এইচএসসি; ‘খারাপ’ রেজাল্টই জাতির জন্য ভালো

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৮, ১২:১৯

শেখ আদনান ফাহাদ

২০১৮ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রেজাল্ট নাকি ‘খারাপ’ হয়েছে? খারাপের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে বোধ হয়। যে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, প্রশ্ন মানসম্পন্ন হয়েছে এবং প্রকৃত মেধাবীরা বৈতরণী পার হতে পেরেছে, সে পরীক্ষার রেজাল্টকে ‘খারাপ’ বলা হচ্ছে! কম জিপিএ ফাইভ পেয়েছে কিংবা কম পাশ করেছে বলে কেউ কেউ হয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে হতাশ হতে পারেন। আমি কিন্তু জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এবারের পরীক্ষা এবং পরীক্ষার ফলকে সুদিনের আগমনী বার্তা হিসেবে দেখছি।

টানা প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে এসে দারুণ একটি পাবলিক পরীক্ষা দেখল জাতি। সরকারের সমস্ত অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল প্রশ্নফাঁস এর ঘটনাগুলো।  পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ছড়াছড়ি দেশপ্রেমিক মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছিল। দেশের সৎ মানুষগুলো কষ্ট পাচ্ছিল, সন্তান ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভেবে।

গণমাধ্যমে বহু আগে থেকে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা এগুলো পাত্তা দিচ্ছিলেন না। খুব খারাপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল পরীক্ষার প্রশ্ন ব্যবস্থাপনার। পরীক্ষার্থীদেরকে ওপেন প্রশ্ন সমাধান করতে দেখা যাচ্ছিল সেন্টারের বাইরে। দেশপ্রেমিক, সৎ মানুষ বিস্ময়ে, কষ্টে মুষড়ে পড়ছিল। কোনোভাবেই যেন প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যাচ্ছিল না। অবশেষে ২০১৮ সালে এসে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে পেরেছে সরকার। যদিও প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই ছিল কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক কাজ, কিন্তু প্রশ্নফাঁস এমনই নিয়মিত আর স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল যে, প্রশ্নফাঁস না হওয়াতেই বরং আমরা এখন সরকারের প্রশংসা করছি। বিশেষ ধন্যবাদ এর দাবি রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। শিক্ষক, অবিভাবক, কর্মকর্তা আর শিক্ষার্থীদের বিবেক-যুক্তি কাজ করে না, সেইখানে প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশনই ভরসা।

উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা’ ২০১৮ এর ‘খারাপ’ রেজাল্ট এর দিকে একটু নজর দেয়া যাক। চলতি বছর এইচএসসি ও সমনার পরীক্ষায় পাসের হার আগের বছরের তুলনায় ২.২৭ শতাংশ কমেছে। জিপিএ ফাইভ কমেছে আট হাজারের বেশি। শতভাগ পাস এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ১৩২টি কমে হয়েছে ৪০০টি। গত দুই বছর ধরেই পাসের হার জিপিএ ফাইভ কমছে। আগের বছর পাসের হার ৫.৭ শতাংশ এবং জিপিএ ফাইভ কমেছিল প্রায় ৩৯ শতাংশ।

ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে,  এতে অনেক ‘শিক্ষা বিশেষজ্ঞ’ বলছেন, রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। পাঁচ কারণে এবার এইচএসসিতে তুলনামূলক ফলাফল খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদরা। কারণগুলো হল- পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় বদল, হলে কড়াকড়ি, খাতা মূল্যায়নে ‘যথার্থতা’ বজায় রাখা, সংখ্যার বদলে মানের দিকে মনোযোগ দেয়া এবং ইংরেজি, আইসিটি ও বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোতে পাসের হার কম থাকা।

আসলে এই রেজাল্টকে খারাপ বলা যাবে না। বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় বলা যায়, অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট হয়েছে এবার। অযোগ্য, অসৎ পরীক্ষার্থীরা অসৎ শিক্ষকদের সহায়তায় এবার পাশ করতে পারেনি। যারা পাশ করেছে সবাই নিজের মেধা ও শ্রমের  বিনিময়েই করেছে। সংখ্যা নয়, আমাদের মানের উপর নজর দিতে হবে।  বহুদিন পর স্বস্তির সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফলাফল তুলে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন,  শিক্ষার মানের দিকে তারা এখন বেশি মনযোগী। খাতা দেখায় এখন কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে। তার মানে, আগের পরীক্ষাগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি। আগে মনোযোগ ছিল জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়ানো।

বরাবরের মতই সবচেয়ে বেশি ফল খারাপ হয়েছে বিজ্ঞানে। প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছর বিজ্ঞানে পাসের হার ৮১.৮২ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৮৮.৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিজ্ঞানের পাসের হার কমেছে ৬.৫৪ শতাংশ। মানবিক বিভাগে এবার পাসের হার ৫৫.২৩ শতাংশ, গত বছর তা ছিল ৫৬.৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ এ বছর এই বিভাগে পাসের হার কমেছে ১.৩৬ শতাংশ। বাণিজ্যে এ বছর পাসের হার ৭০.৫৭ শতাংশ এবং গত বছর ছিল ৭৪.৫০ শতাংশ। এ হিসাবে এ হার কমেছে ৩.৯৩ শতাংশ। আর বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে এবার পাসের হার ৮৬.১৫ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৯২.১৭।

রসায়নে পাসের হার ৯৪.৩৫ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৯৭.৫৮ শতাংশ; উচ্চতর গণিতে পাসের হার ৮৭.৫ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯৫.৮৯ শতাংশ, জীববিজ্ঞানে পাসের হার ৯৪.৭ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯৬.৯৩ শতংশ। আইসিটিতে এ বছর পাসের হার ৮২.৮৩ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮৮.৫৪ শতাংশ।

শিক্ষামন্ত্রী ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, ‘আমরা ভালো করে দেখে কারণ খুঁজে বের করব। আগে গণিতে, ইংরেজিতে বেশি পাস করতো না। আমরা ‘সেকাপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে আলাদা শিক্ষক দিয়ে আলাদা ক্লাস করিয়েছি। আস্তে আস্তে সবাই তারা পাস করছে। একটা দিকে বাড়াতে গেলে আরেকটা দিকে চাপ পড়ে।’

‘এখন আমরা গুণগত মানের দিকটায় গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা ক্লাস নেওয়া ও ভালোভাবে পরীক্ষা নেওয়ার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ঠিকভাবে যেন খাতা দেখা হয়, সেদিকে নজর দিচ্ছি। যা বাস্তব, যা সত্য সেই ফল বেরিয়ে এসেছে। আমরা কাউকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলি না, কমাতেও বলি না। আমরা শিক্ষকদের বাধ্য করছি সঠিক মূল্যায়নের।’

গ্রামের দিকে অংক, বিজ্ঞান আর ইংলিশে রেজাল্ট খারাপের কারণ সেই পুরনো, ভালো শিক্ষকের অভাব, বিজ্ঞানাগারের অভাব। যদি সরকার ভালো বিজ্ঞানাগার স্থাপন করেও দেয়, ভালো শিক্ষক না থাকলে রসায়ন, পদার্থ, উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞান পড়ানো কিংবা ব্যবহারিক পরীক্ষা যথাযথভাবে নেয়া হয় না। দরিদ্র বাবা-মা অনেক টাকা খরচ করে ভালো প্রাইভেট টিউটর রাখতে পারেন না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইদানিং ম্যানেজিং কমিটিগুলো নিয়োগ বাণিজ্য করে। টাকার বিনিময়ে ভালো প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তদুপরি সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে গুলো একটু দূরের জায়গায় অবস্থিত, সে গুলোতে শিক্ষকরা যেতে চান না নিয়মিত। দূরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইনকাম কম, গরীব মানুষের সন্তানেরা বেশি টাকা দিয়ে প্রাইভেট পড়তে পারে না । আবার দরকারের তুলনায় সরকারি শিক্ষকের সংখ্যাও কম।         

শেখ হাসিনার সরকার অনেক অসাধ্য সাধন করেছে গত ৯ বছরে। বিডিআর বিদ্রোহ দমন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার, ভারত ও মিয়ানমারকে পরাজিত করে বিশাল সমুদ্র সীমা বিজয়, দারিদ্র বিমোচন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি নানা অর্জন দেশবাসীকে যেমন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য তেমনি হতাশ করেছিল। তবে এবারের এইচএসসি পরীক্ষা নিশ্চয় দেশবাসীকে আরও উৎসাহ দিবে। তবে শুধুমাত্র প্রশ্নফাঁস ঠেকিয়ে দেয়ার মধ্যেই আমাদের সাফল্য সীমিত থাকলে হবে না। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে আরও কর্মমুখী করা যায়, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।