পুলিশ-ছাত্রলীগের এই আচরণের যুক্তি কী?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৪ জুলাই ২০১৮, ১২:১৬

ক্লাসে আমি যাদের বই পড়াই বা পড়ানোর সুযোগ পাই তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক স্যার অন্যতম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তিনি দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করেন না, পারলে সারাদিন পড়ালেখা, গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মূলত এমন শিক্ষকই চাইতেন। এইজন্যই জাতির পিতা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ৭৩ এর অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে বিস্তর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলছি, ফাহমিদ স্যার এর কাছ থেকে পরীক্ষার এক্সটারনাল হিসেবে সাহচর্য পাওয়াও সহজ নয়। আমার ধারণা উনি মনে করেন, এতে বই লেখা, পড়ায় ডিস্টার্ব হয়। তবে তার নেটওয়ার্কের মধ্যে বামপন্থী শিক্ষকদের সংখ্যাই বেশি। ফলে সেখানে আমি নেই। উনার সাথে আমার তেমন কোনো দহরম মহরম নেই। উনি বামঘেঁষা। আমি আওয়ামী লীগের পক্ষে লেখালেখি করি। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর বাতলে যাওয়া পথ অনুসরণ করতে পারলে মার্কস, লেলিন, মাও সেতুংকে অনুসরণ করার দরকার পড়ে না।

বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, একটা বাস্তবসম্মত, মানবতাবাদী রাজনৈতিক মতবাদেরও জন্ম দিয়ে গেছেন। মুজিববাদ বলা হয় সেই মতবাদকে। আমাদের জন্য মুজিববাদ কতখানি অনিবার্য এবং সত্য, তার বড় প্রমাণ ১৯৫২, ১৯৭১।

ফাহমিদ স্যার বা তাঁর মত করে যারা ভাবেন, সমাজকে দেখেন তারা যদি কোনো একটা ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে কিছু কথা বলেন, সরকারের সমালোচনা করেন তাহলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় যে, পুলিশের কনস্টেবল দিয়ে তাঁদেরকে হেনস্থা করতে হবে?

উনারা যদি একটা মানববন্ধন করেন, আওয়ামীপন্থীরা করবে একশটা (যদিও আমাদের মুরুব্বিরা আমাদের সুযোগই দেন না)। উনারা কয়জন আর আমরা কয়জন? উনারা লিখতে পারলে আমরাও লিখতে পারি। জামায়াত, জেএমবির বিরুদ্ধে লিখি আমরা। এই লেখক বুদ্ধিজীবীদেরকে পুলিশের কনস্টেবল দিয়ে হেনস্থা করে জনগণ এবং বিশ্ববাসীকে কী বার্তা দেয়া হচ্ছে?

এমনই কিছু বিচ্ছিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে জামায়াত-বিএনপি বিদেশিদের কাছে বর্তমান সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক তকমা দিয়ে অপপ্রচারের সুযোগ পাচ্ছে।

তাহলে প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ এমন করল কেন? কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেন, উনাদের নির্দেশে কোথাও কোন অপরাধ হলে, প্রমাণ থাকলে পুলিশ অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু গাড়িতে একটু ধরার পড়ে একজন পুলিশ অফিসার এসে কি বলতে পারেন যে ‘আপনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি সাধন করেছেন, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে!’

ফেসবুকে গত কদিনে অনেক ছবি ভাইরাল হয়েছে। সবাই ছাত্রলীগকে ভিলেন বানাচ্ছে। ছাত্রলীগকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেয়া হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য কি আমার পরিবার দায়ী হবে? আমার গ্রাম, মহল্লা, থানা, জেলা বা দেশকে দায়ী করা যাবে? ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া সংগঠন। আওয়ামী লীগের চেয়েও পুরনো সংগঠন ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ কোনকালেই আওয়ামী লীগের বা দেশের বিষফোঁড়া ছিল না।

ছাত্রলীগ সব সংকটে আওয়ামী লীগ ও দেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে এরা কারা যারা এভাবে হামলা করছে? একটি মেয়েকে ঘিরে যে ছেলেগুলোর আপত্তিকর ছবি এসেছে এরা কারা?

অনেকে বলছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমান্ড ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে কিছু কর্মী এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমান্ড কি এখন আছে? যে ছাত্রলীগের ভালো নেতা খোঁজার জন্য শেখ হাসিনা দিনরাত পরিশ্রম করছেন, ছাত্র রাজনীতির সাম্প্রতিককালের সব নিয়ন্ত্রকদের এক হাত নিয়েছেন, সেই ছাত্রলীগকে তিনি কিংবা শীর্ষ পর্যায় থেকে কেউ এমন নির্দেশ দিবেন, এটা আমাকে মেরে ফেললেও বিশ্বাস করব না।

কোটা আন্দোলনের সাথে সাধারণ ছেলে-মেয়েরা আছে লাখে লাখে। তাদের একটি বড় অংশ কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় প্রগতিশীল অধ্যাপকেরা, দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের অনেকে কোটা প্রথার সংস্কার চেয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য, শিক্ষক সমিতি কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। অথচ সব কোটা সংস্কারপন্থীদের শিবির বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

তবে সম্প্রতি নানা ফেসবুক পোস্ট, ভিডিও বার্তা, উস্কানিমূলক বক্তব্যে এটা এখন পরিষ্কার যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে শিবির মিশে গেছে। ফেসবুকে এদের লক্ষ্য ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা। যেকোনো অজুহাতে এরা ছাত্রলীগ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অত্যন্ত বাজে ভাষায় ক্যাম্পেইন করে। সরকার পতনের ডাক দেয়। এখানেই দেশের সচেতন ছাত্রসমাজের সতর্ক হওয়া খুব দরকার।

ভুলে গেলে চলবে না, দেশ যততুকু এগিয়েছে সেখানে নেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি অবদান শেখ হাসিনার। যতদিন শেখ হাসিনা আছেন, দেশের উন্নয়নের আশাও আছে। অন্তত এই মুহূর্তে দেশে আর কোনো জাতীয় নেতা নেই যার উপর আমরা আস্থা রাখতে পারি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে যারা সরকার ফেলে দিতে চায়, এরা ৭৫ এর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উত্তরসূরি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া ফরজ। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার পরিস্থিতি এখনো হয়নি।

অন্যদিকে আন্দোলনকারীর পেটাতে পারে, তাদেরকেও আমাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হিসেবে ধরে নিতে হবে? আমরা কি এতই বিপদে পড়ে গেছি?

সামনে নির্বাচন। দেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। শেখ হাসিনা সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিশ্বস্ত রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক। যখন স্থিতিশীলতাই মুখ্য প্রত্যাশা, তখন নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন?

ছাত্রলীগের ভেতরে শিবির অনুপ্রবেশ করেছে, ভালো পদে বসে আছে, এমন অনেক নিউজ আমরা দেখেছি। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সাথেও শিবির মিশে আছে।

বর্তমান সরকারের একজন বড় আমলা ছাত্রজীবনে শিবির করতেন বলে অভিযোগ আছে, হয়ত আরও এমন আছে, ঘাপটি মেরে অকাজ করছে। তাহলে আন্দোলনের নামে কিংবা আন্দোলন ঠেকানোর নামে এই বাড়াবাড়ি কি এদের যৌথ প্রযোজনা?

বামপন্থীরাও অনেকক্ষেত্রে প্রগতিশীলতার নামে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের স্বার্থে নিজেদের অজ্ঞাতেই কাজ করে ফেলেন। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ না থাকলে যে বামদের প্রগতিশীলতাই সবার আগে হুমকির মধ্যে পড়বে এটাও অনেক ক্ষেত্রে ইনারা বুঝতে পারেন না।

একজন আমাকে প্রশ্ন করেছে, বঙ্গবন্ধু সরকার দেশ স্বাধীনের পর এত অল্প সময়ের ভেতরে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সংবিধান দিতে পারলে, বর্তমান সরকার কোটা সংস্কার বিষয়ে বিলম্ব করছে কেন?

আমি এর জবাব দিতে পারিনি। তবে বলেছি, শেখ হাসিনা যেহেতু মুখ দিয়ে একবার বলেছেন এবং সরকার যেহেতু একটা কমিটি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, ধরে নেয়া যায় যে আজ হোক, কাল হোক একটা সিদ্ধান্ত আসবে। কোটা সংস্কার এর দাবি তো রাষ্ট্রের একমাত্র সমস্যা নয়। আরও অনেক সমস্যা আছে। কোটার দাবি কিংবা সংস্কারের দাবি থেকে নিশ্চয় রাষ্ট্র অনেক বড়, রাষ্ট্রের অগ্রগতি সবার আগে কাম্য। তাই শুভ শক্তির সকলকেই এখন শেখ হাসিনার সরকারের উপর ভরসা রাখতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :