‘চওক্ষে পুরা অন্ধকার’
মিরপুর ১২ নম্বরে আগুনে পোড়া বস্তিতে থাকতেন শাহিদা। একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তার স্বামীও পোশাক কারখানার শ্রমিক। দুই জনে মিলে কাজ করেন বলে ১১ বছরের ছেলেকে পাঠিয়েছেন বাড়িতে, দাদির কাছে।
দুই জনের আয়ে সংসার চালিয়ে, বাড়িতে টাকা পাঠিয়েও কিছু সম্পদ ও নগদ টাকা জমিয়েছিলেন শাহিদা।
পোশাক কারখানার ছুটির দিনও বিশ্রাম নিতেন না শাহিদা। জামা বানানোর কাজ করতে কিনেছিলেন দুটি সেলাই মেশিন। সব মিলিয়ে সন্তানের ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি।
এখন জীবনের কঠিনতম পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিনি। দুটো সেলাই মেশিন, ধীরে ধীরে জমানো নগদ ৯০ হাজার টাকা, গলার স্বর্ণের চেইন, দুই জোড়া কানের দুল আর আংটির কিছুই আনা হয়নি। পুরো মাসের জন্য যে বাজার করা হয়েছিল, তারও কিছুই বাঁচানো যায়নি।
ঘর হারা শাহিদার আশ্রয় হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার নির্মাণাধীন মোল্লা মার্কেটে। সেখানে গিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। চোখের কোনে টলমল করছে পানি। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বের হয়ে আসে পানির ধারা।
শাহিদা বলেন, ‘খালি জানডা নিয়া ঘর থেইক্যা বার হইছি ভাই। কিছুই আনতে পারি নাই।’
এখানে কতদিন থাকবেন-এমন প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্ন আসে শাহিদার। ‘এখন কই যামু? কোনো কাপড়চোপড় নাই, ভাত রান্না করার জিনিসপত্রও নাই, ঢাকায় কোন আত্মীয়স্বজনও নাই, চউক্ষে পুরাই অন্ধকার।’
এই বস্তির পুড়ে যাওয়া প্রায় তিন হাজার ঘরের সব বাসিন্দাদের জীবন যুদ্ধের কাহিনি মোটামুটি একই রকম। কেউ কাজ করেন পোশাক কারখানায়, কেউ বাসা বাড়িতে, কেউ দোকানে, কেউ মার্কেটে শ্রমিকের কাজ করতেন। আর শখ আহ্লাদ শিকেয় তুলে রেখে সবাই তিল তিল করে টাকা সঞ্চয় করে ভবিষ্যৎ গড়ার লড়াইয়ে ছিলেন।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন শেখ করে দিয়েছে আগুন। বরিবার দিবাগত মধ্য রাতের পর লাগা আগুনে ঘরের পাশাপাশি পুড়ে ছাই হয়ে যায় এত বছরের জমানো সঞ্চয়, স্বপ্ন আর ভবিষ্যত।
শরিফার বাড়ি নেত্রকোণার মদন উপজেলায়। একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন তিনি। স্বামী কাজ করেন দারোয়ানের। সংসারের অভাব ঘুঁচাতে তাদের পাশাপাশি দুটি ছেলেকেও দোকানে কাজ দিয়েছেন।
সব সম্পদ হারিয়ে মোল্লা মার্কেটে আশ্রয় হয়েছে শরিফা ও তার পরিবারের। দুপুর ও রাতে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা। ৩০ কেজি চাল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। আর্থিক সহায়তা দেয়ার কথাও বলে গেছেন একজন কর্মকর্তা।
শরিফা বলেন, ‘সব টেহা পয়সা পুইড়া গেছে। চাউল রাইন্দা যে খাইবাম, হাড়ি পাতিল নাই, চুলা নাই। কিনবাম যে টেহা পয়সা নাই্ ঘর তুলবাম কেমনে?’।
মোল্লা মার্কেটের নিচে কথা হলো মোহাম্মদ বারেকের সঙ্গে। তার বোন হাজেরা এই বস্তিতেই থাকেন। তার স্বামী মারা গেছেন, বাড়ি পিরোজপুর।
ছোট ছোট দুই ছেলে নিয়ে একটি ঘরে থাকতেন হাজেরা। সংসার চালানোর খরচ জোগাতে কাজ করতেন বাসা বাসিতে। কোনো মতে তিন বেলা খাবার জুটত তাদের। এই আগুন দরিদ্র এই নারীকে করে তুলেছে আরও নিঃস্ব।
আগুন লাগার পর এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন হাজেরা আর তার সন্তান। ‘এক কাপড়ে কয়দিন থাকা যায়?’- এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন।
‘আমরা তো বড় মানুষ, কষ্ট কইরা অভ্যাস আছে। ভাইগনা দুইটারে থামাই কেমনে কন? হেরা তো খালি কান্দে’-বারেকের মতো এমন প্রশ্ন এখন শত শত মানুষের।
ঢাকাটাইমস/১২মার্চ/টিএ/ডব্লিউবি