নির্বাচনে যাবে বিএনপি!

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ০৬ জুলাই ২০১৮, ২০:১০ | প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০১৮, ১৭:০১

বিএনপি কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে? দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে এ প্রশ্ন ছিল। মিশ্র জবাব মিলেছে। কেউ বলেছেন যাবে, তবে দলের চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে নয়। আবার কেউ কেউ খালেদা জিয়ার মুক্তির পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের দাবির কথা বলেছেন।

দলটির রাজনৈতিক তৎপরতা, নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয় যে, বিএনপি আদৌ নির্বাচনে যাবে কি না। তবে বিএনপির নেতাদের মধ্যেই নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে ভিন্নমত আছে। দলের একটি অংশ মনে করে নির্বাচন থেকে দূরে থাকা ঠিক হবে না। দলের নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে হলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। অপর অংশটির ধারণা নির্বাচনে গেলে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। জেনেশুনে পরাজয়ের নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না।

আন্দোলনের ইস্যুতেও স্থির থাকেনি বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল শুরুতে। তারপর এল সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার দাবি। তার কিছুদিন পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি সামনে এসেছে। তবে এই সরকার কেমন হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি দলটি। আদতে বিএনপি কী চায়Ñ তা-ই পরিষ্কার নয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপির আপত্তি ছিল দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। তবে দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে তাদের আপত্তি নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের গত ও বর্তমান মেয়াদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছে। জয়-পরাজয় দুটোই এসেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে নাÑ এমন অভিযোগ সব সময়কার। নির্বাচনে জয়ী হলেও তারা এ কথা বলেছে। পরাজিত হলে তো বলেছেই। তবে নির্বাচন থেকে তারা দূরে থাকেনি। সর্বশেষ গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল।

নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, এমন দোলাচলে বিএনপি। নেতাকর্মীরাও এ নিয়ে আছে দ্বিধায়। কারণ, এত দিন তারা ছিলেন নির্বাচনকালীন সরকার কী হবেÑ সেই দাবি নিয়ে। এখন যুক্ত হয়েছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। নির্বাচনের বছরে এমন তথৈবচ অবস্থা দলটির জন্য সুখকর কিছু নয়।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া-না নেওয়া নিয়ে নানা বক্তব্য দিয়েছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কারও জন্য নির্বাচন অপেক্ষা করবে না। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন হবে। তবে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে।

৫ জুলাই জাতীয় সংসদ ভবনের নবম তলায় সরকারি দলের সভাকক্ষে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক বসেছিল। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় এমপিদের সতর্ক করে বলেছেন, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যেভাবেই হোক বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবেই। তাই আগামী নির্বাচন হবে অত্যন্ত কঠিন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।

এর আগে গত ২৩ জুন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সামনে আমাদের নির্বাচন। আমাদের মাথায় রাখতে হবে এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। এতে কিন্তু সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’

নির্বাচন ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যকে আমলে নিয়েছে বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের নানামুখী ব্যাখ্যা হতে পারে। এটি রাজনীতি-সচেতন মানুষের জন্য আশ্বাস হতে পারে। যারা নির্বাচন হবে কি হবে না, এ নিয়ে দ্বিধায় আছেন তাদের জন্য ইতিবাচক বার্তা। অন্যদিকে বিএনপিকে আশ^স্ত করার কৌশল হিসেবেও দেখছেন দলটির নেতারা। এ নিয়ে কথা বলেছিলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে। আজ (৬ জুলাই) ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘যারা রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে বা যারা দেশকে নিয়ে ভাবে, তাদের কৌশলে আশ^স্ত করার চেষ্টা হতে পারে। আমাদেরও কৌশলে আশস্ত করা যে, নিশ্চয়ই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের দাবি কিছু মানবেন ইত্যাদি। এটা অনেক সময় প্রতিপক্ষকে লড়াই থেকে দূরে রাখার কৌশলও হতে পারে। তবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দেশের প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলবেন সে কথার স্বাভাবিকত্ব সেটাই বোঝাবে। এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংশয় থাকা কিছু নেই। বিএনপি নির্বাচনে গেলে প্রত্যক্ষভাবেই যাবে। পরোক্ষ কোনো পথ বিএনপি নেবে না। সরকারের উচিত হবে বিএনপি যেন নির্বাচনে যেতে পারে সেই সুযোগ সৃষ্টি করা। সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।’

আসলে বিএনপির অবস্থান কী? তারা কি আসলে নির্বাচনে যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, তারা নির্বাচনে যেতে চান। তবে নির্বাচনের নামে কোনো ‘প্রহসন’ হোক তারা তা চান না। তিনি বলছিলেন, ‘বিএনপি গণতান্ত্রিক দল। সরকার পরিবর্তনের জন্য আমরা গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথকে বিশ্বাস করি না। আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। তবে নির্বাচন যেন আসলেই নির্বাচন হয়। নির্বাচনের নামে কোনো প্রহসন যেন না হয়। কোনো খেলা যেন না হয়।’

বিএনপির নেতাদের মুখেই শোনা যায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। যদি জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের চেয়ারপারসন কারাগারে থাকেন, তাহলে বিএনপি কী করবে? নজরুল ইসলাম খান বললেন, ‘আমরা মনে করি, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামিন পাবেন। তিনি কারাগারে থাকবেন না। তার বিরুদ্ধে যত মামলা সবই জামিন পাওয়ার যোগ্য। তাকে জামিন দেওয়া হয়নি, এটা হাস্যকর একটা ব্যাপার।’

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের (আরপিও) বিষয়-আশয়। কেননা আরপিও অনুযায়ী টানা দুবার কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কথা। এই বাধ্যবাধকতায় এবার বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিকল্প নেই। দলের নিবন্ধন রক্ষা করতে হলেও তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, এসব আরপিওর জুজু দেখিয়ে লাভ নেই। বিএনপি সব সময়ই বলছে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির কথা। সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনেরও দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দলের নিবন্ধন তো করা হয় রাজনীতি করার জন্য। রাজনীতি করার সুযোগ যদি না থাকে, তাহলে নিবন্ধন দিয়ে কী হবে? আরপিওতে বলা আছে, পর পর দুবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনে না যাওয়ার পেছনে যদি যৌক্তিক কারণ থাকে? এখানে এই ধারাটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে।’ প্রায় এক যুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলের জন্য নিঃসন্দেহে এটি দীর্ঘ সময়। লম্বা সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক চর্চা থেকেও তারা পিছিয়ে পড়েছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপির সাংগঠনিক ভিত অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে সর্বশেষ খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। খুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী তুলনামূলক বিচারে দুর্বল ছিল। তালুকদার আবদুল খালেক ও নজরুল ইসলাম মঞ্জুর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাতেও তফাত ছিল।

একই অবস্থা হয়েছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। সাবেক মেয়র এম এ মান্নানকে বাদ দিয়ে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছিল হাসান উদ্দিন সরকারকে। আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার জেরে এমনিতেই সরকার পরিবার গাজীপুরে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয়ভাবে। তার ওপর হাসান উদ্দিন সরকার শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। ভোট ও সমর্থন চাওয়ার জন্য যেভাবে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ছোটার কথা ছিল, তিনি তা পারেননি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার চলাচল ছিল সীমিত। তার ওপর হঠাৎ প্রার্থী করায় নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতি ছিল না। এই কম সময়ের মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করা সম্ভব হয়নি। বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের ভিত নড়বড়ে ছিল না। পাঁচ বছর আগে নবগঠিত গাজীপুর সিটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সেবার দলের মনোনয়ন পাননি। তবে তিনি মনোনয়ন না পেলেও পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি চালিয়ে গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় সময় দিয়েছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় পেয়েছেন প্রচার, প্রচারণা ও মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য। মনোনয়ন পাওয়ার পরও তার সরব উপস্থিতি ছিল ভোটের মাঠে। ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতির সময় অনেক আগেই শুরু হয়েছে। বিএনপি এখনো নির্বাচন নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকলে ভুল করবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মতো আরেকটা ভুল দলটির অস্তিত্বকে খাদের কিনারায় নিয়ে দাঁড় করাবে। বিএনপি কি আবার সেই ভুল করবে?

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :