‘ত্রিভুবনকে খুব বিপজ্জনক বলা যাবে না’

জহির রায়হান, টাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৪ মার্চ ২০১৮, ১৮:৫৫

নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর সি ক্যাটাগরির হলেও তারা এখন অনেক উন্নতি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। তা ছাড়া পুরো নেপালই পাহাড়ি এলাকা, এটা মাথায় রেখেই উড়োজাহাজ চালান পাইলটরা। তাই ত্রিভুবন বিমানবন্দরকে খুব বেশি বিপজ্জনক বলা যাবে না।

নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার সময় টিভিতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ বিমানের প্রথম বৈমানিক আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক।

এহসান জুয়েলের সঞ্চালনায় ‘দুর্ঘটনার ঘটক কে’ শিরোনামের আলোচনায় আরও অংশ নেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার উইং কমান্ডার (অব.) আনিসুজ্জামান খান ও ভ্রমণবিষয়ক পাক্ষিক ম্যাগাজিন দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রশ্ন করেন, ‘আপনি (আলমগীর সাত্তার) এ ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিমান নিয়ে একধিকবার অবতরণ করেছেন। এখানে ৭০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৬৫০ জনের বেশি লোক মারা গেছে। আপনার অভিজ্ঞতা কী ছিল, কী ধরনের বাধা নেপালের এ বিমানবন্দরে রয়েছে?’

জবাবে আলমগীর সাত্তার জানান, তিনি ১৯৬৮ সালে ফ্লাইং শুরু করেন। তখন এফ২৭ বিমান নিয়ে যেতেন। রানওয়ে তখন ছোট ছিল। এখনকার মতো এত সুযোগ ছিল না বিমানবন্দরের। তিনি বলেন, ‘পাঁচ-ছয় বছর পর রানওয়ে বড় হয়, আমিও বোয়িং ৭০৭ এর পাইলট হলাম। তারপর ডিসি১০ বিমান নিয়ে গেলাম। ৩২ বছর ওখানে আমি ফ্লাইং করেছি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।’

কোন জায়গায় কতগুলো দুর্ঘটনা হয়েছে সেটার ফিগার কেন আনা হচ্ছে- এমন প্রশ্ন তুলে বৈমানিক আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘পুরো নেপালই হলো পাহাড়ি এলাকা, সেখানে বিপদ আছে। ওই বিমানবন্দর সি ক্যাটাগরির। তবে তারা অনেক উন্নতি করেছে। তারা সেকেন্ডারি রাডার লাগিয়েছে। এখন প্লেনে ট্রান্সপন্ডার কোড দিলে তারা জানে আমার পজিশন কী। আমার বিমানের ‍উচ্চতা কত, আমার গতিবেগ কত। এসব সুবিধার কারণে একে খুব বেশি বিপজ্জ্নক বলা চলবে না। এর চেয়ে বড় কথা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ফ্লাইং করলাম। একটাও দুর্ঘটনা হয়নি। আপনারা সেটাকে বিপজ্জনক বলছেন।’

এখনো বাংলাদেশ বিমানবন্দর ক্যাটাগরি দুইয়ে রয়েছে জানিয়ে বৈমানিক আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘ওদের সেকেন্ডারি ট্রান্সপন্ডার আমাদের চেয়ে অনেক আধুনিক। সেখানে তারা (ইউএস-বাংলা উড়োজাহাজকে) বলছে টু জিরোতে (২০) ল্যান্ড করতে। টু জিরো (২০) ও জিরো টু (০২) এখানে শুনতে সমস্যা হতে পারে। ও (পাইলট) অ্যাপ্রোচ করছে টু জিরো (২০)। আমরাও প্রেফার করি টু জিরো। প্লেনও ছোট। আমি ডিসি১০ প্লেন নিয়ে ওখানে ল্যান্ড করেছি।’

জিরো টু (০২) সম্পর্কে এই বৈমানিক বলেন, ‘জিরো টু সম্পর্কে আইডিয়া না থাকলে এখানে বসে কথা বলা যায় না। জিরো টুর চারদিকে আছে নয় হাজার ফুট রানওয়ে। ওখানে তিনি (পাইলট) একবার গো-রাউন্ড করেছে, সারকিলিং অ্যাপ্রোচ করেছে। তাকে বলা হয়েছে টু জিরো ব্যবহার করতে। সে মনে করছে আবার গো-রাউন্ড করব। একবার কিন্তু করেছে। ওখানে ল্যান্ড করতে হলে ৪০০ থেকে ৫০০ ফুটের মধ্যে এসে এলাইন করতে হয় রানওয়েতে। সেটা করতে হলে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যাং দিতে হয় টার্ন করতে গেলে। সে স্যালো টার্ন করলে আরও নিচে যাবে। এগুলো সব সম্ভাবনার কথা বলছি।’

এ সময় উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, পাইলটের প্রায় ৭০০ ঘণ্টা সেখানে ফ্লাইং করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর জবাবে আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘ওভার কনফিডেন্ট ভালো না। কো-পাইলট পৃথুলা (পৃথুলা রশীদ) মাত্র পাঁচ মাস আগে কো-পাইলট হয়েছে। সে যদি দেখে ক্যাপ্টেন ওভার ব্যাং করছে তাহলে সে সাহস পায় না হাত দিতে। যদি একজন সিনিয়র কো-পাইলট থাকত তাহলে কন্ট্রোল প্যানেল ধরত। বলত আগে আমার জান। আমি বলছি না এমনটাই হয়েছে, কিন্তু এমন ঘটনা ঘটে থাকলে? এ রকম একটা বাচ্চা মেয়েকে কো-পাইলট হিসেবে পাঠানো উচিত হয়নি।’

বৈমানিক আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘ইউএস বাংলার একটি সুনাম হয়েছে অল্প দিনে। তার জন্য তাদের সব কথাই মানতে হবে তা না। তারা বলছে ফ্লাইট অবতরণের সংকেত ওরা (নেপাল বিমানবন্দর) ভুল দিয়েছে। ইউএস বাংলা কি সিওর? আমরা কোনো অশঙ্কাকে উডিয়ে দিচ্ছি না, তবে বিধ্বস্ত বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে পাইলটের কথার রেকর্ড আছে, সেটার সঙ্গে মিলাতে হবে। তদন্ত কমিটি দেখবে।’ তবে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ক্রটি হয়েছে, তার কি তদন্ত প্রকাশ করেছে?’

৮ হাজর ৭০০ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামতে হয় উড়োজাহাজকে- স্মরণ করিয়ে দেন উপস্থাপক। জবাবে বৈমানিক আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘কে বলেছে এটা? কোন জায়গায় পাওয়া গেছে? আমি যখন যাই তখন সিমরা পাস ছোট জায়গা একটা ভিউওয়ার আছে। তার আগে আছে রোমিও একটা স্টেশন। সিমরা গিরিপথ দিয়ে আমরা নিচে নামছি। আমাকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই দূরত্বে তুমি নিচে নামতে পারো। স্টেপ ডাউন ফিক্সড যাবে বলে। যদি একান্ত ক্লাউডের জন্য দেখা না হয় তাহলে চলে আসো।’

এই পর‌্যায়ে ভ্রমণবিষয়ক পাক্ষিক ম্যাগাজিন দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশ বিমানে প্রসেস আছে জিরো টু (০২) প্রেফার করা। টু জিরো (২০) প্রেফার করার কথা বলা হলে ঢাকা চলে আসা।’ কিন্তু এর সঙ্গে দ্বিমত করে আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘কে বলেছে? আমি জিরো টু দিয়ে অনেক ল্যান্ড করেছি। আমাকে এমন ইনস্ট্রাকশন কেউ দেননি।’

ইনস্ট্রাকশন কে দেন বা কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে সাধারণত কে কথা বলেন- উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের জবাবে আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে পাইলট না কো-পাইলট- কে কথা বলবে এর ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কন্ট্রোল প্যানেল থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। তারা অনুরোধ করে না।’

গত ৩৪ বছরে ৩৫টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। ১৯৮৪ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৪৫ জনের। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন উপস্থাপক। তবে পরিসংখ্যান দিয়ে হবে না বলে মনে করেন আলমগীর সাত্তার। তিনি বলেন, ‘একটি বিমান দিয়ে অনেক ফ্লাইট পরিচালনা করি আমরা। আপনি ফ্লাইট কমান দুর্ঘটনা কমবে। আমরা পাঁচ-ছয়টি বিমান নিয়ে চলছি। আমাদের সেখানে তুলনা চলে না অন্য দেশের সঙ্গে। বিমানের সংখ্যা বাড়ালে দুর্ঘটনা এমনিতেই কমবে। তবে আমরা সেইফ না।’

এ পর‌্যায়ে আলোচনায় অংশ নেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার উইং কমান্ডার আনিসুজ্জামান খান। তিনি রানওয়ের সেট ও ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলেন। ‘বিশ্বে দুটি সেট অব রানওয়ে আছে- একটা টু জিরো ও জিরো টু; আর একটা হলো ওয়ান থ্রি ও থ্রি ওয়ান। এটা ডিজিট চেঞ্জ করলেই উল্টো হয়ে যায়। এ ধরনের নম্বর ব্যবহার না করতে বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা, যেহেতু এতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।’

আনিসুজ্জামান খান বলেন, ‘প্রতিটি রানওয়ের একটা মেইন রানওয়ে থাকে, যেখানে সুবিধা বেশি। এটা সব এয়ারক্রাফট বেশি প্রেফার করে। যেমন ঢাকাতে রানওয়ে ওয়ান ফোর (১৪), তেমনটি কাঠমান্ডুতে জিরো টু হলো প্রেফার রানওয়ে। ঢাকা থেকে বিমান গেলে সেখানে তার জন্য ল্যান্ড করার প্রেফারার হলো জিরো টু। পাইলটের সঙ্গে কী কথা হয়েছে সিগনালের সেটা জানি না, কিন্তু দেখা যায় এটি যখন ল্যান্ড করেছে তখন রানওয়েতে অন্য কোনো এয়ারক্রাফট ছিল না। সে টু জিরোতে (২০) ল্যান্ড করেছে। কিন্তু সেন্টার লাইনে সে যেতে পারেনি।’

প্রতিটি রানওয়ের একটা সেন্টার লাইন থাকে উল্লেখ করে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বলেন, ‘মনে করি একটা রানওয়ে ১৫০ ফুট চওড়া, তাহলে এর সেন্টার লাইন থাকে ৭৫ ফুটে। ল্যান্ডিংয়ের সময় ইউএস বাংলার বিমানটি সেন্টার লাইনে আসতে পারেনি। একটু ক্রস করে গেছে। কোনোমতে ওই দূরত্বে রানওয়েতে আসা সম্ভব নয়। এটা আমার মতে পাইলটের মিস ক্যালকুলেশন।’

এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘দুর্ঘটনা সারা বিশ্বেই হচ্ছে, থাই এয়ার ক্রাশ করেছে, তুরস্কের বিমান সেখানে দুর্ঘটনায় পড়েছে। এটা কী কারণে দুর্ঘটনায় পড়েছে সেটা তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার আগে বলা উচিত নয়। উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি আমাদের সেখানে গেছে।’ বিমানের ফিটনেস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সব ঠিক থাকলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়। এখানে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই। এই ইউএস বাংলার বিমানটি সেদিনই সকালে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে দুবার গিয়েছে। এরপর সেখানে গিয়েছে। এটা রানিং বিমান। এখানে টেকনিকাল সমস্যা থাকলে টাওয়ারকে জানাত পাইলট। আমার মনে হয় না এখানে ইঞ্জিনের ত্রুটি ছিল।’

উপস্থাপক মনে করিয়ে দেন, ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এই বিমানটিই সৈয়দপুরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পড়ে। জবাবে কাজী ওয়াহিদুল বলেন, এটার চাকা স্কিপ করেছিল। সেটা হতেই পারে। কিন্তু সেটা তো মেরামত করা হয়েছে। আর এসব দেখার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের। তারা সবকিছু ঠিক থাকলে অনুমতি দেয় উড্ডয়নের।

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জিরো টু (০২) হলো রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত, আর টু জিরো (২০) হলো উত্তর প্রান্ত।

গত সোমবার বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিচালনাকারী সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ওই বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়। এতে ৬৭ জন যাত্রী ও চারজন ক্রু ছিল, যাদের মধ্যে ৫০ জন মারা গেছে। দুর্ঘটনায় বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ও কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ এবং দুই কেবিন ক্রু শারমীন আক্তার নাবিলা ও খাজা হুসাইন এবং ২২ বাংলাদেশি যাত্রী নিহত হয়। আহত অবস্থায় নেপালের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরও ১০ বাংলাদেশি।

(ঢাকাটাইমস/১৪মার্চ/জেআর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :