কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি কত দূর?

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০১৮, ১১:৫০

মোহাম্মদ জমির

কিছুদিন আগেও তারা ছিলেন চরম শত্রু। কার পরমাণু শক্তি কত বেশি এ নিয়ে হয়েছে তর্কযুদ্ধ। দুজনায় যে হাসি মুখে বৈঠক করতে পারেন তা ছিল কল্পনারও অতীত। বলছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের কথা। বলা যায় এক অসম্ভব সম্ভবপর হয়েছে। আমরা দেখেছি, বৈঠকটি নির্ধারিত হওয়ার পরও দুপক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটির জেরে তা প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছিল। কিন্তু বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে হয়েছে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে বৈঠকটি করে আদৌ কোনো লাভ হবে কি না তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই সন্দেহ যেমন প্রবল ছিল, আবার আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণও দেখছে বিশ্লেষকরা।

গণমাধ্যমের খবরে আমরা দেখেছি, ১২ জুন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরস্পরের দিকে সতর্কভাবে হেসে করমর্দন করে ঐতিহাসিক বৈঠক শুরু করেন। স্থানীয় সময় সকালে সিঙ্গাপুরের সানতোসা দ্বীপের কাপেলা হোটেলে এই বৈঠক হয়। বৈঠকে দুই নেতা কোরীয় উপদ্বীপের পারমাণবিক অচলাবস্থা অবসানের পথ বের করার চেষ্টা করেন। তাদের এ বৈঠক সফল হলে তা উত্তর-পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তার চিত্রে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। এটা অনেকটা ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের মতো হতে পারে, যার পর থেকে চীনের রূপান্তর ঘটেছিল। ট্রাম্প ও কিমের বৈঠক সম্পর্কে বিবিসি জানিয়েছে, ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শুরুর পর্বে বিলাসবহুল কাপেলা হোটেলের দুই পাশ থেকে দুই নেতা হেঁটে এসে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার পতাকা দিয়ে সজ্জিত একটি দৃশ্যপটের সামনে প্রথমবারের মতো পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে দৃঢ়ভাবে করমর্দন করেন। গণমাধ্যমের সামনে সংক্ষিপ্ত ওই পর্বে দুই নেতা প্রাথমিক মন্তব্য বিনিময় করেন। কিম বলেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুশি হলাম মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’ উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি সত্যি গর্ব অনুভব করছি। আমরা মহৎ একটি আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি এবং তা ব্যাপকভাবে সফল হবে বলে আশা করছি। আমার ধারণা এটি সত্যিই সফল হতে যাচ্ছে এবং আমাদের মধ্যে গভীর সম্পক হবে, আমার কোনো সন্দেহ নেই।’ উত্তরে কিম বলেন, ‘ওয়েল, এ পর্যন্ত আসাটা সহজ ছিল না। অতীতে আমাদের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা বসানো ছিল, কিন্তু আমরা সেগুলো সব অতিক্রম করেছি এবং আজ আমরা এখানে।’

কাপেলা হোটেলে পৌঁছে তাদের লিমুজিন থেকে নামার সময় উভয় নেতাকেই বেশ সিরিয়াস মনে হয়েছে বলে জানিয়েছেন রয়টার্সের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হাসি দিয়ে পরস্পরের হাত ধরে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য বিনিময় করে বৈঠকের পরিবেশে একটি আশাবাদের আবহ তৈরি করেন। এরপর কিমকে পথ দেখিয়ে কাপেলা হোটেলের পাঠাগারের দিকে নিয়ে যান ট্রাম্প, সেখানে শুধু দোভাষীদের নিয়ে বৈঠক শুরু করেন তারা।

প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে কথাবার্তা বলার পর ট্রাম্প ও কিম আবার দেখা দেন। হোটেলের বারান্দা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটেন, তারপর আবার বৈঠক কক্ষে ঢুকে যান। সেখানে তারা তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হন। বারান্দায় হাঁটার সময় এক দোভাষীর মাধ্যমে কিম ট্রাম্পকে বলেন, ‘আমার ধারণা পুরো বিশ্ব এই মুহূর্তটি দেখছে। বিশ্বের অনেক মানুষ এই দৃশ্যকে উদ্ভট কল্পনা, সায়েন্স ফিকশন মুভি বলে মনে করবে।’ বৈঠক কেমন চলছে এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘খুব ভালো, খুব, খুব ভালো। ভালো সম্পর্ক।’ কিমও আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা এই বৈঠক সম্পর্কে সব ধরনের সংশয় ও অনুমান পার হয়ে আসতে পেরেছি এবং আমার বিশ্বাস এটি শান্তির জন্য শুভ হবে।’ পরে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প ও কিমের ব্যক্তিগত বৈঠক মোট ৩৮ মিনিট স্থায়ী হয়েছে।

দুই বৈরী রাষ্ট্রের দুই প্রধান ব্যক্তির সরাসরি বৈঠক বিশ্ব শান্তির পথ প্রশস্ত করবে- এই আশাবাদ সবার মধ্যেই সঞ্চার হয়েছে। তারা ক্ষমতায় এসেছেন ভিন্ন পথে। কিমের ছিল পারিবারিক পরম্পরা। পড়াশোনা করেছেন সুইজারল্যান্ডে। বয়সে এখনো যুবক এবং একনায়ক। নিজের ক্ষমতার বিরুদ্ধে যখনই কেউ বিন্দুমাত্র চ্যালেঞ্জ করেছে, তাকে তিনি অবলীলায় সরিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ী থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এমন একজনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হননি। তিনি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। কী বলবেন বা করবেন আগে থেকে ধারণা করা কঠিন। কিম ও ট্রাম্প- দুজনের বিষয়ে একটি মিল রয়েছে সেটি হলো নিজেদের প্রশাসনের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রবল।

এখন আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দাবি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার, তৈরির সাজ-সরঞ্জাম, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। বিপরীতে উত্তর কোরিয়ার দাবি, ১৯৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধের যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তিতে রূপান্তর করতে হবে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার ঘাঁটি এবং অস্ত্রসম্ভার সরাতে হবে এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ওঠাতে হবে। এসব শর্তের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া দাবি করছে- হঠাৎ করে একটি বৈঠক থেকে এই নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, এটা ধীরে ধীরে করতে হবে। এদিকে উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র চীনও ওয়াশিংটন এবং পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। উত্তর কোরিয়ায় অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন নিয়ে চীন উদগ্রীব।

তাই ১২ জুনের বৈঠক একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রমুক্ত কোরীয় উপদ্বীপ প্রতিষ্ঠার দুয়ার খুলে দেবে- এমন প্রত্যাশা থেকে বিশ্বব্যাপী পর্যবেক্ষকরা আগ্রহের সঙ্গে এর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দুই নেতার যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো আদৌ এ বৈঠক থেকে সারগর্ভ কিছু অর্জিত হয়েছে কি না, সেই উত্তর খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের মতে, দুই নেতার আলোচনা থেকে সত্যিকারের সারবস্তু যদি বেরিয়ে এসে থাকে, তা হলো দুই দেশের প্রধান ও তাদের সফরসঙ্গীদের জন্য কর্মমধ্যাহ্নভোজে পরিবেশিত ডার্ক চকলেট টার্ট। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তার সম্পাদকীয় স্তম্ভে বলেছে, ক‚টনীতির মডেল হিসেবে সিঙ্গাপুরে শীর্ষ বৈঠকের সাফল্য ও ব্যর্থতার মুহূর্ত রয়েছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একক শিল্পনৈপুণ্যের মঞ্চ হিসেবে একে দশে দশ দেওয়া যায়।

চুক্তি সম্পাদনে নিজের ‘বুলিং’ ক্ষমতার ওপর বরাবর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অগাধ আস্থা। কিমের সঙ্গে তার লড়াইটা হবে ব্যক্তিত্বের, যেখানে তিনিই (ট্রাম্প) জিতবেন, এ কথাই এযাবৎ বলে এসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তির ব্যাপারে এ রকম ভেবেছিলেন, যার সম্পর্কে বাকি দুনিয়া অনেকটাই অন্ধকারে ছিল। এমনকি এখনো যথেষ্ট ধারণা মিলেছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। মাত্র কয়েক দিন আগেও পশ্চিমা গণমাধ্যম তাকে ‘উন্মাদ’ প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। আর এখন অনেকেই কিম জং-উনকে চতুর ভাবছেন। এদিকে বৈঠক পবরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, একদিন তিনি মার্কিন সৈন্যদের কোরীয় উপদ্বীপ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। এমনকি তিনি ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা চলাকালে সামরিক মহড়াকে ‘উসকানিমূলক’ বলেও অভিহিত করেন। তার এই শেষ কথাটা যেন কিম জং-উনের থেকে ধার করা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও উত্তর কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যা কিছু কর্তৃত্ব থেকে থাকুক, ১২ জুনের পর ট্রাম্প তা অনেকটাই খুইয়েছেন বলা যায়। আমরা দেখেছি, বৈঠকের পর দুই নেতা কোরীয় উপদ্বীপে ‘দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল শান্তি’ স্থাপনের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি উত্তর কোরিয়াকে ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা’ দিচ্ছেন। বিনিময়ে কিম কোরীয় উপদ্বীপকে বিপারমাণবিকীকরণে তার ‘দৃঢ় ও অবিচল প্রতিশ্রুতি’ দান করেন। দুই নেতা আরও বলেন, ঘোষণাটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ তারা বিভিন্ন স্তরে আরও বৈঠক অনুষ্ঠান করবেন। কিম জং-উনকে বিশ্বনেতার স্বীকৃতি দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়ার ‘নতুন সম্পর্ক’ স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ করে ট্রাম্প সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের পূর্বশর্তগুলোর অনেকটাই পূরণ করেছেন। কিন্তু কিম জং-উন এগুলোর প্রতিদান দেননি। উত্তর কোরিয়া যদিও ‘সম্পূর্ণ বিপারমাণবিকীকরণ’ এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাস্থান ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি আবারও দিয়েছে, কিন্তু কবে নাগাদ তা করা হবে এবং সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ কতটা রয়েছে, সেগুলো পরিষ্কার করেনি।

ট্রাম্প-কিম বৈঠক গোটা বিশ্বের ক‚টনৈতিক মহলই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। যেন একটি ঠাণ্ডা লড়াই বা সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেল বিশ্ব। দুই নেতার ঐতিহাসিক সম্মেলনের প্রশংসা করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এক শীর্ষ ক‚টনীতিক। কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা প্রশমনে ক‚টনৈতিক সমাধানের পথে এ এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। ইইউর পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মঘারিনি বলেছেন, ট্রাম্প এবং কিমের মধ্যে বৈঠক দেখিয়ে দিয়েছে যে, ক‚টনীতি আঞ্চলিক শান্তি এগিয়ে নেওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। মঘারিনির কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে কোরীয় উপদ্বীপ পরিপূর্ণ এবং প্রমাণসাপেক্ষভাবে নিরস্ত্রীকরণ করা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেরও লক্ষ্য এটিই। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার দুই নেতা যে যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষর করেছেন তাতে এই স্পষ্ট ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে যে, এ লক্ষ্য অর্জন করা যেতে পারে। সম্মেলনের পট প্রস্তুত করায় নেতৃস্থানীয় ভ‚মিকা রাখার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনকে ধন্যবাদও জানানো হয়েছে এতে।

আর কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীনও এ নিয়ে কথা বলেছে। তবে তারা যথারীতি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার প্রতি সহানুভ‚তিশীল। সিঙ্গাপুরে ট্রাম্প-কিম সম্মেলনে কোরীয় উপদ্বীপ নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে একটি ‘বিস্তারিত’ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর হওয়ায় এখন উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলেই মনে করে চীন। ওই বৈঠকের পর বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং বলেন, উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপ করা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞাগুলো এমনভাবে তৈরি যে, দেশটির কার্যক্রমের পরিবর্তন হলে সে অনুযায়ী ওই নিষেধাজ্ঞা সমন্বয়, স্থগিত বা তুলে নেওয়া যাবে। তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়নি। তবে বর্তমানে আলোচনার মাধ্যমে ক‚টনৈতিকভাবে সংকট সমাধানের যে চেষ্টা চলছে, নিরাপত্তা পরিষদের সে উদ্যোগে সমর্থন দেওয়া উচিত বলে আমাদের বিশ্বাস।’

ট্রাম্প-কিম যৌথ ঘোষণাপত্রে প্রধান তিনটি পয়েন্ট হলো: ১. যুক্তরাষ্ট্র ও ডিপিআরকে (ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া) শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য দুই দেশের জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী সহযোগিতার ভিত্তিতে ‘নতুন ইউএস-ডিপিআরকে সম্পর্ক’ স্থাপনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ থাকবে। ওদিকে উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ২. কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও ডিপিআরকে যৌথ উদ্যোগ নেবে। ৩. চলতি বছরের ২৭ এপ্রিলের পানমুনজম ঘোষণা পুনর্নিশ্চিত করে কোরীয় উপদ্বীপকে পুরোপুরি পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করতে ডিপিআরকে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ থাকবে। এই তিনটি বিষয় সামনে এনে উত্তর কোরিয়ার নিষেধাজ্ঞার অবসান দেখতে চায় চীন।

বিশ্বের আরেক পরাশক্তি রাশিয়াও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে কোরীয় উপদ্বীপ নিয়ে মার্কিন কর্মকাণ্ড। ট্রাম্প ও উনের শীর্ষ সম্মেলন ভয়াবহ সংঘাতের হুমকি কমিয়ে এনেছে বলে মন্তব্য করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আগামী সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সফরে কিমকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন তিনি। এদিকে জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধের ঘোষণার সমালোচনা করে বলেছেন, এ মহড়া আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য জরুরি। সম্মেলনকে ঘিরে বিশ্ব নেতাদের মন্তব্য এখনো অব্যাহত। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বৈঠক সম্পর্কে বলেছেন, ‘অবশ্যই এর মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি তৈরি হলো। পাশাপাশি কোরীয় উপদ্বীপে যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল তাও কমে আসবে এর মাধ্যমে। সব সমস্যার সমাধান সংলাপ এবং ক‚টনৈতিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে হওয়ার উদাহরণ তৈরি করতে পারে এ বৈঠক।' এদিকে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে চীন ও জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একযোগে কাজ করার কথা বললেও জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুনোরি ওনোডেরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য জরুরি। একইসঙ্গে জাপান-যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া সামরিক মহড়াও নিরাপত্তা রক্ষায় জরুরি, সেজন্য জাপান নিজেদের অবস্থান বদলাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জাপানের এই অবস্থানের চেয়ে কিছুটা নরম সুরেই আছে দক্ষিণ কোরিয়া। কারণ তাদের উদ্যোগেই চলমান শান্তি উদ্যোগ আসলে গতি পেয়েছে। তাই তো ট্রাম্প-কিম বৈঠকের বেশ কিছুদিন আগে ২৭ এপ্রিল অনেকটা আচমকাই হয়েছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের বৈঠক। তবে দক্ষিণ কোরিয়া চায় উত্তর কোরিয়া অবশ্যই পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে সরে আসবে। একই বিষয়ে জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়াকে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ২৪ জুন সিএনএনকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অ-পারমাণবিকীকরণের ক্ষেত্রে পিয়ংইয়ংয়ের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর পর্যালোচনা হবে। সিঙ্গাপুরের শীর্ষ সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে উত্তর কোরিয়া ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হবে বলেও আশা সাবেক এই সিআইএ-প্রধানের। গত সপ্তাহের শুরুর দিকে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে পিয়ংইয়ংকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। পম্পেওর অবস্থানের সঙ্গে তার ওই বক্তব্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ‘সম্মেলনে যে চুক্তি হয়েছে তার বাস্তবায়ন আমরা কিভাবে চাই সেটি যখন তাদের কাছে উপস্থাপন করা হবে তখন তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু চাওয়া হবে এবং অবশ্যই তার জন্য সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে’- বলেছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে ২৪ জুন সিএনএনকে পম্পেও বলেন, পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিলে উত্তর কোরিয়ার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করবে মার্কিন প্রশাসন; যদিও সুনির্দিষ্ট করে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে না। তিনি আরো বলেন, ‘কোনো সময়সীমা দিচ্ছি না আমি; হতে পারে এটি দুই মাস কি ছয় মাস। উভয় নেতা যা নির্ধারণ করেছেন তা অর্জনে দ্রæতগতিতে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ওই শীর্ষ সম্মেলনের পরপরই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ট্রাম্পের এই মেয়াদের মধ্যেই উত্তর কোরিয়া ‘বড় ধরনের নিরস্ত্রীকরণ’ করবে বলে আশা ওয়াশিংটনের। তবে ট্রাম্প-কিম দুজনই কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্র মুক্ত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিলেও পিয়ংইয়ং কীভাবে ও কত সময়ের মধ্যে তার পরমাণু কর্মসূচি বাতিল করবে যৌথ ঘোষণায় তার উল্লেখ নেই বলে জানিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। তবে বৈঠকের পরও ট্রাম্প দাবি করেছেন, উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার স্বাক্ষরিত ঘোষণার সারকথাই হচ্ছে- ‘উত্তর কোরিয়ার সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ।’ যদিও ঠিক কীভাবে এটি অর্জিত হবে তার বিস্তারিত বলেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পিয়ংইয়ং অবশ্য শুরু থেকেই ‘একতরফা নিরস্ত্রীকরণে’ আপত্তির কথা জানিয়ে আসছে। এদিকে উত্তর কোরিয়াকে আশ্বস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া স্থগিত ঘোষণা করেছে। ওই ‘যুদ্ধ মহড়াকে’ উসকানি হিসেবেই বিবেচনা করত পিয়ংইয়ং।

আমরা বিশ্বাস করি চলমান শান্তি উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখবে। নইলে বিশ্ব আবার পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকির মুখেই পড়বে। সেই ঝুঁকিতে আমরা থাকতে চাই না।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার