি মামলাযোগ্য হলে পুলিশ মামলা করে থাকে। হারানো জিনিস খুঁজে পেতেও আপনার জিডি সহায়ক হয়ে ওঠে পুলিশের জন্য। আইনি সহায়তার জন্য জিডি খুবই কার্যকর একটি পদক্ষেপ। ওই সব কাগজপত্র পুনরায় তুলতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হারানো সংবাদের জিডি চেয়ে থাকে, তাই ওইসব ক্ষেত্রে হারানো সংবাদের জিডি করে সেই জিডি নম্বরসহ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। জিডিতে হারানো ডকুমেন্টের/সার্টিফিকেট এর বিস্তারিত বর্ণনা সম্বলিত তথ্য জিডিতে উল্লেখ থাকতে হবে। আপনার ডকুমেন্টটি যে স্থানে হারিয়েছে সে স্থানের নিকটবর্তী থানায় জিডি করবেন এবং থানার ডিউটি অফিসারের স্বাক্ষর, সিল ও জিডি নাম্বার সম্বলিত জিডির কপি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করুন।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ (পত্রিকায় বিজ্ঞাপন)

হারানো ডকুমেন্ট যদি খুব জরুরি ডকুমেন্ট হয়; তবে হারানো ডকুমেন্ট ফেরত পাওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য আপনাকে আপনার হারানো ডকুমেন্ট এর বিস্তারিত বর্ণনা সম্বলিত তথ্য এবং জিডি নাম্বার নিয়ে পত্রিকা অফিসে যেতে হবে।

সর্বশেষ পদক্ষেপ (ডুপ্লিকেট কপি উত্তোলন)

হারানো ডকুমেন্ট খোঁজ করে না পাওয়া যায়; তবে নকল বা নতুন কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হলে আপনার কাজ হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আবেদন করে তা সংগ্রহ করা।

ধরুন আপনি পাসপোর্ট হারিয়েছেন। নতুন পাসপোর্টের জন্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরে আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে জিডির মূল কপি, একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও একটি স্ট্যাম্প সাইজ ছবি। হারানো পাসপোর্টের ফটোকপি সঙ্গে দিতে পারলে ভালো হয়। সে কারণে সব সময় পাসপোর্ট কিছু ফটোকপি এবং নাম্বারসহ অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করা ভালো। জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট পেতে চাইলে ৬০০০ টাকা নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে। পাসপোর্টের সাধারণ ফি ৩০০০ টাকা। এ ফি জমা দিলে পাসপোর্ট পেতে সময় লাগবে ৭ দিন। উভয় ক্ষেত্রে পুরনো রেকর্ড অথবা পুলিশি প্রতিবেদন পর্যালোচনা সাপেক্ষে পাসপোর্ট ইস্যু করা হবে। তাই এসব তথ্য ও পুলিশি প্রতিবেদন সংক্রান্ত জটিলতায় পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হতে পারে। তবে একটু আধটু বিলম্ব হলেও আপনার সবকিছু ঠিক থাকলে দ্রুতই পেয়ে যাবেন আপনার কাঙিক্ষত পাসপোর্ট।

ধরুন আপনি শিক্ষাগত যোগ্যতার বোর্ড কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট হারিয়েছেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে আপনাকে আবেদনপত্র বা ফরম সংগ্রহ করতে হবে। আপনার প্রয়োজনীয় ফরম ডাউনলোড করে নিতে পারেন সরকারি ওয়েব সাইট থেকে। আবেদন ফরম সংগ্রহ করার পর এখন কাজ তা যথাযথভাবে পূরণ করা। পূরণ করার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বাক্ষর নিয়ে আসতে হবে। তারপর বোর্ড কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ফি সোনালী ব্যাংকে বা উল্লেখিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে। জমা দেয়ার কপি সংশ্লিষ্ট স্থানে এবং অপর কপি আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। সঙ্গে হারানো ডকুমেন্টস এর ফটোকপি এবং পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও থানার জিডির মেইন কপিও থাকতে হবে। নির্ধারিত ফি এর জমা দেয়ার রশিদসহ সকল কাগজপত্র জমা দিলেই আপনার কাজ শেষ। এখন আপনার কাজ শেষ কিছুদিন অপেক্ষা করুন। মাসখানের এর মধ্যে আপনি আপনার কাঙিক্ষত ডকুমেন্টস পেয়ে যাবেন। আপনি চাইলে বাড়তি ফি দিয়ে জরুরিভাবেও আপনার ডকুমেন্ট ১-৭ দিনের মধ্যে উঠাতে পারবেন।

ধরুন আপনি মোটরসাইকেলের কাগজপত্র হারিয়েছেন। মোটরসাইকেলটি যে বিআরটিএ অফিসে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে, সেই বিআরটিএ তে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটের ডুপ্লিকেট কপির জন্য আবেদন করতে হবে। নির্দিষ্ট বিআরটিএ ব্যতীত অন্য বিআরটিএতে আবেদন করা যাবে না। বিআরটিএ থেকে ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন ফর্ম, মালিকানা স্বাক্ষর ফর্ম এবং মানি ডিপোজিট ফর্ম সংগ্রহ করতে হবে। ফর্মগুলো বাইক এবং মালিকের তথ্যসমূহ দিয়ে সম্পূর্ণ ফিলআপ করতে হবে। এরপরে বিআরটিএ এর কর্মকর্তার কাছ থেকে মানি ডিপোজিট ফর্মে নির্দিষ্ট পরিমাণের ফি মার্ক করে নিতে হবে। এরপরে নির্দিষ্ট ব্যাংকে বা বুথে টাকা জমা দিয়ে মানি ডিপোজিট স্লিপ সংগ্রহ করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটের ডুপ্লিকেট কপির জন্য টাকা জমা দেয়ার সময় মালিককে হয়তো আরো কিছুটা টাকা জমা দিতে হতে পারে যদি তার কোনোপ্রকার বকেয়া টাকা বা জরিমানা থাকে। সাধারণত পুরনো মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বেশি ঘটে যেগুলোতে কাগজের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট রয়েছে এবং ডিজিটাল নাম্বারপ্লেট নেই। বর্তমানে সকলের জন্য স্মার্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট কার্ড এবং ডিজিটাল নাম্বার প্লেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে, পুরনো মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এসকল খরচগুলো বকেয়া অর্থাৎ ডিউ শো করা হয়। তাই, টাকা ডিপোজিট করার সময় যদি এরকম কোনো বকেয়া দেখায় তবে সেগুলো পরিশোধ করে দিতে হবে এবং ডিপোজিট ফর্মে সঠিকভাবে সকল ফি চিহ্নিত করে নিতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বাইকারকে নির্দিষ্ট ট্রাফিক অফিস থেকে ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহ করতে হবে। তারা তখনই ক্লিয়ারেন্স দেবে যদি বাইকের কোনো ট্রাফিক সম্পর্কিত কেসে কোনোপ্রকার বকেয়া না থাকে। এরপরে জিডির কপি, ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্স এবং ব্যাংক ডিপোজিট কপি নিয়ে পেপারগুলো বিআরটিএতে দাখিল করতে হবে। দাখিল করার দরখাস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাগজের বিবরণ নিচে দেয়া হলো।

মোটরসাইকেলের ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য নি¤েœাক্তভাবে সকল কাগজপত্র সাজিয়ে জমা দিতে হবে

সম্পূর্ণভাবে পূরণকৃত ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম

১. সম্পূর্ণভাবে পূরনকৃত মালিকানা ফর্ম

২. মোটরসাইকেলের মালিকের ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি

৩. টাকা জমা দেয়ার স্লিপ

৪. জিডি এর কপি

৫. ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্স কপি

৬. যদি সম্ভব হয়, ট্যাক্স টোকেন এবং রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটের ফটোকপি

এরপরে এ সকল কাগজপত্র একত্রিত করে বিআরটিএ এর কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। কাগজপত্র জমা দেবার পর নির্দিষ্ট সময় পরে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে যোগাযোগ করবেন এবং মেসেজেই পরবর্তী বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হবে। ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট এবং ডিজিটাল নাম্বার প্লেটের ক্ষেত্রে সকল কার্যক্রমের জন্য আলাদা আলাদাভাবে যোগাযোগ করা হবে। বিআরটিএ সকল আপডেট এবং নির্দেশনা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে দিয়ে থাকে, তাই কোনোপ্রকার চিন্তা না করে মেসেজ এর অপেক্ষায় থাকুন নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করুন।

জনসচেতনায়- মো. সাব্বির রহমান

পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত), বাঞ্ছারামপুর মডেল থানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :