গণজাগরণ মঞ্চ ও ক্ষয়িষ্ণু আবেদনের আন্দোলন

তারেক হাসান
 | প্রকাশিত : ১০ মার্চ ২০১৮, ১৯:৩৫

অনেকে মনে করেন ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে শাহবাগকে কেন্দ্র করে পূর্বে মৎস ভবন, পশ্চিমে কাঁটাবন, দক্ষিণে টিএসসি, উত্তরে শেরাটন পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল- সে লোকগুলো ইমরান এইচ সরকারের ডাকে এসেছিল। আসলে কি তাই? যাকে চেনে না তার ডাকে প্লাবণের মতো মানুষ আসবে কেন?

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মানুষ এসেছিল মূলত কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড না হওয়াকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ জানাতে। সেদিন ছুটির দিন ছিল না, ছিল মঙ্গলবার।

তখন ‘গণজারণ মঞ্চ’ বলতে কিছু ছিল না। ‘অনলাইন এক্টিভিস্ট ফোরাম’ নামে একটা কিছুর অস্তিত্ব ছিল। সেটা সম্পর্কেও মানুষ জানত না। সুতরাং তাদের ডাকে এত লোক জড়ো হওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রথম শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩) কয়েক লাখ লোক হয়েছিল।

যেহেতু ঘটনাটা মাত্র পাঁচ বছর আগের সুতরাং এটার প্রত্যক্ষদর্শীদের সবাই তো আর মারা যাননি; এবং সে সময়কার পত্রপত্রিকাগুলোও সব বালু হয়ে যায়নি। গণজোয়ারের প্রথম কয়দিন একটি মাত্র মঞ্চ ছিল না। জনসমুদ্রে দ্বীপের মত অনেকগুলো আয়োজন- অংকন, পথনাটক, গান, আবৃত্তি চলছিল।

৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার- মানে মানববন্ধন থেকে জনসমুদ্র হওয়ার পর- মাঝবরাবর একটি মাইকওয়ালা মঞ্চ থেকে ঘোষিত হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে একটা সংগঠনের জন্ম হয়েছে, এর মুখপাত্র- ইমরান এইচ সরকার। পরে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে সমাবেশ চলে কয়েক মাস।

লেবু বেশি চিপলে যেমন তেতো হয়ে যায়, একটি সম্ভাবনাময়, কিছুটা ফলপ্রসূ গণআন্দোলনকে বিরক্তিকর করে তুলল ‘গণজাগরণ মঞ্চ’।

নব্বইর দশকের শুরুর দিকে আত্মস্বীকৃত বাংলাদেশবিরোধীদের একজন গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ঘোষণা করা হয়। তখনও গোলাম আযম পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন।

গোলাম আযম বাংলাদেশে আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। তখন থেকেই তার বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করে আসছিল স্বাধীনতার পক্ষের মানুষরা, বিশেষ করে একাত্তরের শহীদ পরিবারের সদস্যরা। সত্তর ও আশির দশকের সর্বাধিক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকাগুলো (স্বাধীনতাবিরোধী মাওলানা মান্নানের ‘ইনকিলাব’ ও জামায়াতের মুখপাত্র ‘সংগ্রাম’ বাদে) কিছুদিন পরপর রিপোর্ট করতো গোলাম আযম ও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে। মানে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বুদ্ধবৃত্তিক প্রতিরোধের চেষ্টা চলমান ছিল।

৯২ সালে গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণআন্দোলন তীব্র হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা, শহীদ পরিবারের লোকজন গঠন করেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। তাঁরা জাহানারা ইমামকে এর নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন।

জাহানারা ইমামের ছেলে একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন। লেখক, অনুবাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ষাটের দশক থেকেই ছিল। সোজা কথা এমন একটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মতো ব্যক্তি তিনি ছিলেন।

ইমরান এইচ সরকারের কি এমন জন-আবেদন আছে? কেন তাকে যে কোন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে! শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মেয়েকে ইমরান এইচ সরকারের বিয়ে করা গণজাগরণ মঞ্চের আবেদনকে তলানীতে নিয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়। বিভিন্ন অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্দোলনে তাঁর নামতে ‘বাধ্য’ হওয়া ও এজন্য তার প্রতি বেশি মিডিয়া ফোকাসিং আমাদের বুদ্ধিজীবীকেন্দ্রিক আন্দোলনের দৈন্যই প্রকাশ করে, আরও দুর্বল করে দেয় বটে।

লেখক: ব্যাংকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :