নবায়নযোগ্য জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

প্রকাশ | ১২ মার্চ ২০১৮, ১০:২৬ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৮, ১০:৩৭

সঞ্জয় দে

তেল, কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির পর বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা ক্লিন এনার্জির যে অধ্যায় শুরু হচ্ছে তার দখল কার হাতে থাকবে তা নিয়ে প্রায় দেড় দশক ধরে চলছে বিভিন্ন মেরুকরণ। শুরুতে জার্মানির একচেটিয়া যে ব্যবসা পরিকল্পনা তাতে পরে ভাগ বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন। এই লড়াইয়ে সবশেষ সংযুক্তি ভারতের।

২০১৫ সালের নভেম্বরে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সময়েই নতুন একটি জোটের রূপরেখা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই মাসেই মরক্কোতে ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স- আইএসএ নামের জোটের রূপরেখায় সম্মতি দেয় ১২১টি দেশ। এই জোটের নেতৃত্ব ভারতের হাতে, সদরদপ্তর ভারতের হায়দরাবাদের গুরুগ্রামে।

গ্রীষ্মপ্রধান ১২১টি দেশ, যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময়ে সূর্যালোকের প্রাচুর্য রয়েছে তারাই এই নতুন জোটের রূপরেখায় সম্মতি দিয়েছে। তবে এসব দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সমর্থন বা এতে সই করেছে সব মিলিয়ে ৬২ দেশ। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ, ভারত, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কমরোস, কিউবা, ফিজি, ঘানা, মালাউয়ি, নাউরু, নাইজার, পেরু, সোমালিয়া, সাউথ সুদান, তুভালু, ব্রাজিল, ক্যাম্বোডিয়া, চিলি, ডমেনিকান রিপাবলিক অফ কঙ্গো, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, আরব আমিরাত ও ভেনিজুয়েলা।

মজার বিষয় হলো, শুরুর দিকের ১২১টি দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থাকলেও বিভিন্ন শর্ত দিয়ে দেশ দুটি এখনো এই জোটের চুক্তিতে সই করেনি। আর ক্লিন এনার্জির বিশ্ব অধিপতি জার্মানিও যোগ দেয়নি এই জোটে।

আইএসএর প্রথম শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে রবিবার নয়াদিল্লিতে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদসহ ২৩টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং আরও ১০টি দেশের মন্ত্রীরা যোগ দেন এই সম্মেলনে। সম্মেলনের সহ-আয়োজক ছিল ফ্রান্স। সেখানে গৃহীত 'দিল্লি সোলার এজেন্ডা'য় বলা হয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ সদস্য দেশগুলোতে এক হাজার গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, আর এ জন্য বিনিয়োগ করা হবে এক ট্রিলিয়ন ডলার।

এই সম্মেলনে বিনিয়োগ ও সৌরপ্রযুক্তি বিস্তার ও উন্নয়নে ১০ দফা পরিকল্পনা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর অন্যতম হলো সাধারণ পর্যায়ে সৌর প্রযুক্তি অনেক বেশি সহজলভ্য করা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, সৌর প্রযুক্তির বিস্তার ও উন্নয়নে ঋণ সুবিধা দেবে ভারত। ইতোমধ্যে এ খাতে ভারতের নিজস্ব বরাদ্দ ১০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২ বিলিয়ন ডলার আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে দেয়ার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়েছে।

ঋণ সহায়তা (লাইন অফ ক্রেডিট) দিয়ে বিভিন্ন দেশে ক্লিন এনার্জির বাজার সম্প্রসারণের কৌশলটি মোদির নতুন কোনো উদ্ভাবন নয়। এটি বাংলাদেশের ক্লিন এনার্জির পক্ষে নিরন্তর প্রচারে ব্যস্ত অ্যাক্টিভিস্টদের অতি কাছের জার্মানি ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে একটানা করে যাচ্ছে। এ কাজ চীনও করছে, এমনকি ওবামার সময়ের যুক্তরাষ্ট্রও করেছে। ট্রাম্প বিজয়ী হয়ে দায়িত্ব নেয়ার ঠিক আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে বিদায়ী ওবামা প্রশাসন আফ্রিকা-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ খাতে ১১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের অনুমোদন দিয়েছিল। এর একটি অংশ এসেছিল বাংলাদেশেও। হোয়াইট হাউজ সে সময় খুব পরিষ্কারভাবে জানায়, বাংলাদেশে ক্লিন এনার্জির বাজার বাড়াতে চায় তারা। এ সংক্রান্ত প্রকল্প এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করার তথ্যও জানিয়েছিল হোয়াইট হাউজ।

ক্লিন এনার্জির বাজার ধরার প্রতিযোগিতায় ভারতের ঢুকে পড়াকে বাংলাদেশের ক্লিন এনার্জি অ্যাক্টিভিস্টরা কীভাবে নেবেন- সেটা বেশ চিত্তাকর্ষক বিষয়। এসব অ্যাক্টিভিস্টের বেশিরভাগ জার্মানিপন্থী, বাংলাদেশের জ্বালানি নীতি কী হবে সেটা তারা জার্মানিতে গিয়ে সেমিনার করে ঠিক করে আসেন। আর কিছু অংশ মার্কিন, বিশেষ করে সাবেক ওবামা সরকারের ভক্ত। যে কারণে কেরি ঢাকায় উড়ে এসে যেদিন ক্লিন এনার্জিকে বাংলাদেশের একমাত্র ভরসা বলে যান, সেদিনই তারা কাকতালীয়ভাবে প্রেসক্লাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপকারিতা ব্যাখ্যা করতে ব্যস্ত হন। আর চীনা নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা 'অন্যায়' বলেই হয়ত দেশেটির ঋণনীতি নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলার কথা তারা ভাবতেও পারেন না।

সব মিলিয়ে জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ওপর ভরসা করে এতদিন হয়ত অ্যাক্টিভিস্টরা নির্বিঘ্নে ক্লিন এনার্জির সোচ্চার সমর্থন ছিলেন। তবে এবার ভারতীয় পুঁজি এই নিস্তরঙ্গ জলাধারে কী তরঙ্গ জাগায়- তাই দেখার অপেক্ষা....

লেখক: সাংবাদিক