পুরুষের প্রথম পাপ আর ঝিঙে ফুল

জাকির হোসেন সেলিম
 | প্রকাশিত : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৮:৩৩

রাশেদ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এটাকে কোন মতেই একটি বিমান বন্দরের অংশ বলে মনে হয় না । বড় জোড় একটি সুপার মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজে যাবার পথ হতে পারে । তবে, জায়গাটুকু দেখে ভেতরের বিশালতা সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যাবে না । সবাই বিভ্রান্ত হবে । সত্যিই তাই, হিথ্রু তিন নম্বর টারমিনালের ভেতরটা বিশাল, সেই তুলনায় এরাইভালের সামনে জায়গাটা সংকীর্ণই বলা যায়; যেখানে এই মূহুর্তে রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে । আন্ডার গ্রাউন্ড দিয়ে এক মাথা রোদ নিয়ে রাশেদ রাস্তায় বের হয়ে আসে । সময় বিকাল আটটা, মাথার উপর দুপুরের রোদ ।

স্বাগতম লন্ডন ।

এরাইভালের এই জায়গাটুকু পার হতে হতে রাশেদ আশপাশে তাকিয়ে দেখেছে । কেউ নেইম প্লেট হাতে অপেক্ষা করছে । কেউ এক গুচ্ছ ফুল হাতে অপেক্ষা করছে । এক প্রকার মিলন, পরিবার পৃর্ণ হবে কিংবা কাজের প্রয়োজনে, সবাই অপেক্ষা করছে । তার জন্য কেউ কখনও অপেক্ষা করেনি । রাশেদ মনে করতে পারে না ।

তোমার বাগান নাকি ?

তা বলতে পার । বাড়িটা যেহেতু আমার । রোদেলা জবাব দেয় ।

রাশেদ বোকার মতোই প্রশ্নটা করেছে, রাশেদ বোকা না । হঠাৎ রোদেলার বাসায় চলে আসাতে মনে হচ্ছে তার চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে । প্রশ্নটা হঠাৎ করে ফেলেছে, ঠিক ভেবে করেনি প্রশ্নটা । অপেক্ষা, রোদেলা অপেক্ষা করছে, রাশেদ কখন আগের অবস্হায় ফিরে যাবে । আবার সেই আগের রাশেদ । আবেগী, দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখবে ।

রোদেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে । বোধ হয় দেরী হয়ে গেছে ।

চল, তোমাকে বাগান দেখাই ।

আমি সামারে কিছু সব্জির গাছ লাগাই । বেশ কষ্ট হয় যত্ব নিতে । সব সময় যে কষ্ট বিফলে যায়, তা না । কিছু সব্জি পাওয়া যায় । ব্যস্ত থাকাও হলো, সাথে যা পাওয়া যায় বাড়তি; সামারের লম্বা দিন ফুরাতে চায় না ।

একা লাগে ।

রাশেদ রোদেলাকে অনুসরন করছিল । রোদেলার শেষ কথাটা শুনে একটু থমকায়, রোদেলাকে এক পলক দেখেও নেয় ।তার শেষ কথাটা তার মাথায় ঢুকে গেছে,

একা লাগে ।

রোদেলার কেন একা লাগে ?

ব্যাকইয়ার্ডে চমৎকার গুছানো বাগান । বাগানটা বেশ বড়, ইউ আকৃতির পায়ে চলার পথ আছে । বাগানের ঠিক মাঝে খানে বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ, ফুল ফুটে আছে । রাশেদ গোলাপ ফুল চিনে, অন্য ফুল গুলি রাশেদ চিনতে পারছে না । তিন পাশের সীমানা বরাবর সারিবদ্ধ ভাবে সব্জি গাছ লাগানো । লতানো সব্জি গাছের জন্য মাচা তৈরী করা আছে । চমৎকার লাগছে দেখতে । খুব দূরে চোখ না গেলে মনে হবে গ্রামের কোন বাড়ির চমৎকার এবং সমৃদ্ধ কোন উঠানে দাঁড়িয়ে আছে ।

কি কি সজ্বীর গাছ লাগানো হয়েছে ? রাশেদ রোদেলাকে ভাব বাচ্যে জিজ্ঞেসা করে ।

রোদেল বোধ হয় শুনতে পায়নি । রোদেলা একটা লতানো গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে । রাশেদ বাগানের গাছ গুলি চিনতে চেষ্টা করে । এখানেও একই অবস্হা । রাশেদ মাচার নীচে জমিনে লাগানো লাল শাক আর মাচায় লতানো লাউ গাছটা চিনতে পারছে । আরো কিছু গাছ আছে, সে চিনতে পারছে না । ফুল গাছ গুলি না চিনলেও সব্জি গাছ গুলি তার চেনা উচিত ছিল, তার জন্ম গ্রামে না হলেও শক্ত বাঁধন ছিল গ্রামের সাথে । বহুবার গ্রাম গেছে । গ্রাম তার ভাল লাগত । আসলে তার দেখার চোখ নাই, অনেক কিছু এড়িয়ে গেছে । যা দেখার দরকার ছিল তা দেখা হয়নি ।

একটা লতানো গাছে অনেকগুলো হলুদ ফুল ধরেছে । চমৎকার লাগছে দেখতে । রাশেদ ইউ আকৃতির পায়ে চলার পথ থেকে নেমে মাচার কাছে যায় । রোদেলার কাছে । রোদেলাও বোধ হয় এই ফুল গুলি দেখছে ।

এই গুলো কি ফুল ?

তুমি এই ফুল গুলো চিনতে পারছ না ? এই ফুল নিয়ে নজরুল কবিতা লিখেছেন । তুমি তো সাহিত্য পড়তে । সব ছেড়ে দিয়েছ নাকি ?

না, সময় পেলে বই পড়ি । সাহিত্য টাহিত্য কিছু না । বই পড়ার নেশা ছাড়া যায় না । সত্যি চিনতে পারছি না । কি ফুল ?

ঝিঙে ফুল ।

লন্ডনে কখনও ঝিঙে ধরে না । অন্য কারো গাছে ধরে কি না আমার জানা নাই । আমার গাছে কখনও ধরে নাই । তবু প্রতি বৎসর আমি ঝিঙে গাছ লাগাই । ফুল ধরে, অনেক ফুল ফুটে । কুমড়ো ফুলের বড়া খাওয়া যায় । ঝিঙে ফুলের বড়া খাওয়া যায় কিনা জানিনা । ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় না । গাছেই থাকে, এক সময় গাছেই শুকিয়ে যায় ।

ইন্টারেসটিং ! মনে হচ্ছে তুমি ঝিঙে ফুলের গল্প বলছ ? ঝিঙে না ধরলে গাছ লাগিয়ে কি লাভ ?

লাভ ? রোদেলা হাসে, কিছু বলে না; সে প্রসঙ্গটা বদলায় না, ঝিঙে ফুল নিয়ে কথা বলে যায় ।

ঝিঙে গাছে ফল আসে ফেব্রুয়ারি হতে এপ্রিল পর্যন্ত । সে সময় লন্ডনে ঠান্ডা থাকে । ঠান্ডাতে গাছ জন্মায় না । এখন জুন মাস, গাছ দেরী করে লাগানো হয়েছে । এখন গাছে ফুল ধরবে, অনেক ফুল ফুটবে; ফল হবে না ।

রাশেদ হ্যাঁলো ইফেক্ট- এ আক্রান্ত হয় । ঝিঙে ফুল তারও ভাল লাগতে শুরু করেছে । আসলেই দেখতে ভাল লাগছে । শেষ বিকালের এই ম্লান আলোতে মনে হচ্ছে ফুল গুলি ক্ষণে ক্ষনে রঙ বদলাচ্ছে ।

রোদেলা কথা বলতে বলতে লাউ গাছ হতে দুইটা ফুল ছিঁড়ে নেয় ।

এইটা কি করলে ? এই না বললে ফুল ছিঁড়তে ভাল লাগে না ! ফুল ছিঁড়লে কেন ?

রোদেলা হাসে । ফুল ছেঁড়ার কারন আছে, দেখ কি করি । পরাগায়ন, এই দুইটা পুরুষ ফুল; পুরুষ ফুলের পরাগ স্ত্রী ফুলের রেণুর সাথে মিলাতে হবে ।

তাই বলো ? দুইটা পুরুষ ফুলের মৃত্যু ! কি কষ্ট ! কারো উদর ভরাতে নিজেকে উৎসর্গ করে গেল । বেচারা ! কেন, পোকা-মাকর, মৌমাছি এই সব আসে না ? তা হলে তো ফুল ছিঁড়তে হতো না ।

পোকা-মাকর আসে, তবে হঠাৎ হঠাৎ; মৌমাছিও দেখা যায় । এই দেশে ফুলের রঙ আছে, গন্ধ নেই । পতঙ্গদের আকৃষ্ট করতে পারে না । অনেকটা রূপ আছে গুন নেই নারীর মতো ।

নারী কে টেনে আনলে কেন ? নর-ও তো হতে পারে, তাই না ? রূপবান ছেলে, রূপ আছে ঠিকই, গুন নাই ।

রোদেলা রাশেদের এই রূপটা পছন্দ করে না । রাশেদের যুক্তি আর লজিকের দুনিয়া; তার অসহ্য লাগে । সে ঠিক করে, রাশেদকে বুঝাতে হবে জীবনে সব কিছুতে লজিক খুঁজতে নেই । রাশেদ আগেই ভাল ছিল । আবেগী, কথায় কথায় যুক্তি খুঁজতো না । কথার পিঠে কথা বলত না । আপাতত, এই প্রসঙ্গে কথা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় রোদেলা; তবে নিজেকে মনে করিয়ে দেয়, ঠিক সময় মত রাশেদকে ধরতে হবে । দুই জনেই কিছুটা সময় চুপ থাকে । কথা চালা চালির এই ছোট্ট বিরতি রোদেলাকে আনমনে করে দেয়, সে প্রতিজ্ঞা ভুলে যায় । সে ক্ষানিক আগে যা করবে না বলে ঠিক করেছিল তাই করে বসে। রাশেদকে প্রশ্ন করে ।

কি যেন বলছিলে ? ঝিঙে না ধরলে গাছ লাগিয়ে কি লাভ ? সব কিছুতেই শুধু লাভ খুঁজ কেন ?

রাশেদ কিছু বলে না । সে কেবল রোদেলাকে দেখে । রোদেলা এখন ঝগড়া করার মুডে আছে । রাশেদ পিছু হটে । ভাবে, কি লাভ ? তার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না । তার চেয়ে এই ভাল, সে রোদেলাকে দেখে । এখানে লাভ আছে, এই নারীর সঙ্গ সে প্রত্যাশা করে ।

রাশেদ কেন রোদেলার সঙ্গ প্রত্যাশা করে ?

একক কোন কারণ নেই । রাশেদ রোদেলাকে পাগলের মতো ভালবাসতো । রোদেলা তাকে ভালবাসতো না । তারপরও তারা বন্ধুর মতো ছিল । তারা এক সময় কিছুটা কাছাকাছি এসেছিল । প্রেমিক প্রেমিকার মতো না, কিছুটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং । রোদেলাকে বিয়ে করতে চায়; এতোটুকু বলার মতো কাছাকাছি । রোদেলা তার মার সাথে কথা বলতে বলেছিল । রাশেদ বুঝতে পারছিল, তার ব্যাপারে রোদেলার নিজের কিছুই বলার নেই ।

রাশেদ রোদেলার মায়ের কাছে যায়নি । তার মনে হয়েছিল রোদেলা নিজের ‘না’ কথাটা মাকে দিয়ে বলাবে। ‘হ্যাঁ’-ও হতে পারতো, রোদেলার শারিরীক ভাষা অবশ্য রাশেদকে সেটা বিশ্বাস করাতে পারেনি । রাশেদের হিসাবে কোন ফাঁক ছিল না । রোদেলা রাশেদকে কখনও প্রত্যাশা করেনি ।

সে কেন প্রত্যাশা করে ? ভালবাসা ব্যাপারটাই আজব !

রোদেলার অনেক অহংকার ছিল । ভাল ছাত্রী হবার অহংকার, সুন্দরী হবার অহংকার । রাশেদের মতো অনেকেই তার পেছনে ছিল । সঠিক সংখ্যা রাশেদ জানে না, নেহায়েৎ কমও ছিল না, শুধুই অনুমান ।

হঠাৎ করেই রোদেলার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় । ইন্জিনিয়ার ছেলে, ঘর ভাল, বংশ ভাল । নিজের বিয়ের কথা রোদেলা তাকে একবারও বলেনি । রাশেদের পাগলামি শুরু হয় সেখান থেকেই । রাশেদের মনে হচ্ছিল, স্রেফ এটা হতে পারে না । তার রোদেলাকে অন্য কেউ আদর করবে, রোদেলা অন্য কারো প্রতিক্ষায় থাকবে; রাশেদ মেনে নিতে পারছিল না । মানুষের চরিত্রের অতি আদিম রূপ । নারীর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ।

রাশেদ, রোদেলার বাসায় ছুটে গিয়েছিল । রোদেলার হাতে ধরেছিল । রোদেলার মায়ের হাতে ধরেছিল । কান্নাকাটি, অভিমান, মরে যাওয়ার হুমকি; কোন কাজ হয়নি । সে নিজের বয়স, অবস্হা বিস্মৃত হয়েছিল । পাগলামি করার বয়স তার ছিল না । তবুও রাশেদ পাগলামি করেছিল । রোদেলার গায়ে হলুদের দিন পাগলামিটা একটু বেশীই করেছিল। রোদেলা একজন কর্ণেলের ভাতিজি, এই তথ্যটা রাশেদের কাছে ছিল না । সে যখন চাচা-ভাতিজীর সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে পারে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে । পুলিশের মার আর সাতষট্টি দিনের জেল কেউ ঠেকাতে পারেনি । তার বড় ভাই দিনের পর দিন থানা পুলিশ আর কোর্টের বারান্দা দিয়ে হেঁটেছেন । সেই কারনেই জেলে থাকাটা আর দীর্ঘায়িত হয়নি । নতুন চাকুরী টিকেনি, কেস-টেস করে পাওয়া যেত । রাশেদ হয়তো নিজেকে নির্দোষ প্রমান করাতে পারতো । আইনের মার প্যাঁচে অনেক কিছুই সম্ভব ।

কিন্তু নিজের কাছে ? রাশেদ নিজের কাছে কি জবাব দেবে ?

রাশেদ নির্দোষ ছিল না, সে জানে । সে রোদেলাকে ভালবাসতো, রোদেলা তাকে ভালবাসতো না জেনেও, সে বাড়াবাড়ি করেছে । পুলিশের মার তার পাওনা ছিল । সংঘাতের চিত্রনাট্য হতে রাশেদ পালিয়ে যায়, নিজেকে প্রমানের চেষ্টা করে, তবে একটু ভিন্ন ভাবে ।

নাটকের এই অংশে রোদেলার চরিত্রটাও শেষ হয়ে যেতে পারতো । রোদেলা চরিত্র ছাড়াই নাটক চলতো । শেষ হয় না, রোদেলা চরিত্র রয়ে যায় । রাশেদের সাথেই রোদেলা চরিত্রটা চলতে থাকে, সমান্তরাল ।

প্রায় বৎসর খানেক পর হবে, রাশেদ তখন ঢাকায় । দুপুর বেলা বাসায় ঢুকেই রোদেলাকে দেখে । বসার ঘরে বসে আছে, সাথে ভাই, ভাবী । মনে হচ্ছে তিন বন্ধু চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে । সবাই হাসি খুশী । তাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায় । ব্যাপারটা এমন, তিন বন্ধু আড্ডা দিচ্ছে হঠাৎ মুরুব্বি গোছের কেউ চলে আসাতে তাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে । রাশেদ ঘরে ঢুকতেই ভাই আর ভাবী উঠে চলে যায় । রোদেলা একা বসে থাকে ।

রোদেলা-রাশেদ; দুই জন পরস্পরকে দেখে । রাশেদ রোদেলার সামনের সোফায় বসে ।

কেমন আছ ? রাশেদ প্রথম কথা বলা শুরু করে ।

রোদেলা রাশেদের দিকে চেয়ে আছে । সে কিছু বলে না ।

রাশেদ নিজের মাঝে রোদেলাকে খুঁজে, বিশেষ ভাবে খুঁজে; পায় না । নিজের ভেতরে খুঁজার ঘটনাটা হঠাৎ করেই ঘটে ।রাশেদের অবচেতন মন কাজটা করে । রাশেদ বিশ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে, রোদেলা তার মাঝে নেই । সে আর রোদেলাকে ভালবাসে না, রোদেলার প্রতি তার কোন ঘৃনা বোধও নেই । রাশেদ স্বাভাবিক ভাবে রোদেলার সাথে কথা বলে । রোদেলার জন্য বিষয়টা প্রত্যাশিত ছিল না ।

এইটা কোন রাশেদ ?

সে বরাবর রাশেদের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে অভ্যস্হ । বিষয়টা তাকে ভীষন ভাবে ভাবায় ।

রোদেলা রাশেদের পরের প্রশ্ন গুলোর জবাব দেয় । স্বাভাবিক ভাবেই দেয় । রোদেলার মনে হচ্ছিল, তার পরিচিত রাশেদ হারিয়ে গেছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে । রাশেদকে পুনরায় আবিস্কার করতে হবে ।

সেই স্বাভাবিক কথাবার্তা আজো চালু আছে । সব সময় তাদের যোগাযোগ ছিল; তাদের যোগাযোগ আজো বন্ধ হয়নি ।

রাশেদ জানে, রোদেলার সেপারেশন হয়ে গেছে । দেশে একটা চাকরী করতো, ছেড়ে দিয়েছে । দেশের বাইরে চলে এসেছে, পিএইডি করেছে; এখন এখানেই চাকুরী করছে । রোদেলা লন্ডন থাকে ।

রাশেদের এবার কার লন্ডন আসাটা কাজের প্রয়োজনের চেয়েও বেশী । জার্মানীতে তিন দিনের ট্যুর ছিল । আমেরিকায় ফিরে যাবার আগে রোদেলার সাথে দেখা করবে বলে ঠিক করে ।

দীর্ঘ দিন পর সামনা সামনি রোদেলাকে দেখবে । তার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার ।

রোদেলা রাশেদকে লন্ডন আসার জন্য অনেক বার বলেছে । রাশেদ আসেনি । কাজের ব্যস্ততা তো ছিলই, সেটাকে উপেক্ষা করার মতো নিজের ভেতর থেকে কোন তাগিদও অনুভব করেনি ।

আজ রাশেদ লন্ডনে নেমে সরাসরি রোদেলার বাসায় চলে এসেছে । একটু ভাবনা ছিল, রোদেলা যদি বাসায় না থাকে ! উইক ডে, বাসতেই থাকার কথা, না থাকার সম্ভাবনা কম ছিল । লন্ডন শহরে কেউ হারায় না, প্রচলিত প্রবাদ । কথাটা সত্যি । পোষ্ট কোড আর ডোর নাম্বার দিলে টেক্সি দরজার সামনেই নামিয়ে দিবে । রোদেলার বাসা চিনতে কোন সমস্যা হয়নি । রোদেলা বাসাতেই ছিল । কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেয় । সামনে রাশেদকে দেখে জমে গিয়েছিল । মনে হয় বিশ্বাস করতে পারছিল না ।

এবারের দেখাতেও রাশেদ প্রথম কথা বলা শুরু করে ।

ভেতরে যেতে দিবে তো ! নাকি ?

রোদেলা বুঝতে পারছে রাশেদ কিছু ভাবছে । সে রাশেদকে কাছে ডাকে,

এই যে বাবুটা ! বাগান দেখবে না ? এই দিকে আস । রোদেলা চমকে উঠে, সে রাশেদকে বাবুটা ডাকছে কেন ?

রাশেদ রোদেলাকে দেখে । বাগানের অন্য কোনায় দাঁড়িয়ে আছে । তারা একসাথেই ছিল ।

তুমি এইটা দেখেছ ? রাশেদ কাছে যেতেই বলে ।

কি জিনিস, শুকনা লতা?

গত বৎসর ঝিঙে গাছটা এখানে লাগিয়ে ছিলাম । দেখ শুকিয়ে কেমন রশির মতো ঝুলছে ।

রাশেদ হাত দিয়ে লতাটা ধরে দেখে । সে বুঝতে পারে না, রোদেলা তাকে কেন শুকনা ঝিঙে লতা দেখাচ্ছে ।

কি দেখাতে চাচ্ছ ? শুকনো লতা পাতা ?

ঠিক তা না । তোমাকে শুকনো ফুল দেখাতে চাইছি । গত বৎসর এই সময়ে লতাটা শুকনো ছিল না । ঠিক ঐ মাচার মতো হলুদ ফুলে ফুলে সজ্জিত ছিল । মৌমাছিও আসতো, গন্ধ না থাকলেও আসতো; রঙের আর্কশনেই হয়তো । দেখ, এখন কেমন দেখাচ্ছে? কোন রঙ নাই, শুকিয়ে গেছে, যে কোন মূহুর্তে নিঃশেষ হয়ে যাবে । সময় সব কেড়ে নিয়েছে ।মৌমাছি তো দূরের কথা এখন কোন পোকা মাকরও আসে না ।

আমার বাসার নম্বরটা ছত্রিশ, ঠিক পাশের বাড়ীর নম্বর আটত্রিশ । এক বুড়ি থাকে । বিরাশি বৎসর বয়স, সাথে এক আ্যলসিশিয়ান কুকুর । বুড়ো মারা গেছে চার বৎসর আগে । তিন জন ছেলে মেয়ে আছে । তারা কেউ বুড়িকে দেখতে আসে না । বয়স হলেও বুড়ি এখনও শক্ত পোক্ত আছে । কুকুরের সাথেই সময় কাটায় । শুধু রাত্রে ঘুমাতে ভয় পায় । তার ধারনা সে ঘুমের মধ্যে মারা যাবে । রোদেলাকে নিজের ঘরের একটা চাবি দিয়ে রেখেছে । যদি কখনও সময় মত না জাগে, রোদেলা যেন তার ঘর খুলে দেখে ।

রোদেলা রাশেদের মুখামুখি দাঁড়ায় ।

জান রাশেদ, আমার এখনিই ভয় করে । বুড়ির বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকলে কি হবে কে জানে ।

কুকুর আমি পছন্দ করি না । একা একা থাকব কি করে ?

রাশেদ হাসে । রোদেলা রাশেদের হাসিটা দেখতে পায় না । আকাশের রঙ এখন কমলা । এই রঙটুকু মিলিয়ে গেলেই আঁধার নামবে । রাশেদ রোদেলার প্রশ্নের উত্তর দেয় না । রোদেলা বোধ হয় তার কাছে কোন উত্তর প্রত্যাশা করেনি । রোদেলা তার ভাবনার কথা বলেছে । রাশেদ কিছু বলে না, চুপ করে থাকে ।

রোদেলা বুঝতে পারে রাশেদ কেন চুপ করে আছে । সে তার প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাড়া দিতে পারতো । দেয় না । বলে, ঘরে চল । হাল্কা কিছু খেয়ে নেবে । রোদেলা রাশেদকে ডাক দিয়ে যায় ।

রাশেদ, রোদেলার চলে যাওয়া দেখে । রোদেলা চলে যাবার পর বাগানটা কেমন যেন ম্লান হয়ে যায় । বাগানের সব রঙ হারিয়ে যায়, ইষ্টমেন কালার হতে ব্লাক এন্ড হোয়াইট । মনে হয় বাগানটা মোটেই সুন্দর না । আগাছায় ভরা । রোদেলা, কি সব গাছ লাগিয়ে রেখেছে ! ফল ধরার নাম নাই ।

রোদেলা বাগান থেকে সরাসরি কিচেনে ঢুকেছে ।

বাইরে এখনও যথেষ্ট আলো আছে । রোদেলা কিচেনের লাইট জ্বেলে দেয় । রাশেদ বাগানে দাঁড়িয়ে আছে । রাশেদকে ভাবুক ভাবুক লাগছে । রোদেলা দেখে, রাশেদ কিচেনের জানালার দিকে চেয়ে আছে । রোদেলা নিজ মনে হাসে । রাশেদের চাহনি বদলায়নি । সে এখনও রোদেলাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে ।

রাশেদের দৃষ্টিটা বরাবর এমনি থাকবে তো ?

রোদেলা রাশেদের এই দৃষ্টিকে উপভোগ করে । জীবনে, উপভোগের অনেক কিছুই সে পেছনে ফেলে এসেছে । আফসোস !

রাশেদ এখন পুরোপুরি বদলে যাওয়া একজন মানুষ ।

ভালবাসা বিষয়টা কি সব সময় বুঝা যায় ?

প্রশ্নটা রোদেলা নিজেকেই করে । সবাই কি সব সময় বুঝতে পারে, সে কাকে ভালবাসে ?

রোদেলা অন্তত তার ভালবাসাকে চিনতে পারেনি । এখন চিনতে পারছে । রাশেদকে সে কতটা ভালবাসে, বুঝতে সময় লেগেছে । দেরী হয়ে গছে । খুব কি দেরী হয়ে গেছে ? রাশেদ কি তার কাছ থেকে অনেক দূরে সড়ে গেছে ?

রাশেদ আসতো, তার সাথে কথা বলতো । তাদের গ্রুপটা ছিল পাঁচ জনের । কেবল তারা দুই জন পরস্পরকে তুমি করে বলত, অন্য সবাইকে তুই । সবাই এক সাথে থাকলেও বাকীরা তাদের দুই জনকে আলাদা একটু স্পেস দিত । রাশেদ তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতো । রোদেলা যে বুঝতে পারতো না, তা না । সে বুঝতে পারত রাশেদ কি চায় । সেই সময় শুধু রাশেদ না, অনেকেই তার পেছনে ছিল । অনেক গুলো মুগ্ধ চোখ ছায়ার মতো তাকে অনুসরন করতো ।

রোদেলার মাঝে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করত । সে কাকে বেছে নেবে ?

রোদেলা সবার মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল ।

সেই বয়সে মেয়েরা একটা ঘোরের মধ্যে থাকে । মন আর চোখ কল্পনার রাজপুত্রের সন্ধান করে । সত্যিকার রাজপুত্রের অস্তিত্ব নেই,বুঝতে সময় লাগে । কেউ তার কাছে আসতে চাইলে কল্পনার রাজপুত্রের সাথে তুলনা করে । মিলে না, বাতিল করে দেয় । সে সময় কাউকেই মনে ধরে না । বাছাই চলতে থাকে । ভাবনাটা এমন যে তার বর স্পেস থেকে আসবে, নিদেন পক্ষে কোন ডাক্তার কিংবা ইন্জিনিয়ার । কোন বান্ধবীর বর যদি হয় চাহিদা মতো, তা হলে মেয়েটির বর নির্বাচন প্রক্রিয়াটা আরো কঠিন হয়ে যায়, সিদ্ধান্তটা চট করে নিতে পারে না । সেই সময় নিজ বয়সি একজনকে মনে ঠাঁই দেয়া কষ্টকর, মন মানতে চাইতো না । রাশেদ তার সম বয়সি ছিল ।

মেয়েদের এই ভাবনা জগত বদলাতে থাকে, বয়স বাড়তে থাকে; বিয়ে হতে দেরী হয় । স্বপ্নের রাজপুত্র, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার আসে না; এক সময় পছন্দটা নেমে আসে এক রকম হলেই হলো-তে । পছন্দের প্যারামিটার লিম্নমুখী, ঘরে এলইডি টিভি নাই, ছোট্ট রেডিও তো আছে; এফ এম ব্র্যান্ডে গান শুনা যাবে, মন্দ কি ! যারা প্রেম করে বিয়ে করে, এই সব তাদের জন্য না । প্রেমিক যুগল কখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে না । ডাইরেক্ট অ্যাকশনের বিশ্বাসী, ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ । এরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারে । কখনও কখনও সিদ্ধান্তটা ভুল হয়, হতে পারে; তারপরও তাদের এক ধরনের আত্ব-তৃপ্তি থাকে । সিদ্ধান্তটা সে নিজে নিয়েছে । রোদেলার মতো যারা, সমস্যাটা তাদের; তারা বরাবর চরম দ্বিধা দ্বন্ধে ভোগে ।

রোদেলা নিজেও এই সব কিছুর বাইরে ছিল না । শুরুতে তার চাহিদাও উধ্বমুখী ছিল । তার গর্ব করার মতো রূপ ছিল, গুন ছিল । সেই তুলনায় রাশেদকে খুবই সাদামাটা লাগত । অতি আবেগী । শুরু থেকেই তার পেছনে লেগে ছিল, মনে হতো সহজ লভ্য । সময়ের সাথে সাথে তার চাহিদার পারদও নিম্নমুখী হতে শুরু করেছিল । রোদেলা এক ধরনের খেলায় মেতে ছিল । রাশেদ হাতের কাছে ছিল, ষ্ট্যান্ডবাই; তাকে সে সরাসরি না বলেনি ।

হয়তো রাশেদকেই বেছে নিত । রাশেদ তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল । রাশেদের সফলতা নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের কনফিউশন কাজ করতো । ঐ যে দ্বিধা,দ্বন্ধ ! সেই জন্য রাশেদের ব্যাপারটাকে মার বিবেচনার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল । রাশেদকে বলেছিল, তার মার সাথে কথা বলতে ।

রাশেদ এই পর্যন্ত এসে হঠাৎ পিছিয়ে যায় । রাশেদ কেন পিছিয়ে যায়, রোদেলা বলতে পারবে না । হয়তো তার কাছ থেকে সরাসরি কিছু না শুনে ।

হঠাৎ করেই তার কর্ণেল চাচা জাহেদের কথা বলে । ছেলে ইন্জিনিয়ার, ফ্যামিলি ভাল । বয়সও সমীহ করার মতো, তার চেয়ে ছয় বৎসরের বড় । রোদেলার হ্যাঁ বলার আগে মনে একটু খচ খচের মতো ছিল । ছেলের বয়স একটু বেশী । সবাই রোদেলাকে বুঝিয়েছে, ছয় বৎসরের ডিফারেন্সই তো স্বাভাবিক । স্বামীর প্রতি সম্মান থাকবে ।

রোদেলা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যায় । জাহেদের সাথে বিয়ের পাকা কথা হবার পর রাশেদ তার কাছে এসেছিল, তার মায়ের কাছে গিয়েছিল । রাশেদের অনুরোধ কিংবা কান্নাকাটি কোন কাজে আসেনি । রাশেদের কাছে ফিরে যাবার মতো পরিস্হিতি এবং আগ্রহ কোনটাই রোদেলার ছিল না ।

রাশেদ সেদিন ফিরে গিয়েছিল ।

রাশেদ আবার ফিরে এসেছিল ।

স্হায়ী ভাবে রোদেলার মনে জায়গা করে নিতে ফিরে এসেছিল । জাহেদের সাথে কাটানো প্রথম রাতে রোদেলার স্বপ্ন জগত পুরোপুরি বদলে যায় । রাশেদ স্বপ্নের রাজপুত্রের জায়গা দখল করে নেয় । এখন পর্যন্ত তাই আছে, এতোটুকু বদলায়নি ।

জাহেদের সাথে বিয়ের আগে এক বার দেখা হয়ে ছিল । রোদেলা সারা দিন জাহেদের সাথে ছিল । বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে, ক’দিন পর বিয়ে; সেই দিনটা তারা উড়ে উড়েই কাটিয়েছে । এক সাথে কেনাকাটা করেছে । একটা পাঁচতারা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়েছে । জাহেদের কোন অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি । মনে হয়েছিল খুব কেয়ারিং । বার বার ছোট ছোট ব্যাপারে রোদেলার মতামত জানতে চাচ্ছিল ।

রোদেলা খুশী ছিল । বাসর ঘরে টগবগ করে ফুটছিল । তার সংসার ! বিশাল বাড়ি, গাড়ী, সব তার ? বিশ্বাস হচ্ছিল না । ভাল বর, বড় ঘর, জাহেদ দেখতেও সুন্দর, রোদেলার খুশী হবারই কথা । মেয়েরা বাবার বাড়ীকে কখনও নিজের বাড়ি মনে করতে পারে না । জিনগত বৈশিষ্টের জন্যই পারে না । রোদেলা বিষয়টা বুঝে জাহেদের বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে । তার বাবার চেয়ে জাহেদ অবস্হাপন্ন, রোদেলার মনে নিজের শেঁকড়ের প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্য কাজ করে ।

বিষয়টা সব মেয়ে স্বীকার করবে না ।

জাহেদ ঘরে আসে সময় মতই । রোদেলাকে দেখে, টুকটাক কথা বলার পর তাকে কাছে টানে ।

রোদেলার সাড়া না দেয়ার কোন কারন ছিল না । কিন্তু জাহেদের “কাছে” টানার মধ্যে কিছু একটা ছিল, কিংবা জাহেদের চোখে চাহনীতে, কিংবা ছুঁয়াতে । রোদেলা একেবারে শক্ত হয়ে যায় ।

কি ব্যাপার, হ্যাং হয়ে গেলে কেন ? জাহেদ তড়িৎ প্রশ্ন করে ।

রোদেলা জাহিদের দিকে তাকায়, চোখে ভয় ।

কোন ভাইরাস টাইরাস আছে নাকি ? আবার প্রশ্ন করে জাহেদ ।

ভাইরাস শব্দের প্রায়গিক অর্থ রোদেলা পরে বুঝেছে । ইন্জিনিয়ার মানুষ, উদাহরণ দিতে নিজেদের জ্ঞানের বহর জাহির করতে ছাড়ে না । রোদেলার হঠাৎ শক্ত হয়ে যাওয়াকে হ্যাং বলেছে, যেমন করে কম্পিউটার হ্যাং হয়ে যায় । হ্যাং হয়ে যাবার কারন গুলোর মধ্যে একটা হলো ভাইরাস, রোদেলার কোন এক্স আছে কিনা জানতে চেয়েছিল ।

পরবর্তী এক ঘন্টা ধরে অভিজ্ঞ পুরুষের মতোই জাহেদ রোহেলাকে হ্যান্ডেল করে ।

জাহেদের প্রথম দলনেই রাশেদের কাতর মুখটা রোদেলার চোখে ভেসে উঠেছিল । তারপর হতে রাশেদ রয়ে গেছে । সমাজ, পরিবার সব কিছু চিন্তা করে প্রায় দুই বৎসর জাহেদের সাথে কাটিয়ে দেয় রোদেলা । একটা বাবুর বড় শখ ছিল । এই সময়ের মধ্যে বাবু আসার কোন আলামত না দেখে নিজে ডাক্তার দেখিয়েছে । তার কোন সমস্যা নেই । জাহেদকে দেখাতে বলেছিল, জাহেদ গুরুত্ব দেয়নি ।

কি দরকার ,হলে হবে । না হলে হবে না । এতো চিন্তার কি আছে । দুই জনের মাঝে একটা ট্যাপ ট্যাপ ।

ট্যাপ ট্যাপ মানে রোদেলা বুঝতে পারেনি ।

জাহেদের কোন দোষ দেখেনি রোদেলা ।

সবার সাথে চমৎকার ব্যবহার । রোহেলার প্রয়োজনীয় কোন জিনিস না চাইতেই পেয়েছে ।

রোদেলা কেন থাকতে পারেনি জাহেদের সাথে ?

জাহেদ হলো পুরুষ, আদি পুরুষ । যারা বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে । এরা কোন জিনিস চেয়ে খেতে জানে না, নিজেদের পৌরুষ দেখাতে জোড় করে, কেড়ে খেতে চায় । নিজে সুখের নিদ্রা যায়, ভুলে যায় পাশের জন অতৃপ্তি নিয়ে জেগে আছে । সেই দিনগুলোতে রাশেদকে খুব মনে পড়তো । মনে হতো রাশেদ রোদেলার খুঁজ নেবে । রোদেলা রাশেদের সাথে কি আচরন করেছে, ভুলে গেছে, তার কিছুই মনে নাই । তার প্রচন্ড অভিমান হতো ।

কেন রাশেদ তাকে ফোন করে না ?

সে প্রতিটিক্ষণ রাশেদের ফোনের অপেক্ষায় থাকতো ।

মাস দুয়েক পর একদিন কথা প্রসঙ্গে রোদেলা তার মাকে রাশেদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে ।

মা, রাশেদ কি আসে ?

রাশেদ কি করে আসবে ? শুনেছি সে তো জেলে ।

কথাটা শুনে রোদেলার কয়েকটা হার্ডবিট মিস করে । মনে হচ্ছিল সে সত্যি সত্যি হ্যাং হয়ে গেছে ।

কেন মা ? কি করেছিল সে ? কেন জেল হলো ?

রোদেলার মা নড়ে চড়ে বসেন । যথেষ্ট বলা হয়েছে । আর বলা ঠিক হবে না ।

তার আমি কি জানি ?

রোদেলা স্পষ্ট বুঝতে পারে মা কিছু লুকাচ্ছে । মা মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলতে পারে না । চেহারায় চোরনি চোরনি ভাব চলে আসে । এখন এই ভাবটা রোদেলা স্পষ্ট দেখতে পারছে । মাকে ভাল করে চেপে ধরতেই রোদেলা সব জানতে পারে ।

তোর গায়ে হলুদের দিন, মদ খেয়ে টেয়ে নাকি গন্ডগোল করেছিল । তোর ছোট চাচা পুলিশকে কল দিয়েছিল । পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় ।

তুমি আমাকে বলনি কেন মা ?

আমি জানি নাকি যে বলব । রাশেদের বড় ভাই এসেছিল । কেস তুলে নেয়ার অনুরোধ নিয়ে । তখন জানতে পারি । তোর চাচার তো অনেক ক্ষমতা । তোর চাচাকে বলেছিলাম ।

কি বলল ছোট কাক্কু ?

শুধু বলেছিল, দেখি ।

তারপর ?

আর কিছু জানি না । রাশেদের ভাই আর আসেনি ।

রোদেলার পৃথিবী পুরো এলোমেলো হয়ে যায় । জাহেদ বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে । রোদেলা পুরো পুরি জাহেদকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে, জাহেদ আরো বেশী করে জোড় খাটায় । দুই জনের ব্যবধান বাড়ে ।

এক সময় রাশেদের ভাইকে খুঁজে বের করে রোদেলা । নিপাট ভদ্রলোক, রোদেলা কোন জবাবদিহীতার দিকে যায় না । সরাসরি পায়ে ধরে ক্ষমা চায় । বড় ভাই ক্ষমা করে দেন । রাশেদ ততোদিনে দেশের বাইরে ।

রাশেদের সাথে দেখা হয় তের মাস এগারদিন পরে । বড় ভাই খবর দিয়েছিলেন, রাশেদ দেশে এসেছে । রাশেদের ফোন নাম্বার সে জোগাড় করে ছিল । রোদেলা এতোদিন রাশেদকে ফোন দেয়নি, তার ভয় ছিল । রাশেদের আবেগ খুব বেশী, দেশের বাইরে একা থাকে, কি করে বসে । রাশেদের বড় ভাইও চাচ্ছিলেন না রোদেলা ফোন করুক ।

রাশেদের সাথে দেখা হবার পর রোদেলা অবাক হয়েছিল । অতি আবেগী রাশেদের আবেগ চলে গেছে । রোদেলার সাথে পরিচয় হবার পর কখন রাশেদের এতোটা নির্লিপ্ত আচরন দেখেনি ।

রোদেলা বুঝতে পারে রাশেদ অভিনয় করছে না, সে পুরোপুরি বদলে গেছে ।

রোদেলাও রাশেদের সাথে খুব চমৎকার মানিয়ে নেয় । মানিয়ে নেয়ার কাজ আজো চলছে । সেদিন হতে প্রায় প্রতিদিন রাশেদের সাথে কথা বলেছে । জাহেদের সাথে সংসার করার সময়ও সে কথা বলেছে । তার একটুও গিলটি ফিল হয়নি ।

রাশেদ বাগানেই দাঁড়িয়ে আছে । সে রোদেলাকে দেখছে । রোদেলা এখন কিচেনে । রোদেলা কিচেনে গিয়েই আলো জ্বেলে দিয়েছে । মোটা কাঁচের জানালা, বাইরে থেকে ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায় না । রাশেদ বাগানে দাঁড়িয়ে কাঁচের ভেতর দিয়ে রোদেলার ছায়ার নড়া চড়া দেখছে ।

রোদেলা প্রায়শঃ তাকে আনমনা করে দেয় । রাশেদ এখন ক্যাথির সাথে থাকে । সে মাঝে মাঝেই ক্যাথিকে রোদেলা বলে ডাকে । ক্যাথি ‘রোদেলা’ ডাক শুনে জোড়ে জোড়ে হাসে; বলে কোথায় তোমার এক্স ?

শুধু কথা বল, তাকে নিজের কাছে ডাক না কেন ?

সাথে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করে । তুমি কি কখনও অন্য কাউকে ভুল করে আমার নামে ডাকবে ?

রাশেদের কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই । ক্যাথি বড় মনের মেয়ে । বয়স রাশেদের চেয়ে চার বৎসর বেশী । কলেজে পড়ায়, সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়ে থাকে । রাশেদ মনে করতে পারে না, ক্যাথী কখনও তার সাথে জোড়ে কথা বলেছে । শুধু হাসে, জোড়ে জোড়ে হাসে, কোন চাওয়া নেই । তারা নিজেদের জীবনের ফেলে আসা দিন গুলোর কথা পরস্পরের সাথে শেয়ার করে । শীতের সন্ধ্যায় যখন কফির কাপ হাতে নিয়ে বসে, তারা নিজের কথা বলে । আগ্রহের সাথেই বলে, ক্যাথি জানে রোদেলার কথা । রাশেদ জানে হ্যাজার্ন, ডেভিডের কথা । অনেক কথাই তারা বলে না, ফেলে আসা জীবনে অনেক নাম আছে, দুই জনের জীবনেই আছে । বলার মতো ঘটনাও আছে । সেই গুলো তারা পরস্পরকে বলে না । আলাপের শুরুতে বন্ধুদের কথা বলে, তারপর ? আবার ফিরে আসে সেই নাম গুলি । রোদেলা, হ্যাজার্ন আর ডেভিড । ক্যাথি কখনও ভুল করে না, তার হৃদয়ের বাঁধন বড্ড শক্ত, রাশেদকে কখনও অন্য নামে ডাকে না । ক্যাথি শুধু রাশেদের কাছে জানতে চায়, তার নামে অন্য কাউকে ডাকবে কি না ! কেন এই প্রশ্ন ?

কি নেই ক্যাথির ? তবুও এই চাওয়া কেন ? কে কাকে কখন ভালবেসে ফেলে !

রাশেদ ক্যাথিকে মনে করিয়ে দেয়, ক্যাথি যেন ভালবাসার পথে না হাঁটে । সবাই ভালবাসা ক্যারি করতে পারে না ।

রাশেদ পারে না । এক সময় তার প্রচুর আবেগ ছিল, এখন নেই । রাশেদ এখন আবেগ শূন্য মানুষ । ক্যাথির ভালবাসা পাওয়ার জন্য রাশেদ মোটেই সঠিক মানুষ না ।

ক্যাথি হাসে । বলে ফ্যাটি লেডি ভুল করতেই চায় । রাশেদের কি সমস্যা ?

রাশেদও হাসে । ক্যাথিকে দেখে । বড়ই অদ্ভুত । তার আগের দুইটা সম্পর্ক কেন টিকেনি, রাশেদ বুঝতে পারে না । নির্বাচন বোধ হয় সঠিক ছিল না ।

ক্যাথি, কেমন করে যেন রাশেদের জীবনে জড়িয়ে যায় ।

পরিচয় হয় হঠাৎ করেই । সেই সময় রাশেদ কাগজ পত্র পাওয়ার অপেক্ষা আছে । আজ পাবে, কাল পাবে, প্রতি মূহুর্তে অস্হিরতা । সব অনিশ্চিত, হবে; আবার নাও হতে পারে । যদি কাগজ পত্র না পায়, কি হবে ? একেক জনের একেক পরামর্শ । নতুন শহর । পরিচিত লোক জনের সাথে দেখা হলে সেটেল্ডমেন্টের কথা জানতে চায় । কঠিন যন্ত্রণা । রাশেদ, পরিচিত লোকজন এড়িয়ে চলে । কাজ শেষ করে একটা কফি সপে প্রতিদিন বসে থাকে । কখনও কফির পেয়ালা হাতে থাকে । কখনও বাইরের মানুষের চলাচল দেখে ।

বড় দিনের ছুটি চলছে, শীতটাও ঝেঁকে বসেছে । টানা চারদিন তুষারপাত হয়েছে । রাস্তা ঘাটে তখনও বরফ জমে আছে । রাশেদ এসে দেখে কফির দোকান বন্ধ ।

সে ফিরে যাবার জন্য ঘুরে । সামনে রাস্তা শুভ্র, তুষারপাতের চিন্হ । বরফে ঢাকা নিঃসঙ্গ একটা ফোন বক্স দাঁড়িয়ে আছে । কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে, রাশেদ বরফ পরিস্কার করে একটা বেন্চে বসে । তার এই মূহুর্তে কোথাও যাবার জায়গা নেই ।

রাশেদ তখন ক্যাথিকে দেখে । তার বিপরীত দিকে একটা বেন্চে বসা । হাতে একটা বড় প্যাকেট । বার বার ঘড়ি দেখছে ।

আশেপাশে আর কেউ নেই । বড় রাস্তাতে এই মূহুর্তে কোন গাড়ীও চলছে না । রাশেদ নির্বিকার । তার কোন তাড়া নেই । তার ঘড়ি দেখারও দরকার নেই ।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর রাশেদ উঠতে যাবে , ক্যাথি তাকে ডাকে ।

হেই ম্যান,তুমি কি চলে যাবে ?

হ্যাঁ, ঠান্ডা অসহ্য লাগছে ।

আমার কাছে এক বোতল চমৎকার ওয়াইন আছে ।

রাশেদ ঘুরে দাঁড়ায়, কফি সপটাকে দেখে । আজ আর খুলবে বলে মনে হচ্ছে না । কাল আবার ছুটি । ক্যাথিকে দেখে ।

তোমার কাছে ওয়াইন আছে ? আমি কি করব ?

এমন উত্তর ক্যাথি আশা করেনি । সে বুঝতে পারছে না কি বলবে । তবুও শেষ চেষ্টা করে,

আমরা বসতে পারি । তুমি, আমি এক সাথে বসলাম ।

রাশেদের কিছুই করার নেই । তার হারানোর কি আছে ? তারও একটু উষ্ণতা দরকার । নিশ্চিত, এই মেয়েটা হ্যুকার না ।

আমরা কোথায় বসব ?

এবার ক্যাথি রাশেদকে ভাল করে দেখে ।

চল, এখানেই বসি । একটু আড়াল হলে ভাল হতো, নেই । সমস্যা কি ? সন্ধ্যা হয়ে গেছে । আশপাশে কেউ নেই, আমাদের দেখার জন্য । আমরা এখন দ্বীপবাসী, সিটিজেন অফ ইথাকা । হা হা হা । ভাল কথা ইথাকা কোথায় জান তো ?

অপরিচিত কেউ এতো কথা বলে ? রাশেদ জানতো না । ইনফেক্ট সে তখন পর্যন্ত এই মেয়েটি নামও জানেনা ।

ইথাকা কোথায় আমি জানিনা । রাশেদ সত্যি কথা বলে । মেয়েটিকে তার ভাল লাগতে শুরু করেছে । অন্যরকম একটা চরিত্র ।

ওকে, চল বসি । পাবলিক প্লেসে ওয়াইন খেলে পুলিশ জরিমানা করতে পারে । আমার পকেটে টাকা নেই । তুমি দেবে তো ? রাশেদও হাসতে থাকে । রাশেদ মুক্তি খুঁজছিল, সে হাঁপিয়ে উঠে ছিল, পেছনের হতাশা, দেশের মায়া, অনিশ্চিত ভবিষ্যত; ক্যাথি তাকে মুক্তির হাতছানি দেয় । রাশেদ উপেক্ষা করতে পারে নাই ।

ক্যাথি এসেছিল ডেভিডের সাথে দেখা করতে । ডেভিড তাকে কথা দিয়েছিল, সে আসবে । দীর্ঘদিনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল আগেই । গত এক বৎসর ডেভিডের সাথে দেখা নেই । একটা পার্টিতে দেখা, হঠাৎ করেই । ক্যাথি তাকে আসতে বলেছিল । একটা সন্ধ্যা এক সাথে কাটাবে । কথা ছিল আজ তারা আনুষ্ঠানিক ব্রেক আপ করবে । ডেভিড আসেনি ।

সেই সন্ধ্যায়, বয়স্ক দুই জন মানুষ একা হয় । পরস্পরকে নিজেদের নাম বলে, রাশেদ, ক্যাথি । তাদের কাছে কোন গ্লাস ছিল না । পালা করে দুই জন বোতলে মুখ লাগিয়ে ওয়াইন খেয়েছে । ক্যাথির হাতের প্যাকেট থেকে একটা কেকও বের হয়েছিল । দুই জন কেক কেটেছে । সন্ধ্যাটা ওদের ছিল । পরস্পরের কথা তারা জেনেছে অনেক পরে । দুই জনের নিঃসংগতা প্রকৃতি পছন্দ করেনি । প্রকৃতি তাদেরকে মিলিয়ে দিয়েছে ।

প্রায় প্রতিদিন রোদেলার সাথে কথা হয় । রাশেদ অনেক আগ্রহ নিয়ে রোদেলার সাথে কথা বলে । বিচিত্র সব বিষয় । ক্যাথি দেখে রাশেদ প্রায় প্রতিদিন একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে । কখনও কখনও তারা বিভিন্ন আ্যপস ব্যবহার করে । ক্যাথি রাশেদের ভাষা বুঝে না । সে কিছু অনুমান করে, তার বলার কিছু নেই । রাশেদের সাথে তার সম্পর্কের কোন শর্ত নেই । তাদের সম্পর্ক বন্ধনহীন । তারা দুই জনই মুক্ত । কারো স্বাধীনতায় তারা হস্তক্ষেপ করবে না । ক্যাথি অন্য কারো সাথে চলে গেলে রাশেদের কিছু বলার নেই । রোদেলার ব্যপারেও ক্যাথি কোন প্রশ্ন করে না । রাশেদ তাকে রোদেলার ব্যাপারে সব বলেছে। সময়ের সাথে ব্যাপারটা এতোটাই সহজাত হয়ে গেছে যে, ক্যাথি মাঝে মাঝে রোদেলাকে ফোন করার কথা রাশেদকে মনে করিয়ে দেয় ।

রাশেদের সমস্যার শুরু রোদেলার ডিভোর্সের খবর পাওয়ার পর হতে । খবরটা পায় এক বন্ধুর কাছ থেকে । সেই দিনও রোদেলার সাথে কথা হয়েছিল । রোদেলা এমনিতে নিজের ব্যাপারে কিছু বলে না, সেই দিনও কিছু বলেনি । তার রাশেদের সাথে কথা বলতে পারলেই হলো । বিষয় যাই হোক । মাঝে মাঝে রোদেলাকে দেখতে হচ্ছে হতো । স্বাভাবিক চাওয়া । রোদেলার সেপারেশনের খবর পাওয়ার পর হতে তার ইচ্ছাটা তীব্র আকার ধারন করে । রোদেলা নামটা, তাকে এক প্রকার টানতে শুরু করে । ভীষন রকম । রাশেদের দৈনন্দিন কাজের ব্যাঘাত ঘটছে । রাশেদ, ঘুমের সময়টুকু ছাড়া প্রতি ক্ষণে রোদেলাকে দেখছে ।

মন বলছে এই সুযোগ । কিসের সুযোগ ? রাশেদের মনো-জগতে বিশাল তোড় পাড় শুরু হয় ।

স্বামী নেই, তাই কি রাশেদের এমন মনে হচ্ছে ? তার জন্য উন্মুক্ত, সহজ লভ্য ? সে কি রোদেলাকে কখনও এমন দৃষ্টিতে দেখেছে ? শুধুই কি শরীরের চাওয়া ?

রাশেদের, প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানা দরকার । রোদেলাকে হারানোর কষ্ট, পুলিশের অত্যাচার, দেশ ছেড়ে চলে আসা; সব কিছুই কি মিছে ?

রাশেদ কি কেবলি শরীরের টানে ঐ সব করেছে ?

অনেক ব্যস্ততার মাঝে রাশেদ সময় বের করেছে । কিছুটা সময় সে রোদেলার সাথে একান্তে কাটাতে চায় । রোদেলার সাথে তার সম্পর্কের সংঙা কি? রাশেদের জানা দরকার । নিজের বিশ্বাসের জন্যই দরকার, অনেক দরকার ।

রাতে খাবার টেবিলে রাশেদ রোদেলাকে দেখে । একে বারে ভিন্ন এক রোদেলা । মনে হয় মাত্রই শাওয়ার নিয়েছে । শীতের দেশ গুলিতে রাতে শাওয়ার নেওয়াই রীতি । রোদেলাকে দেখতে খুব ভাল লাগছে, পরিপূর্ণ নারী । একজন কিশোরীর সাথে পার্থক্য বিস্তর । সূষ্টির জন্য পূর্ণতা দরকার । প্রকৃতির নিজস্ব রূপ, হেলা করার উপায় নেই; কিশোরীদের মাঝে যা দেখা যায় না । রাশেদের মনে হয়, রূপ থাকলেই বদলায়, ক্ষণে ক্ষণে বদলায়; দিনে দিনে বদলায় । রোদেলার রূপও বদলায় ।টেবিলে সাদামাটা আয়োজনের চমৎকার পরিবেশনা । রোদেলার জন্য আয়োজনটাকে আরো গর্জিয়াস লাগছে । এই যেন এক তৈল চিত্র, বিশেষ একটা টোনে আরো সুন্দর করে ফুটে উঠেছে; মোহনীয় রূপে ।

রোদেলা খাবার ডিস গুলি দেখিয়ে বলে, এই সবই তোমাকে খেতে হবে । তুমি তো বলে আসনি । তোমার পছন্দও জানি না । ঘরে যা ছিল তাই দিয়েছি ।

অনেক খাবার, আমার সমস্যা হবে না । রাশেদ ভরসা দেয় ।

আমরা অনেক দিন ধরে দুইজনকে জানি । আমরা কখনও কখনও খাবার নিয়ে কথাও বলেছি, তোমার পছন্দ কি, জিজ্ঞেস করা হয়নি ।

সবই তো দেখছি আছে । সমস্যা কোথায় ?

এই সব তো কমন, সবার কমন পছন্দ । তোমার বিশেষ পছন্দ কি ?

আমি কমন ম্যান । কমন খাবারই আমার পছন্দ ।

শুনো রাশেদ, তুমি মোটেই কমন কেউ না । কেউ না জানলেও আমি জানি । তুমি নিজের মাঝে কেন গুটিয়ে গেছ ? রোদেলার কন্ঠে হতাশা । একটু থামে, স্বরটা আর একটু নীচু করে বলে, আমার জন্য তুমি খুবই স্পেশাল ।

রাশেদ এই ধরনের কথা শুনতে চায় না । সময়, সব কিছু নিয়ে যায়, কথাটা ঠিক না । কিছু দিয়েও যায় । অভিজ্ঞতা, অভিযোজন । পাল্টে যাওয়া পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা । সেই অভিজ্ঞতা রাশেদকে চুপ থাকতে বলছে । রাশেদ চুপ করে থাকে ।

রোদেলা খাবার টেবিলের আলোচনা হঠাৎ ভিন্ন প্রসঙ্গে নিয়ে যায় । রাশেদ আনমনা ছিল, আগের কথার সূত্র ধরেই হয়তো । রোদেলার প্রশ্নের উত্তর দেয়, তবে খুব সচেতন ভাবে না ।

পুলিশ কি আসামীদের খুব মারে ?

হু, খুব মারে ।

তোমাকেও মেরেছিল ?

রাশেদ চমকে উঠে । সে এখন পুরোপুরি সজাগ । তার আনমনা ভাব কেটে গেছে । সেই সব যন্ত্রণার দিন গুলির কথা সে মনে রাখতে চায় না । পুলিশ তাকে অনেক মেরেছিল । অনেক দিন চলে গেছে । শরীরে ক্ষত নেই, মনের ক্ষত সে জয় করেছে । এখন সে রোদেলার সামনে বসে আছে । সে সব কিছু মনের গভীরে চাপা দিয়ে রাখতে চায় । ক্যাথি তার পিঠের দাগ গুলোতে হাত বুলিয়ে কখনও কখনও কাঁদে । কেবল তখনি তার মনে হয়, পুলিশ তাকে খুব মেরেছিল ।

রোদেলা কি চায় ? কেন তাকে এই সব কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে ? কি লাভ রোদেলার ?

রাশেদ রোদেলার শেষ প্রশ্নটার উত্তর দেয় না ।

রোদেলা এটাই প্রত্যাশা করেছিল । রাশেদ তাকে কিছুই বলবে না । রোদেলাও চুপ থাকে । সে রাশেদকে দেখে ।রাশেদ নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে । মুখে চাপা যন্ত্রনার ছাপ । রোদেলা রাশেদের কষ্টটা অনুভব করে । পুরো দায় তার । ছোট্ট এক জীবনে সে রাশেদকে অনেক কষ্ট দিয়েছে । রাশেদের অন্যায়টা কি ছিল ?

রাশেদ তাকে ভালবেসেছিল, জান-প্রান দিয়ে ভালবেসে ছিল, ভালবাসাকে নিজের করে চেয়েছিল ।

কি ভীষন অন্যায় !

রোদেলার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, সে নিজের নিয়তি ঠিক করে নেয় । অপেক্ষা, তার কোন তাড়া নেই । সে রাশেদের জন্য অপেক্ষা করবে, এক জীবন তো বটেই; আরেক জীবন পেলে, তাও; রাশেদের জন্য তার অপেক্ষা চলবে ।

কালই কি চলে যাবে ?

হু, যেতেই তো হবে ।

ঠিক আছে । আমি তো সকাল বেলায় বের হয়ে যাব । নাস্তা রেডি করা থাকবে । খেয়ে নিও । ঘরের চাবি পাশের বাসার বুড়ির কাছে রেখে যেও।

রাতে আবার তারা দুইজন মুখোমুখি বসেছিল ।

রোদেলার দুই রুমের ট্রিপিকেল ইংলিশ ফ্যাশনের ফ্ল্যাট । উপর তলায় দুইটা বেড রুম, নীচে কিচেন, ডাইনিং আর সিটিং রুম । রাশেদের থাকার ব্যবস্হা করা হয়েছে রোদেলার রুমে । সে পাশের রুমে চলে গেছে । রোদেলা গুড নাইট বলতে এসেছিল । ব্রিটিশ কায়দা, এদেশেই যেহেতু থাকে; চর্চা চালিয়ে যাওয়া । রাশেদ জেগে ছিল, রোদেলা তার রুমে আসার অনুমতি চাইতেই ভেতরে ডাকে ।

অহ! তুমি ! এসো । এখন আমার ঘুম আসবে না । জেটলেগ কাটেনি । তোমাদের ভোর বেলায় আমার ঘুম পাবে ।

রোদেলা ঘরে আসে । আমিই তো হব, নাকি !

রাশেদ হাসে । ভাবে, অভ্যাস, কখন কে কোথায় কার কাছে আসবে, সব প্রকৃতি ঠিক করে দেয় । কখনও কখনও প্রকৃতিকে জয় করতে শিখতে হয় ।

রোদেলা সরাসরি জানালার পাশে চলে যায় । জানালার ভারী পর্দা সড়িয়ে দেয় । দেয়ার জোড়া কাঁচ কিংবা পুরো দেয়ালটাই কাঁচের । বাইরে ফক ফকা চাঁদের আলো, স্রোতের মতো ঘরে ঢুকে যায় ।

দেখেছ, কত আলো ।

রাশেদ মুগ্ধ হয়ে যায় । কত দিন সে এমন করে চাঁদের আলো দেখে না !

রোদেলা একটা ছোট চেয়ার দেখিয়ে বলে,

আমি এইখানটাই বসি । শীতের রাতে বসি । যখন বিকেল চারটার আগে সূর্য ডুবে যায়, পার হতে হয় দক্ষিনের দীর্ঘ রাত; আমি এইখানটায় বসি । টেবিল ল্যাম্পের আলোতে বই পড়ি । কখনও শুধু তাকিয়ে থাকি, আকাশ দেখি, মেঘ দেখি, জোছনা দেখি । আমার ক্লান্তি লাগে না । কত কিছু ভাবি সেই সময় !

রাশেদ চুপ করে থাকে । সংসারের মায়ার একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে । সে তার জাল ফেলেছে । হাসে রাশেদ, প্রকৃতি বরাবর জেটলেগে আক্রান্ত, কখনও ঘুমায় না; তার কাজ চালিয়ে যায় ।

তুমি কখনও পাপ করেছ ? রোদেলা জানতে চায় ।

সৃষ্টির প্রথম পাপ করেছিল এক জন পুরুষ । আমিও পুরুষ । পাপ তো করবই । প্যারাডাইস লস্টের কথা, Of Man’s First Disobedience, and the Fruit Of that Forbidden Tree....মিল্টন পড়নি? সেই শুরু, সবাই জানে এক জন পুরুষ প্রথম পাপ করেছিল, তার পেছনে কে ছিল কেউ জানতে চায় না ।

আমি মিল্টন পড়ি নাই । আমি অতি সাধারন, পাপের মহত্ব খুঁজি না । বিশেষ কারো পাপের সাথী হলে আমার মর্ম বেদনাও হবে না । রাশেদ, তোমার আবার পাপ করতে ইচ্ছে করে না ? আর একটা পাপ । আমার জন্য পাপ ।

রোদেলা অনেক প্রত্যাশা নিয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার চোখ ভরা তৃষ্ণা ।

রাশেদ সেই মূহুর্তে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় ।

তার এই মূহুর্তে কোন পাপ করতে ইচ্ছে করছে না । সে বুঝতে পারছে তার পক্ষে কোন অন্যায় সুযোগ নেয়া সম্ভব না । রোদেলা আবার তার মাঝে ফিরে এসেছে । সে এখনও রোদেলাকে ভালবাসে । নিজের জীবনের মতোই ভালবাসে । পুলিশ তার শরীর থেকে এতো রক্ত ঝড়িয়েও ভালবাসার কণাটুকু কমাতে পারেনি । রোদেলা এখন রাশেদের নিঃশ্বাস অনুভবের দূরত্বে । চাঁদের আলো, বিপরীতে পাশের দেয়ালে তাদের বিশাল ছায়া তৈরী করেছে । ছায়া দুটি স্হির থাকে দীর্ঘক্ষণ, মুখোমুখি । সময় বয়ে চলে; এক সময় দেয়ালে কেবল একটা ছায়া থাকে । খানিক পরে পাশের কামড়ার বাতি জ্বলে উঠে ।

দরজার পাশে সাদা একটা নেইম প্লেট । নামের পরিবর্তে লেখা আছে- “

“আমাকে বিরক্ত করবে না” ।

রাশেদের বিরক্ত করা ছাড়া উপায় নেই । রোদেলার কথা মত চাবিটা দিয়ে যেতে হবে ।

রাশেদ কলিং বেলে চাপ দেয় ।

তার ফ্লাইটের এখনও অনেক দেরী; বাসা থেকে আরো পরে বের হলেও হতো । বাসায় একা একা ভাল লাগছিল না । সকাল বেলা রোদেলা কাজে চলে গেছে । রাতেই কথা হয়েছিল, সকালে রাশেদকে ডাকেবে না । ডাকতে হয়নি, সেই সময় রাশেদ জেগেই ছিল ।জানালা দিয়ে রোদেলার চলে যাওয়া দেখেছে । রোদেলা গাড়ীতে উঠার আগে কি কারনে যেন অনেকক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল । মনে হচ্ছিল কি একটা দ্বিধা তাকে স্হবির করে দিয়েছে । সে চলে যেতে চেয়েও যেতে পারছে না ।

রোদেলা কি কিছু ফেলে যাচ্ছিল ?

রাশেদ রাতে যে ঘরে ঘুমিয়েছে, অনেকক্ষণ ধরে সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে ছিল রোদেলা।

তখন থেকেই রাশেদের মনটা বিষন্ন হয়ে আছে । রোদেলা ঘরে নেই, বাড়ি জুড়ে কেবল শূণ্যতা । সে বের হয়ে এসেছে, ঠিক করেছে একটু আগেই এয়ারপোর্ট চলে যাবে । এয়ার পোর্টে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাবে । বিভিন্ন দোকানে দোকানে ঘুরতে তার ভালই লাগে । এয়ারপোর্টে কেউ কাউকে মনে রাখার চেষ্টা করে না, বন্ধনহীন পরিবেশ । কেউ আবার ফিরে আসবে সে প্রত্যাশাও করে না । কেউ বার বার আসবে আবার কেউ হয়তো দ্বিতীয় বার এখানে পা রাখবে না । তাই সব নগদ, ভাল লাগা টুকু নগদ, মন্দ লাগা টুকু নগদ । রাশেদের দেখতে ভাল লাগে ।

সে এখন বুড়ির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । রোদেলার ঘরের চাবি তার হাতে, বুড়ির কাছে দিয়ে যেতে এসেছে ।

বুড়ি দরজা খুলে দেয় । এই, হাইইয়া ! তুমি কে ?

বুড়িকে দেখে রাশেদের মন ভাল হয়ে যায় । কিছু মানুষ আছে সব সময় শুভ্রতা নিয়ে ঘুরে, মনে হয় পবিত্র; পাপ কখনও তাকে স্পর্শ করেনি, বুড়িও তেমনি । সকাল হতে বয়ে বেড়ানো বিষন্নতার ছায়া রাশেদকে মুক্তি দেয় । এক রাশ মুক্ত বাতাস বয়ে যায় নিজের ভেতর, খুবই সতেজ বাতাস । সামনে দাঁড়ানো বুড়িকে দেখে । সেও তো বেঁচে আছে, এই বয়সে একাকি দিন পার করছে । দেখতেও ভাল লাগছে । রাশেদের ভাল থাকতে সমস্যা কোথায় ? নিজের ভেতরের পরিবর্তনটা রাশেদও বুঝতে পারে । রাশেদ বুড়ির সাথে একটু মজা করতে চায়, জিজ্ঞেস করে,

আমার কথা রোদেলা তোমাকে বলেনি ?

বুড়ি ভাল করে রাশেদকে দেখে ।

একটু দাঁড়াও, আমি আসছি ।

বুড়ি আবার বাসার ভেতরে চলে যায় । রাশেদকে ভেতরে যেতে ডাকেনি । রাশেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । রাশেদ একটু অবাক হয়েছে । বুড়ি কেন এমন করল ?

বুড়ি বেশী সময় নেয় না । একটা ডায়রী হাতে ফিরে আসে । চোখের খুব কাছে নিয়ে দ্রুত ডায়রীর পাতা উল্টায় । এক সময় থামে । চোখ তুলে রাশেদকে দেখে, প্রাচীন মুখে পবিত্র হাসি লেগে আছে ।

তুমি রাশেদ । একজন বুড়ো খোকাই আমার কাছে চাবি নিয়ে আসতে পারে, রোদেলা বলেছিল। তুমি ভেতরে আস । তোমার সাথে ব্যাগ কেন ? কোথাও কি যাচ্ছ ?

চলে যাচ্ছি বুড়ি । নিজের বাড়ি যাচ্ছি ।

এই ম্যান, তুমি আমাকে বুড়ি বুড়ি করছ কেন ? আমি স্টিল ইয়াং, চাইলে আবার একটা প্রেম করতে পারি !

অবশ্যই পার । আমি তো এখনও তোমার প্রেমে পড়ে গেছি ।

বুড়ি প্রাণ খোলে হাসে । জিজ্ঞেস করে, তুমি কি কফি বানাতে পার ?

অবশ্যই ! আমি চমৎকার কফি বানাতে পারি ।

তোমার জন্য এক কাপ কফি বানাও । সাথে আমার জন্যও । কফি খেতে খেতে তোমার সাথে গল্প করি । চল তোমাকে কিচেন দেখাই ।

রাশেদ বুড়ির কিচেনে আসে । কিচেনে বিশেষ কিছু নাই । শূণ্যই বলা যায় । এক পাশে প্যাট এর খাবার স্তুপ করে রাখা ।

তোমার ডগ কোথায় ?

আমার ডগ বনি বাগানে খেলছে । লম্বা রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছি । নিজে নিজে খেলছে । আমি তো আর বনির সাথে খেলতে পারি না ।

তোমার ডগের নাম বনি ?

হ্যাঁ, আমার বড় ছেলের নামে ডাকি ।

রাশেদ অবাক হয় । তুমি নিজ সন্তানের নামে কুকুরকে ডাক ?

তুমি ম্যান প্রশ্ন বেশী কর ! চুপচাপ কফি বানাও । বুড়ি ধমকে উঠে ।

নিজের উপর রাগ লাগে রাশেদের । কি দরকার ছিল তার শেষ প্রশ্নটা করার ! বুড়িকে এখন ম্লান দেখাচ্ছে ।

দুঃখিত ডারলিং । তোমার জন্য আমি স্পেশাল কফি বানাচ্ছি, একটু অপেক্ষা কর ।

বুড়ি রাশেদের কথা শুনেছে বলে মনে হয় না । বুড়ি মনে অন্য চিন্তা ।

রাশেদ বলতে পার, ডগ কত বৎসর বাঁচে ?

আমি ঠিক জানি না, কুড়ি বৎসর হতে পারে । ‘গুগল ভাই’ ভাল বলতে পারবে ।

বুড়ি হাসে না । মনে হচ্ছে বুড়ি সিরিয়াস । তুমি তোমার গুগল ভাইকে জিজ্ঞেস করতে পারবে ? আমার জানা দরকার ।

রাশেদ ভয় পেয়ে যায় । সে কি বলতে কি বলে !

বুড়ির মুড নষ্ট হয়ে যেতে পারে । সে কফি ভরা একটা মগ বুড়ির হাতে ধরিয়ে দেয় । বলে,

চল, পরস্পরের সুস্বাস্হ্য কামনা করে পান করি । রাশেদ নিজের মগটা বুড়ির মগের সাথে ঠুঁকে দেয় । চিয়ার্স !!

এবার বুড়ি হাসে ।

রাশেদ ভারমুক্ত হয় । মনে হচ্ছে বুড়ির মুড ঠিক আছে । রাশেদ চাবির গোছাটা বুড়ির সামনে টেবিলে রাখে ।

বুড়ি চাবিটা দেখে । জিজ্ঞেস করে,

এখনি উঠবে ?

রাশেদ কিছু বলে না ।

বুড়ি মনে হচ্ছে আবার বিষন্ন হয়ে গেছে । এই বয়সে কোন কিছুই দীর্ঘ স্হায়ী হয় না । আবেগ তো আরো না । সে বলে,

আমি মরে যাবার আগে ডগটা রোদেলাকে দিয়ে যেতে চাই । রোদেলা ডগ পছন্দ করে না । সে একা একা কি করে থাকবে ? সে কখনও পার্টনার নিতে পারবে না, তার একজন ভালবাসার মানুষ আছে, সেও তার কাছে আসবে না । ডগ কাছে থাকলে অনেক সুবিধা । সকালে ঘুম ভাঙাবে । ডগের সাথে খেলা করা যায়, ডাকলেই কাছে আসে, কোন অজুহাত দেখায় না; সময় কেটে যায় । কখনও কোন সমস্যা করে না ।

রাশেদ, তুমি কি রোদেলাকে বুঝাতে পার না ?

সে যেন বনিকে নিজের কাছে রাখে । বনির বয়স খুব বেশী না । মনে হয় সে আরো অনেক দিন বাঁচবে ।

পার না তুমি রোদেলাকে বুঝাতে?

কথা শেষ করে বুড়ি অনেক প্রত্যাশা নিয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে আছে । রোদেলার জন্য বুড়ীর অনেক চিন্তা ।

রাশেদ বুড়িকে কি উত্তর দিবে ?

রাশেদ কিছু বলে না । রাশেদের কাছে কোন উত্তর নেই । সে চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় ।

তার মনটা আবার ভারী হয়ে গেছে ।

চলে যাবার সময় বুড়ি দাঁড়িয়ে থাকে । রাশেদের সাথে দরজা পর্যন্ত যায় না । ব্যাপারটা মোটেই শোভনীয় নয় । বুড়িও বুঝে, তার কিছুই করার নেই । সে লজ্জিত, দৃষ্টি নীচের দিকে । বুড়ি এখন কফির কাপের দিকে তাকিয়ে আছে । বুড়ির জন্য রাশেদের ভীষণ মায়া হয় ।

রোদেলাও কি একদিন এমন নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে ?

রোদেলা কি কোন দোষ করেছে ?

রোদেলার নিঃসঙ্গতার জন্য রাশেদের কি কোন ভূমিকা আছে?

রাশেদ আবার বুড়ির কাছে ফেরত আসে । এতো মায়া ভরা পৃথিবীতে বুড়ি এতো নিঃসঙ্গ কেন ?

বুড়ি, তোমাকে একবার হাক করতে পারি ?

বুড়ি চোখ তুলে রাশেদকে দেখে । কিছু বলে না । প্রাচীন ঠোঁটে এক টুকরো হাসি খেলে যায় । দুই হাত প্রসারিত করে রাশেদকে আহ্বান করে ।

আটলান্টিকের অপর পারে তখন সকাল হচ্ছে । ভোরবেলা ক্যাথির ঘুম ভেঙে যায় । সে খোলা লনে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে । সকালের মৃদু হাওয়া তার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয় । সে থেকে থেকে শিহরিয়ে উঠছে । ক্যাথি আনমনে লনের এই মাথা থেকে ঐ মাথা হাঁটে । আজ সে অনেক খুশী, তৃষ্ণা আর স্বপ্ন খেলা করে তার চোখে; আজ রাশেদ ফিরে আসছে ।

—-সমাপ্ত—-

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :