ভ্রমণ

চর কুকরি মুকরির কথা

সৈয়দ রশিদ আলম
ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৯ জুলাই ২০১৮, ১০:২৫

যারা চরাঞ্চল ভ্রমণ করতে আগ্রহী তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক দুর্গম চরাঞ্চলে বেড়াতে চলে যান। এদের মধ্যে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি যে চরটি আকর্ষণ করে সেটি হলো কুকরি মুকরি। চারদিকে নিবিড় কালচে সবুজের সমারোহ। দূর থেকে চোখ পড়বে অস্পষ্ট বর্ণরেখা। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সে রেখা কখনো ঢেউ খেলানো, কখনো সমতল। ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কুয়াশার অস্পষ্টতা কাটতে না কাটতেই সূর্যের বর্ণচ্ছটা মেঘনার বিশাল বুকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ হয়ে। ভোলার সর্বশেষ স্থলসীমা চর কচ্ছপিয়া থেকে চোখে পড়বে এই দিগন্ত বিস্তৃতি চোখ জুড়ানো সবুজের বিশাল আয়োজন। চর কচ্ছপিয়া বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়ালে একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠবে টুকরো টুকরো বনভূমি। সেই বনভূমি ঘিরে আছে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘনার অথৈ জলরাশি।

ইতিবৃত্ত

কুকরি মুকরি সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় ১৯১২ সালে এ চর জেগে উঠে। তৎকালীন জার্মান যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন জনমানবহীন এই চরে জাহাজ নিয়ে আসেন শিকারের উদ্দেশে। দেখতে পান একটি বিড়াল ও কুকুর ছোটাছুটি করছে। সেই দৃশ্যাবলী তাকে মনে করিয়ে দেয় নির্জন এই চরের নামকরণ। পরে জার্মানের অনূদিত রূপ হিসেবে বাংলায় যার নামকরণ হয়ে যায় চর কুকরি মুকরি। পর্তুগিজ ও ওলন্দাজরা দস্যুবৃত্তি লুটতরাজ করে এই চরে আশ্রয় নিত। এই দ্বীপকন্যাকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা করতে জেগে ওঠা চরগুলো সংরক্ষণে ১৯৪৭ সাল থেকে এখানে বনায়ন করা হয়। ওই কর্মসূচিই পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হিসেবে রূপলাভ করে।

যা দেখবেন

নিশ্চুপ প্রকৃতি, সবুজের সমারোহ আর মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো পশুপাখির দল যাদের আকৃষ্ট করে তাদের জন্য ঘুরে দেখার চমৎকার একটি স্থান হতে পারে সাগর তীরের চর কুকরি মুকরি। নৈসর্গিক সৌন্দর্য, নয়নাভিরাম দৃশ্য, ম্যানগ্রোভ অরণ্য যেকোনো পর্যটকের সৌন্দর্যপিপাসু দৃষ্টিতে আকৃষ্ট করবে, যা অনেকের কাছে এখনো অজানা। চরফ্যাশনে বসবাস করেও অনেকে জানে না চর কুকরি মুকরি বালুর ধুম, কুয়াকাটা, কক্সবাজারের সাদৃশ্য দৃশ্যাবলী এখানেও বিদ্যমান। ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অনেকটা সাগরের কোলঘেঁষে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এই চরেই রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। কথিত আছে, এক সময় এই চরে শুধু কুকুর আর ইঁদুর (স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত) ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়তো না। আর তাই এই চরের নামকরণ হয় কুকরি মুকরি। চর কুকরি মুকরির বনে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল প্রভৃতি। আর পাখি ও সরীসৃপ হিসেবে এই বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বনমোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুঁইসাপ, বেজি, কচ্ছপ ও নানা ধরনের সাপ। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে চর কুকরি মুকরি এলাকায় প্রশাসনিক উদ্যোগে বনায়নের কাজ শুরু হয়। এই সময় মূলত শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপণ করে বনায়ন শুরু করা হলেও পরে ক্রমে ক্রমে যুক্ত হয় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি গাছের চারা রোপণ করা। এছাড়া গোটা এলাকায়ই চোখে পড়ে বিপুলসংখ্যক কেওড়া গাছ। মূলত বিশাল এলাকায় গড়ে ওঠা এসব গাছ, আশপাশের নারিকেল গাছ, বাঁশ ও বেত বন মিলেই এখানেই তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় একটি ম্যানগ্রোভ শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। এছাড়া এখানকার সমুদ্র সৈকতটিও বেশ পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি। বালুর ধুম, পাতিলা অরণ্যে রয়েছে হাজার হাজার মায়াবী হরিণ। ছোট্ট নৌকায় চেপে ছোট্ট লেকে নিঃশব্দে নিশ্চুপে চলতে গেলে দেখা যাবে মায়াবী হরিণের ছোটাছুটি। পরিবেষ্টিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সর্পিল লেক, বালুকাময় তীর, সি-বিচ, সামুদ্রিক নির্মল হাওয়া, তরঙ্গ গর্জন সবই চর কুকরী মুকরির বালুর ধুমে, যা মনোমুগ্ধকর রূপসজ্জা আর প্রকৃতির লীলাভূমি। অন্যান্য চরের চেয়ে কুকরি মুকরি অনেকটা আলাদা প্রকৃতির। এখানে অন্যান্য সৈকতের চেয়ে নিসর্গিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্য বিদ্যমান।

যেভাবে যাবেন চর কুকুর মুকরিতে যেতে চাইলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে জলপথে কোনো লঞ্চে চড়ে প্রথমে ভোলায় আসতে হবে। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে ভোলায় পৌঁছতে হবে। ভাড়া ৩০০-৪০০ টাকা। তারপর ভোলা লঞ্চঘাট থেকে বাসস্টেশনে এসে চরফ্যাশনের বাসে চড়ে আসতে হবে চর আইচায়। চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়ার দূরত্ব ভোলা সদর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার। চরফ্যাশন থেকে হিউম্যান হলারে আসতে হবে কচ্ছপিয়া ঘাট। মানুষ কম হলে অটোরিকশা করে চলে আসতে পারেন। এখান থেকে কচ্ছপিয়া উপজেলা ট্রলারঘাট হয়ে আবারও ইঞ্জিন নৌকায় বেশ খানিকটা জলপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যাবে চর কুকরি মুকরিতে। কুকরি মুকরি থেকে সকালবেলা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হতে পারেন। ভাড়া ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা নেবে। তবে যাওয়ার আগে সমুদ্রের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে যাবেন।

খাবারের বন্দোবস্ত চর কুকরি মুকরি বাজারে তেমন ভালো কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই। হাতেগোনা কয়েকটি খাবারের হোটেল রয়েছে। স্থানীয়দের হাতের রান্না করা খাবার পাবেন হোটেলগুলোতে। সম্ভব হলে বাজার থেকে তাজা মাছ কিনে রাঁধতে দিন, দামে সস্তা আর স্বাদেও টাটকা। এখানে ব্রয়লার মুরগি আর ডিম একটু অপ্রতুল। খাবার পানি সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো। এখানকার বাজারের মিষ্টির দোকানের মিষ্টি চোখে দেখতে ভুলবেন না যেন। এখানে রাতে থাকার জন্য একমাত্র ভরসা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, সাইক্লোন শেল্টার, দুটি এনজিওর অফিস। এছাড়া স্থানীয়দের সাহায্য নিতে পারেন, সে ক্ষেত্রে দল বড় হলে সমস্যা। দু-চারজন হলে ম্যানেজ করা সম্ভব।

সৈয়দ রশিদ আলম: পর্যটক ও গবেষক

(ঢাকাটাইমস/৯জুলাই/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :