মহান মুশফিক...

প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০১৮, ১৮:৪০

তায়েব মিল্লাত হোসেন

বহুল আলোচিত ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত ক্রিকেটে ভাষ্য দিতে গিয়ে উইকেটে থিতু ব্যাটসম্যান প্রসঙ্গে প্রায়ই একটা উপমা টানেন- ‘ব্যাটসম্যান বলটিকে এখন ফুটবলের মতো দেখছেন।’ এ কালের প্রজন্ম এ নিয়ে হাস্যরস করে অন্তর্জালের দুনিয়ায়। এই দলে আমিও ছিলাম। গতকালের আগেও বলতে হতো আছি। কিন্তু বিদায়ী রাতে মুশফিকুর রহিম যেভাবে বলটাকে নিয়ে ব্যাট দিয়ে খেললেন- তিনি যেন ক্রিকেট বলটাকে ফুটবলের মতোই দেখছিলেন। ইচ্ছেমতো মারছিলেন। লাগছিল ঠিক জায়গায়। চাহিদা মতো হচ্ছিল ছয়-চার। আর তাতেই অবিস্মরণীয় এক জয়ের দেখা পেল টাইগার বাহিনী। কুড়ি-বিশ ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন একটি চূড়ায় উঠে গেল বাংলাদেশ। আর জীবনের সেরা একটি ইনিংস খেলে ফেললেন মুশফিকুর রহিম।

গত কয়েক বছরে ছন্দে থাকা দলটা হঠাৎই কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে পড়ল। অতি বাণিজ্যিক প্রবণতার হাতছানিতে অনেকটা অশোভন ভঙ্গিতে প্রধান কোচের পদ থেকে বিদায় নিলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। নাম লেখালেন শ্রীলঙ্কায়। সেই দলটিই আবার এলো ঢাকা সফরে। তিনি জাতির প্রতিযোগিতা। তারপর আবার দিপক্ষীয় লড়াই। তার কিছুকাল আগেই লঙ্কার মাটিতে সিংহ বাহিনীকে কুপোকাত করে এসেছে টাইগাররা। সেই পরাক্রমেই শুরুটা হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জয় থেকে দুরে সরে যায় মাশরাফি-মুশফিকরা। আর গত কয়েক বছরের ধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা বাংলার জমিনে উড়ায় বিজয় পতাকা। আগে স্বীকার না করলেও বিদায়বেলায় হাথুরু বাতলে যান সাফল্যের বটিকা। আসলে নিকট অতীতে বাংলাদেশের কোচ থাকার কারণেই হাতের তালের মতো চেনা ছিল প্রতিপক্ষ। সেভাবে সাজিয়ে ছিলেন মারণাস্ত্র। তাতেই করেছেন বাজিমাত।

রাবণের দেশের এই পরাক্রম লাল-সবুজের ক্রিকেট বিবর্ণ করে দেয়। চারিদিকে কেবলি হা-হুতাশ। দলের পতনে যেন আমাদের সমস্ত সুড়ঙ্গের শেষ আলোটুকুও হারিয়ে গেছে। এমনি একটি সময়ে আহত সাকিব আল হাসানের বদলে মাহমুদুল্লাহর বাহিনী হয়ে লঙ্কায় যায় টাইগাররা। নৈরাশ্য নিয়েই তিনজাতির কুড়ি-বিশ ক্রিকেটের জন্য ছোটপর্দায় চোখ রাখে ভক্তকূল। প্রথম ম্যাচে আচমকা নয়, স্বপ্নবিহীন বাস্তবতার মতোই পরাজয়ের দেখা। বিনা যুদ্ধেই ভারতকে সব দিয়ে দেয় আমাদের ক্রিকেটাররা। পরাক্রম হতে থাকা বাঘ বুঝি বেড়ালই বনে গেল! তা আরো স্পষ্ট হতে থাকে গতকাল প্রথম ধাপে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের সময়। যেনবা পাড়ার ক্রিকেটে নেমে এসেছে তাসকিন আহমেদদের বলের মান। চার-ছয়ের মার তো খাচ্ছেই। পর পর চলছে ওয়াইড-নো। এই করে করে শ্রীলঙ্কা খুদে সংস্করণে বড় রান তুলে ফেলে। বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২১৫ রান। পরাজয়ের বৃত্ত থাকা একটি দলের জন্য তা ৩০০-৪০০ রানের পাহাড়ের মতোই হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু টাইগারদেরও তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। হারলেই আগেভাগে প্রতিযোগিতা থেকে বিদায়। আর চারিদিকে সমালোচনা আর সমালোচনা তো চলছে গত কয়েক মাস ধরেই। সবকিছুর জবাব দিতে হবে। দাঁত ভাঙ্গা জবাব। দারুণ এক মঞ্চই বেছে নিলেন তামিম-লিটন। উদ্বোধনীতে গড়ে দিয়ে গেলেন মজবুত এক ভিত্তি। তার উপর দাঁড়িয়ে তরবারির মতোই ব্যাট চালালেন মুশফিক। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। পিনপতন নিরবতা নেমে এলো স্বাগতিকদের গ্যালারিতে গ্যালারিতে। কলম্বোয় যেন শোকগ্রস্থ একটি রজনী। তবু আমাদের স্নায়ুচাপ কমছে না। আমাদের মনে পড়ে যায়, ঢাকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপের ফাইনাল; গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে প্রায় জেতা ম্যাচে হারার দাগ। সেই দুই শোকের দিনেও তো পতনোন্মুখ মহানায়ক আমাদের মুশফিকই। সেই সব দিনে তার কান্না আজো যে আমরা ভুলতে পারি না। এবার কোনো ভুল নয়। জয়সূচক রানখানিও এলো তারই ব্যাট থেকে। এরপর লড়াকু উদযাপন। দুই হাতে ফণা তুলে নাগিনের মতো নাচ মুশফিকের। নম্র-ভদ্র-মেধাবী ছেলেটির আবেগের সব বাধ যেন ভেঙ্গে গেল লহমায়। হেসে উঠলো পুরো বাংলাদেশ। ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাতের অতি নাটকীয় স্তুতিতেই ফিরতে হচ্ছে আমাদের, ‘বাংলাদেশের টেকনিক্যালি সবচেয়ে সাউন্ড ব্যাটসমান এই মুশফিকুর রহিম!’

তায়েব মিল্লাত হোসেন: সাংবাদিক