মিরপুরে আহাজারি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কান্না

প্রকাশ | ১২ মার্চ ২০১৮, ১২:৩৪ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৮, ১৪:১০

তানিম আহমেদ

মোহাম্মদ বোরহান, মিরপুর ১০ এর নান্নু মার্কেটে নৈশ প্রহরীর কাজ করেন। অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষটা তিল তিল করে সারা জীবনে যেটুকু সঞ্চয় করেছিলেন, এক রাতেই সব শেষ হয়ে গেছে।

মিরপুরে পুড়ে যাওয়া হারুনাবাদ এলাকায় পুড়ে যাওয়া তিনটি বস্তির মধ্যে একটি বস্তিতে ৫০ ঊর্ধ্ব বোরহান তার স্ত্রী, তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন, সেখানে গিয়েই ক্রন্দনরত অবস্থায় পাওয়া গেল তাকে।

১৯ বছর ধরে এই বস্তিতে আছেন বোরহান। সাত বছর আগে সঞ্চয়ের ৮০ হাজার টাকা দিয়ে দুটি ঘর কেনেন তিনি। ধাপে ধাপে কেনেন কিছু আসবাবপত্র আর নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু ঘরোয়া সরঞ্জাম। এর কিছুই বের করতে পারেননি তিনি।

রবিবার দিবাগত গভীর রাতে নান্নু মার্কেটে দায়িত্ব পালনের সময় বস্তিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে আসেন বোরহান। এসে দেখেন ঘরে যাওয়ার উপায় নেই। তার ছেলে মেয়েরা সবাই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেঁদে চলেছে। সন্তানদের সান্ত্বনা দেবেন কি, ডুকরে কান্না বের হয়ে আসে বোরহানেরও।

আগুন নেভার পর মায়ায় পরে বস্তির মধ্যখানে ঘরটিতে যান বোরহান। সেখানে গিয়ে পুরনো দিনের কথা ভেবে আবার কাঁদতে থাকেন তিনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠেই শ্রমজীবী মানুষটি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সব পুইড়া গেছে, কিছুই নাই, রাতে কই যামু, কী খামু, কিছুই জানি না।’

এই বস্তির পুড়ে যাওয়া তিন হাজার বাড়িঘরের প্রায় সবারই দশা একই রকম। সহায়তা না পেলে এই মানুষদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।

এই বস্তিতেই জন্ম আবদুর রাজ্জাকের। বয়স ১৬ কি ১৭। বাবার সঙ্গে ফুটপাতে ব্যবসা করেন। ঘরে থাকতে অসুবিধা বলে মসজিদে থাকেন।

সকালে রাজ্জাককেও দেখা গেল তার পুড়ে যাওয়া ঘরে বসে বিলাপ করতে। রাজ্জাক বলেন, ‘গত রাতে মসজিদে ঘুমাইছিলাম। তিনটার সময় এক পুলা জানায় আগুন লাগছে, আমি ছুইট্যা আসি। দেহি মা মা, ছোট বোন ঘরের বাইরে। আব্বায় পানি নিয়া রেডি, ঘরে আগুন লাগলে নিবাইব।’

‘লোকটা বুঝতে পারছিল না, এই আগুন নিবানো যাইব না। আমি জোর কইরা আব্বারে ঘরের বাইরে বাইর কইরা আনলাম। না অইলে আমার আব্বা বাঁচত না।’

দুটি কক্ষ ছিল রাজ্জাকদেরও। বস্তির কিনারে হওয়ায় কিছুটা সময় পেয়েছিলেন তার মা, বোনেরা। কাপড়চোপড় আর ছোটখাটো কিছু জিনিস তারা বাঁচাতে পেরেছিলেন এ কারণেই। কিন্তু খাট থেকে শুরু করে ঘরের বড় কোনো জিনিস বের করা যায়নি।

এখন জীবন আবার নতুন করে শুরু করতে হবে রাজ্জাকের। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব হবে সেটা জানা নেই তার। রাজ্জাক বলেন, ‘মেলা টেকার মামলা। কই পামু?’।

‘টেকা কই পামু’-এটা কেবল রাজ্জাকের না, বস্তির সব হারা হাজার হাজার মানুষের প্রশ্ন। আজ দুপুরে কী খাবে, রাতে কী খাবে, রাতে কোথায় ঘুমাবে? যারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত, তারা কীভাবে টাকা পরিশোধ করবে? যারা কোনোমতে ঘর তুলেছিল, তারা কীভাবে ঘর তুলবে?- কথা বলেই বিলাপ শোনা গেল বস্তির পাশে গিয়ে।

লিমা বেগম এই বস্তিতে আছেন প্রায় ২০ ধরে। তার স্বামী মো শামীম গার্ডের চাকরি করেন। অন্য অনেকের মতো লিমাও কিছু বের করতে পারেননি তার ঘর থেকে।

কাঁদতে কাঁদতে লিমা বলেন, ‘সব শেষ হয়া গেছে, সব শেষ, টেকা পয়সা নাই, কিছুই বাইর করতে পারি নাই। এহন কী হবে জানি না।’

লিমার দুর্দশার খবর শুনে তাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন স্বজনরা। তাদের বেশভুষাই বলে দেয়, জীবন চালাতে গিয়ে সংগ্রামে তারা নিজেরাও। এই অবস্থায় তারা লিমাকে কতটা সহায়তা করতে পারবেন, সেটাও নিশ্চিত নয়।

এর মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াছ মোল্লা তাৎক্ষণিক কিছু সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। দুপুরে এবং রাতে খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে জানিয়ে মাইকিং করিয়েছেন তিনি।

ঢাকাটাইমস/১২মার্চ/টিএ/ডব্লিউবি