স্বাধীনতার সংগ্রামীদেরও এভাবে অপদস্থ হতে হয়!

অনুপম মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ১৫ মার্চ ২০১৮, ১৭:৩৬

১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়েগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা চালু হয়েছিলো। পরে জেলাভিত্তিক, নারী, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা যোগ হয়। আর মুক্তিযোদ্ধা কোটার আওতা বাড়িয়ে সন্তান এবং নাতি-নাতনিদেরকেও ‍সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে।

সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা বর্তমানে বিদ্যমান। তবে কারও কারও ক্ষোভ ও প্রশ্নের তীর একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দিকে। তারা মুক্তিযোদ্ধা, যারা এই মুহূর্তে সত্যিই বড় দুর্লভ প্রজাতি।

পৃথিবীর আর কোন দেশে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের এতবার এবং এতভাবে অপদস্থ হতে হয়েছে বলে আমি জানি না। স্বধীনতার পরপর মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক পট পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা সংসদ সদস্য, মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন।

স্বাধীনতার ১৩ বছর পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৮৪ সালে উদ্যোগ নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যার সদস্য সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন। সেই সময় ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা হয়, যাতে সংখ্যা ছিলো ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন।

বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নির্বাচনকে সামনে রেখে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, এতে সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৬ হাজার। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দুই দফায় যাচাই বাছাই করে এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। বিএনপি সরকার (২০০১-২০০৬) ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই লক্ষ ১০ হাজার।

আওয়ামী লীগ সরকার আবার (২০০৯-২০১৪) ক্ষমতায় এলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লক্ষ ১৫ হাজার। আর গেরিলা যোদ্ধাদের নাম সংযোজন নিয়ে, বিশেষ করে বামপন্থী রাজনৈতিকদের একটি মামলা মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

সরকারের পালাবদলের সাথে সাথে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন হচ্ছে বারবার। আওয়ামী লীগ সরকার এখন তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছে। বলা হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় আগের সরকার অনিয়ম করেছে, এবার আমরা শুদ্ধ করব। ইতিমধ্যে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞা ও এই তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড করা হয়েছে ১০ বার।

জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল), সবুজ ও লাল মুক্তিবার্তা এবং প্রজ্ঞাপন ছাড়াও ভারত থেকে আসা নামের তালিকা আর বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী যথা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার বাহিনীতে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের নামের তালিকাই ভিত্তি ও উৎস।

এই মুহূর্তে আড়াই লাখ নতুন আবেদন বিবেচনার অপেক্ষায় আছে। কেউ কেউ এও বলেন, ১৯৭১ সালে সবাই যুদ্ধ করেছেন! তাহলে আর তালিকা করে লাভ কি? ত্রিশ লাখ লোক সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন অনেক গুণীজন! কেউ কেউ তো একধাপ এগিয়ে গুণে গুণে নাম ঠিকানাও জানতে চাইছেন।

কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন

এই যে কেউ কেউ নাতি পুতি কোটা বলে রাজপথ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন, তাদের কেউ কি বলবেন এই দেশের রাজাকার শিরোমনির পুত্রধন কিভাবে সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদে পৌঁছে গিয়েছিল? যার বাবা এই দেশ স্বাধীন হবার পরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। তাদের হাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ তো?

আসলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কতিপয় রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ ও এদেশীয় পাকিস্তানের দালাল ছাড়া সবাই কম বেশি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা জানিয়েছেন। তাই ভালো হয় যদি একটা সঠিক ও পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরোধীদের তালিকা করা যায়।

প্রয়োজনে তাদের মৌলিক অধিকার ছাড়া সব অধিকার রোহিত করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীতে তাদের সন্তান, এমনকি নাতি নাতনিদেরও বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কেউ কি এই দাবিটাও তুলবেন? মনে হয় না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় এখন অনেকেই প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি নিয়ে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করার পর তদন্তে উদ্ঘাটিত হয় যে, তাদের মধ্যে অনেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন, আর এই ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন স্বয়ং কিছু অসাধু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, যাদের অধিকাংশ রণাঙ্গনের কমান্ডার নন বরং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার।

৪৭ বছর আগে যুদ্ধ হয়েছে, বর্তমান মানদণ্ড অনুযায়ী ১৩ বছরের নিচে কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না, সেই অনুযায়ী সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার বয়স এখন ৬০। আর কিছু বছরের পর জীবিত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

দাবি জানাতে দিন

দাবি জানানোর অধিকার খর্ব করা রাষ্ট্র কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সঠিক হবে না, এটা অন্যায়। কথা বলতে দিতে হবে এবং যৌক্তিক হলে তা বিবেচনায় আনতে হবে। যারা চাকরিতে প্রবেশের বয়স কিংবা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে তারা আমাদেরই সন্তান, তাদের সাথে সম্মান ও সহমর্মিতা দিয়ে কথা বলুন। তাদের জোরপূর্বক আটক করা কিংবা টিয়ার সেল ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করা সমর্থন করি না।

মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সময়ের প্রয়োজনে, আমাদের বাবা চাচা, দাদা কিংবা নানা যুদ্ধ করেছেন। যাদের স্বজন সেই যুদ্ধে যায়নি, তাদের যন্ত্রণা আমি টের পাচ্ছি, এতে অবাক হই না। কিন্তু তারা কেন প্রশ্ন করে না তাদের স্বজনদের, কেন তারা সেদিন যুদ্ধে যায়নি? তারা সেদিন কোথায় ছিলেন? প্রশ্ন করুন।

আন্দোলনকারীরা জাতির পিতার ছবি সামনে নিয়ে মিছিল করছেন, যিনি এই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা ও বয়স শিথিল করেছিলেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর ছবিও বহন করছেন, যিনি সন্তান ও নাতি নাতনিদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আপনাদের এই প্রেম ও দাবি বিপরীতমুখী।

কতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই কোটা বা অন্য কোন সুবিধা রষ্ট্র থেকে নিয়েছেন? তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করা হোক। আমি নিশ্চিত কিছু সুবিধাবাদী দুষ্ট লোক লুটেপুটে নিচ্ছে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা, আর বদনামের ভাগ নিতে হচ্ছে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে।

আমার পরিচিত অনেকেই আছেন যারা নূন্যতম সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন না। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, এই তালিকায় আমার নাম থাকবে না। আমার বাবা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্থানী সেনাবাহিনী এই দেশের রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় আমার বাড়িঘর সহায় সম্বল সব পুড়িয়ে দিয়েছিল, আজও তার কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি।

এই দেশে এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়া হয়। একজন সংসদ সদস্য বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এই মুহূর্তে বিচারের মুখোমুখি হয়ে কারাগারে না থেকে হাসপাতালে বহাল তবিয়তেই আছেন। মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফের বিনা চিকিৎসায় যখন মৃত্যু মুখে পতিত তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় আনা হয়, কিছুদিন পর তিনি মৃত্যু বরণ করেন... এই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা!

অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাবিদ সংস্কার করে ১০% পর্যন্ত কোটা সমর্থন করছেন। কিন্তু আমি তাও চাই না, যাবতীয় কোটা বাতিল করা হউক। কোটায় দয়া ভিক্ষা চাই না, নিতে চাইছি না কোন রাষ্ট্রীয় সুযোগ কিংবা সুবিধা, কিন্তু দয়া করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের।

কোটায় পাওয়া চাকরিতে আমার উদরপূর্তি হবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই পরিচয় আমার সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার প্রেরণা, আমার আহংকার। এই অর্জন ও গৌরবের ভাগ তোমরা কখনই পাবে না।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধার সন্তান

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :