জামায়াত নিয়ে বেকায়দায় বিএনপি

প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০১৮, ০৮:১০

বাছির জামাল

বিএনপি তার জোট সঙ্গী জামায়াতকে নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে। দীর্ঘদিনের এই জোটবন্ধুকে না পারছে ছাড়তে আর না পারছে রাখতে। বিএনপি চায় আওয়ামী লীগ ও তার জোটের বাইরের দলগুলোর সঙ্গে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে। কিন্তু এই ঐক্যের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। স্বাধীনতাবিরোধী তকমা পাওয়া এ দলটি থাকলে বিএনপির জাতীয় ঐক্যের ডাকে অনেক দলই সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলো যেমন, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য জামায়াতের ব্যাপারে ‘রিজার্ভেশন’ রয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে থেকেই ক্ষমতাসীন জোটের বাইরের দলগুলোকে নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টায় রয়েছে দলটি। খালেদা জিয়া জেলখানায় যাওয়ার পর এই চেষ্টা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে আনতে হলে এখন একটি বৃহত্তর ঐক্য বড় প্রয়োজন। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য গঠনের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা হলে সরকারের পতন ঘটাতে তিনদিন সময় লাগবে।’ ২০ দলে অনেক শরিক দল থাকলেও একটি গণমুখী আন্দোলন গড়ে তোলার মতো জনবল বিএনপি ও জামায়াত বাদে ওই সব দলের নেই।

এছাড়া ওই সব দলে কোনো ‘ক্যারিসমাটিক লিডারশিপ’ও নেই যে, তাদের ডাকে জনগণ সাড়া দেবে। তবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হলে এসব দলকে বাদও দিতে চায় না বিএনপি। এজন্যই ২০ দলের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোকে নিয়েই সমমনা বা মোটামুটি ক্ষমতাসীন জোটকে পছন্দ করে না এমন দলগুলোর সঙ্গে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ায় আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির আলাপের প্রসঙ্গটি হচ্ছে আগামী নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে নির্বাচনকালে একটি নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এই আলাপ-আলোচনা করতে গিয়েই জামায়াত প্রসঙ্গটি এসেছে। এখন বৃহত্তর ঐক্য গঠনে জামায়াতকেই প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে জামায়াত আবার ২০ দলের সিদ্ধান্তও মানছে না। স্থগিত হয়ে যাওয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় থেকেই ২০ দলের একক প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাশ কাটিয়ে আসছে জামায়াত। সংগঠনটির আবার নিবন্ধন আপাতত নেই। হাইকোর্ট তাদের নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। তবে এই নিবন্ধন বিষয়টি এখন অ্যাপিলেট ডিভিশনে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশন নিবন্ধনের বিষয়টি ফয়সালা না করে দিলে জামায়াতের কোনো নেতা বা কর্মী তার প্রতীক নিয়ে আর নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী মুহসীন রশিদ জানিয়েছিলেন, নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কারণে জামায়াতের নেতারা দলীয় পরিচয়ে আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে স্বাধীনভাবে অর্থাৎ ব্যক্তি পরিচয়ে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভিন্ন কোনো প্রতীকে তাদের নির্বাচন করতে হবে। কোনোভাবেই জামায়াতের পরিচয় তারা ব্যবহার করতে পারবেন না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত তাদের ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। ছাত্রশিবিরের সাবেক এই সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় গণসংযোগ করেছিলেন। পরবর্তীতে ওই নির্বাচন এক মামলায় স্থগিত হয়ে যায়। এবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জামায়াত তাদের মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়। তারা ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মাহবুব জুবায়েরের মনোনয়নপত্র জমাও দেয়। সিলেটে এখন পর্যন্ত জামায়াত প্রার্থী গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এটা ঠিক, জামায়াতের সিলেট মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বিএনপিকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ২৭ জুন বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জোট থেকে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার দাবি জানিয়ে বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই গুলশান কার্যালয় ত্যাগ করেছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম।

জামায়াত মনে করে, সব সময় তারা ছাড় দিলেও বিএনপি তাদের ছাড় দেয় না। এছাড়া সিলেটে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা ভালো। তাই ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দিলে জয়ের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। দলটির নেতারা আরও বলছেন, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপিকে শুধু ছাড়ই দেয়নি জামায়াত, তারা বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ভোটও চেয়েছে। তাই আসন্ন ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সিলেটে মেয়র পদটি তারা চায়।

২২ জুন অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকেও এ দাবি জানিয়েছে জামায়াত। তাদের দাবির পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, আমরা জোটে আছি। সবসময় আমরা ছাড় দেব, বিএনপি আমাদের একটাও ছাড়বে না, এটা তো হতে পারে না। ওই বৈঠকে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় ২৭ জুনের বৈঠকটি ডাকা হয়। এ বৈঠকে জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপিকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয় সিলেটে তাদের প্রার্থী নির্বাচন করবে। অন্য দুই সিটি রাজশাহী ও বরিশালে যদি তাদের সমর্থন পেতে হয়, তাহলে তাদের একটা ছেড়ে দিতে হবে।

সব মিলিয়ে জামায়াতবিরোধী একটি মত এখন বিএনপিতে প্রবল হচ্ছে। ভোটের অঙ্কে জামায়াতকে আওয়ামী লীগ নিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করেই কিন্তু এতদিন জামায়াতকে সঙ্গে রেখেছিল বিএনপি। এজন্য জামায়াতবিরোধী অংশটি পাত্তা পাচ্ছিল না দলে। খালেদা জিয়া জেলে থাকায় বিএনপি এখন বিপদে রয়েছে। এই বিপদের দিনে জামায়াতের এমন অবস্থানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনেকেই নাখোশ। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এমন অবস্থাকে ‘ক্যাশ’ করে জামায়াতকে বিতাড়িত করা যায় কি না সেই চেষ্টায় রয়েছে দলের জামায়াতবিরোধী অংশটি। বিএনপির বুদ্ধিজীবী মহলের জামায়াতবিরোধী অংশটিও এ অবস্থায় তৎপর হয়ে ওঠেছে। তারা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বুঝাতে চায় যে, জামায়াতকে বাদ দিয়ে যদি সরকারবিরোধী একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়া যায়, তাহলে সেটিই হবে তাদের জন্য মঙ্গল।

তবে জোট থেকে জামায়াত বাদ পড়বে কি না বা জামায়াত বাদে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে বিএনপি যাবে কি না এ নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। সবকিছুই নির্ভর করছে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হবে যে, বিএনপি তাদের সঙ্গে জামায়াতকে রাখবে কি না।

বাছির জামাল: প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ