বিশ্বকাপের শেষে...

প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০১৮, ১৫:৫২

মনদীপ ঘরাই

ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালের পরের দিন সকাল সকাল টিভি খুলতেই আগের রাতের ম্যাচের রিপিট টেলিকাস্ট। চ্যানেল ঘুরিয়েও ফল একই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স আর বিশ্বকাপ ফাইনাল খবরের কেন্দ্রে। খবরের কাগজটা হাতে নিয়েও ভিন্ন কিছু কি আর পাওয়া সম্ভব! পুরো বিশ্ব এ যাত্রায় শেষবারের মতো কাঁপছে বিশ্বকাপে। চ্যাম্পিয়ন আর রানার আপের আলোচনাই থাকছে ঘুরেফিরে।

তবে আমাদের আলাপটা অন্য স্রোতের। ঢেউ আপনার মনেও লাগলো কি না মিলিয়ে নেবেন! বিশ্বকাপের শেষেও দিন কয়েক কাটছে ফুটবলেই। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজেকে দেখে নিন আয়নায়। এখন আবার ফিরেছেন আগের জীবনে। সকালটায় খুঁজে পাচ্ছেন না কার কার খেলা আজ। বাধ্য হয়ে নজর দিচ্ছেন অন্য খবরে। পুড়ে শেষ হওয়া তারাবাজির মতো ফুটবলের উত্তাপটা একটু হলেও থেকে যাবে হয়তো, তবে আলো ছড়াবে না।

প্রত্যেকটা বিশ্বকাপ একটা প্রজন্মের কাছে প্রথম বিশ্বকাপ হয়ে আসে। শুরু হয় নতুন সমর্থক গোষ্ঠীর পথচলা। এদের সমর্থনের পেছনে থাকে পরিবারের সমর্থন ঐতিহ্য, দলের কিংবা নির্দিষ্ট ফুটবলারের চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স, এমনকি পতাকা ও জার্সির রং! এই সমর্থকদের অধিকাংশ আমার মতো ‘লিপ ইয়ার’ সমর্থকে পরিণত হতে চলেছে। আবারো বিশ্বকাপ, আবারো পাগলামি। বাকি সময়টাতে ধুলো জমবে ফুটবল আবেগে। আর দলছুট দু-একজন অবশ্যই পাবেন যারা আজ থেকেই মনোযোগ দেবেন ড্যানিশ সুপার লিগসহ তামাম বিশ্বের সব ফুটবল ম্যাচে। এ সংখ্যাটা খুব বেশি হবে কি?

এতদিন ছাদে ওড়ানো সাধের পতাকাটার শেষ খবর জানেন তো? ঘরের কোনো এক অপ্রয়োজনীয় কোনায় নিশ্চয়ই মুখ লুকিয়ে আছে! তবে, আপনার সাধের দলের জার্সিটার ভাগ্য এতটা খারাপ হবে না। আপনার মা কিংবা স্ত্রী ঠিকই ওটা ধুয়েটুয়ে আলমারিতে রেখে দেবে পরের বারের জন্য। তখন হয়তো ওটাতে ঢোকার মতো শরীর কিংবা মন আপনার নাও থাকতে পারে! এরই মধ্যে চোখে পড়েছে বা পড়বে দরজায় টানানো কিংবা টেবিলে রাখা ফিকশ্চারটা। হয়তো বিরক্তির সুরেই বলবেন, ‘এটা এখনও সরাওনি!’

আপনার মনের স্পোর্টিভ অংশটা এবার নির্ঘাত তরী ভেড়াবে ক্রিকেট জগতে। আলোচনায় আসবে সাকিব-তামিম-মিরাজরা। এ পরিবর্তন কি শুধু আপনার-আমারই হলো? অবশ্যই না। গণমাধ্যমও আপনার পথেই। ক্রিকেট গুটি গুটি পায়ে দখল করবে সব। আমরা আবার ব্যস্ত জীবনে ফিরব ব্যস্ততম হয়ে। সন্ধ্যা কিংবা রাতটা কাটবে গোল, হলুদ কার্ড, কর্নারবিহীন। শুধু কর্নারে পড়ে থাকবে কিছু নামÑ রাকিতিচ, এমবাপ্পে, কেইন প্রমুখ। পরের বিশ্বকাপ হয়তো বার্ধক্য ছাড়া আর কোনো উপহার দিতে পারবে না মেসি-রোনালদো-ওজিলদের ক্যারিয়ারে। বলতে পারেন, বার্ধক্য আবার কেমন কথা। ফুটবলারদের পায়ের বয়সের হিসাবটা তো ওরকমই গোলমেলে!

ব্যবসা ফুরালো পতাকা আর জার্সি ব্যবসায়ীদের। অপেক্ষাটা দীর্ঘ। তবে মৌসুমটা মন্দ ছিল না! নিজ দেশে পরের পতাকা আর কারাই বা টানায়। এই তো ঘুরে এলাম ইন্দোনেশিয়া থেকে। ওদের দেশে খেলা বলতেই ফুটবল। উন্মাদনাও অলিতে-গলিতে। কিন্তু একটা পতাকারও দেখা পাইনি।

বিশ্বকাপ শেষ হওয়াতে স্বস্তি পেল কারা? প্রথম সারিতে আছে স্কুল গোয়িং সন্তানের মায়েরা। এবার বাচ্চাদের রাত জাগা আর পড়াশোনা গোল্লায় যাওয়ার অবসান! এ দলে তারা একা নয়। আছে বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গন। বিশ্বকাপ এলেই না পারার ব্যর্থতা নিশ্চয়ই পোড়ায় তাদের। আলোচনায় ওঠে আসে বিশ্ব ফুটবলে তাদের অবস্থানও! এবার অন্তত সবার থেমে যাওয়ার কথা! থামবে না-ই বা কেন? এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করে বসি, ‘বাংলাদেশ ফুটবল দলের রক্ষণভাগের সবচেয়ে ইফেক্টিভ ফুটবলার কে?’ বিব্রত হচ্ছেন নিশ্চয়ই?

ফুরিয়ে যাওয়া বিশ্বকাপে বাসার মা-দাদি সমাজ বেজায় খুশি। সিরিয়াল দেখার সিরিয়ালটা এবার সবার আগে, যা ধকল গেল এই এক মাস! আর সোশ্যাল মিডিয়ার কি হবে? কি আর হবে? ফুটবলীয় কাদা ছোড়াছুড়ি আর আবেগের জায়গা নেবে সেলফি, খাবার-দাবার আর আমার মতো লেখালেখির অভ্যাস। বিশ্বকাপের বদৌলতে ‘ভামোস’ কিংবা ‘ভাই’ টাইপের ভাষা শিক্ষারও আপাতত ইতি। কঠিন প্রশ্ন রেখে শেষ করি। আমরা কি তাহলে ফুটবল ভক্তের বদলে বিশ্বকাপ ভক্ত? উত্তরটা ‘না’ হোক মনে-প্রাণে চাই। তবে সব চাওয়া পূর্ণ হয় না! পায়ের খেলা ফুটবলকে মাথায় তুলেছিলাম গত এক মাস। আবার পায়ে ঠেলে দূরে সরাতে একদিনও তো লাগলো না! উন্মাদনাটা সাময়িক। ভালোবাসাটা চিরস্থায়ী। ভালোবাসুন ফুটবল। মনে লালন করুন স্বপ্ন, একদিন লাল-সবুজে আমরাও মাতাবো বিশ্ব অঙ্গন!

মনদীপ ঘরাই: লেখক এবং সিনিয়র সহকারী সচিব, বাংলাদেশ সরকার