কোরিয়ানদের দেখে শুধু মুগ্ধই হচ্ছি

মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
| আপডেট : ১৬ জুলাই ২০১৮, ১৩:২৯ | প্রকাশিত : ১৬ জুলাই ২০১৮, ১০:৪৭

আধুনিক বিশ্বে নাগরিক সুবিধা ও উন্নত জীবনধারার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এটি বিশ্বে তৃতীয় প্রযুক্তির দেশ। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে আজ দক্ষিণ কোরিয়া উন্নতির শিখরে উঠ গেছে। বাংলার একঝাঁক তরুণের অবস্থান এই স্বপ্নের দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহর সিউল। ইনছন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘেঁষেই এই অত্যাধুনিক শহর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও পর্যটন শহর হিসেবে নাম কুড়িয়েছে বুসান, ইয়াংসু, জেজু দ্বীপ, দেজনের মতো শহরগুলো। বুসানে প্রতি বছর বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করা হয়। যা সমগ্র বিশ্বের খ্যাতি কুড়িয়েছে।

যেদিকে তাকাই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মাঝে মাঝে মনে হয় চূড়ায় না শিখরে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করা যায় এই দক্ষিণ কোরিয়াতে। দক্ষিণ কোরিয়া পূর্ব এশিয়ার কোরিয়া উপদ্বীপের দক্ষিণ অর্ধাংশ নিয়ে গঠিত। এর উত্তরে উত্তর কোরিয়া, পশ্চিমে পীত সাগর, পূর্বে জাপান সাগর এবং দক্ষিণে পূর্ব চীন সাগর। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৩০% এলাকা নিম্নভূমি এবং বাকি অংশ উচ্চভূমি বা পর্বতমালা। নিম্নভূমির অধিকাংশই সমুদ্র উপকূলে, বিশেষত পশ্চিম উপকূলে প্রধান প্রধান নদীর অববাহিকাতে অবস্থিত।

এখনে শীতের সময় তুষারে ঢেকে যায় পুরো কোরিয়া। শীতের মূল সমস্যা জলীয় বাষ্প খুব কম থাকে, খুব শুষ্ক। এই দেশে যারা নতুন প্রবেশ করে বিশেষ করে তাদের নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। তবে শরীরকে একটু সময় দিলে আস্তে আস্তে সেও মানিয়ে নেয়। আর রাস্তাঘাটের জমা তুষা আপনি বুঝে উঠার আগেই তা সাফ হয়ে যাবে।

এই ঠান্ডা পেরোতে না পেরোতেই চলে আসে চেরি ফুলের ফেস্টিভাল। চেরি ফুলের সময়টা জুড়েই থাকে ওদের চেরি নিয়ে উৎসব। কোরিয়ার প্রায় সব শহরগুলোতেই চেরি ফেস্টিভাল হয়। শুধু সময়টা একটু আগে পরে হয়।

সাধারণত চেরি ফুল ফুটতে শুরু করে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আর ফেস্টিভাল শেষ হয় এপ্রিলের মাঝামাঝি। সবচেয়ে মজা হচ্ছে, চেরি ফুলটা ফুটবার পর খুব অল্পদিন থাকে সেটা। ৫-৬ দিন যদি বৃষ্টি না হয়, তাহলে থাকে। আর বৃষ্টি হলেই ঝরে যায়।

পুরো কোরিয়া জুড়েই চেরি গাছগুলো বসানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। সৌন্দর্য বর্ধনটাই ওদের আসল উদ্দেশ্য। পার্কগুলো তো আছেই, সাথে মূল রাস্তার দুই পাশ ধরে সারি করে লাগানো হয়েছে গাছগুলো। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চেরি গাছ থাকে।

কোরিয়ানরা এতোটাই পরিশ্রমী জাতি, তাদের কর্মনিষ্ঠা আপনাকেও অবাক করে দেবে। এত সুশৃঙ্খল জীবনে তাদের আনন্দ-উৎসবের কমতি নেই, জাতীয়ভাবে আয়োজিত হয় সব উৎসব। তারা প্রতিটি কাজে বিনোদন খুঁজে নেয়। আর তাদের বিনোদন বলতে একটু ভিন্ন রকম।

একদিন খুব সকালে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে নদীতে গেলাম। সেখানের ১২ ঘন্টার জন্য ৩০ হাজার উয়ন পে করতে হয়। গিয়ে দেখলাম অনেক লেক মাছ শিকারে ব্যস্ত। রাতে নাকি মাছ বেশি পাওয়া যায়। তাই সারারাত না ঘুমিয় মাছ শিকার করছেন অনেকেই। কাছে গিয়ে দেখলাম অনেক মাছ পেয়েছে। আর কত? সময় শেষ আসছে। একে একে উঠে চলে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার- যাওয়ার সময় সারা রাতের পুঁজি করা সব মাছ সেই নদীতেই ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। সরা রাত মাছের সাথে বিনোদন করে এই কোরিয়ানরা।

দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। এরা তাই খুবই মিতব্যয়ী। প্রয়োজনের বেশি এক ফোঁটা পানিও এরা খরচ করে না। এদের পানির বিলটিতে এত বেশি ডিটেইল থাকে যে মাসের কোনদিন কোন ওয়াশরুমে কতটুকু পানি গোসলের জন্য ব্যয় হয়েছে, সেটাও জানা যায়।

এক বাসায় একজন বৃদ্ধা থাকতেন। একবার পরপর তিনদিন তার বাসায় কোনো পানি খরচ হয়নি বলে তার কমিউনিটিতে জানানো হয়। তারা জানান, বৃদ্ধা বাসার বাইরে থাকবেন এরকম কোনো নোটিশ দিয়ে যাননি। তৃতীয় দিনেই তার বাসায় হাজির হয় পুলিশ, মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় সেই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

কোরিয়ার পুলিশ বিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়েও বেশি আন্তরিক। পুলিশের অনেক বড়সড় কর্মকর্তা অবলীলায় গণপরিবহনে যাতায়াত করেন এবং বিনা দ্বিধায় আপনার জন্য আসন ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। শিশু কোলে নিয়ে কোনো মায়ের যদি সমস্যা হয়, সেই কর্মকর্তা বিনা সংকোচে শিশুটিকে আগ বাড়িয়ে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকবেন। শুধু তাই নয়, আপনি কোথাও যাচ্ছেন। হঠাৎ পথ ভুলে গেছেন, যে কাউকে বললে আপনার হাত ধরে গন্তব্য পৌঁছে দেবে।

কনফুসীয় ও খ্রিস্টান ধর্মগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ২০ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ২৫ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়।

দেশটিতে ৭০ হাজার মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। আর শ্রমিক হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত রয়েছে দেড় লাখ মুসলিম। ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া আরব ধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয়।

প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু শেখার আছে, কোরিয়ানদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হচ্ছি, এখানকার জীবনযাপনই এক মুগ্ধতা।

২০০৮ সালের ২৭ নভেম্বর কোরিয়া সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের করা চুক্তি অনুযায়ী কোরিয়ান ভাষা শিখলে শুধু বিমান ভাড়া দিয়ে এদেশে এসে কাজ করার সুযোগ পান বাংলাদেশি তরুণদের। এ চুক্তির ফলে স্বল্প খরচে কোরিয়া যাওয়ার যেমন সুযোগ মেলে তেমনি মাস শেষে মোটা অঙ্কের বেতন বেকার যুবকদের ভালোভাবেই আকৃষ্ট করে। বেকারত্ব ঘোচানো আর পরিবারকে বাড়তি উপার্জনের স্বাদ দিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অনেক তরুণ পাড়ি জমায় দক্ষিণ কোরিয়ায়।

দক্ষিণ কোরিয়ার এই উন্নতির পেছনে শিক্ষার উন্নতমান ব্যাপক অবদান রেখেছে। তাই সারাবিশ্বে প্রচুরসংখ্যক ছাত্রছাত্রী ক্যারিয়ার গড়ার জন্য কোরিয়াতে পড়াশোনা করতে আসে। বর্তমানে ১৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাখেরও বেশি বিদেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। দক্ষিণ কোরিয়াতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশির সংখ্যা ও অনেক, যাদের অধিকাংশই বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি করছেন।

লেখক: দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

প্রবাসের খবর এর সর্বশেষ

ভেনিসে আব্দুল্লাপুর আঞ্চলিক সমিতির ষষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ 

ইতালিতে ফেনী জেলা সমিতির ইফতার

ইতালিতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ভারেজ প্রভিন্সের ইফতার মাহফিল 

ইতালিতে ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

সুইজারল্যান্ড আ. লীগের জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন

বৃহত্তর বরিশাল জনকল্যাণ সমিতি বাহরাইনের উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল 

ইতালির বলোনিয়া বিএনপির উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল

জার্মানিতে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পেলেন ড. গোলাম আবু জাকারিয়া

সুইজারল্যান্ড আ. লীগের বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন

শিশুদের প্রগতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের অঙ্গীকার: রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :