‘জালে অহন মাছ পাই না’

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল
 | প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০১৮, ১৩:০১

‘জালে অহন আর মাছ পাই না। আগে নদীতে গেলেই মাছ পাইতাম। বেলা উঠার আগেই পাড়ার জেলেদের নিয়ে নদীতে যাইতাম। কতো সময় পালানে (পরিত্যাক্ত জমি) জাল বাইতাম। ঘণ্টাখানেক জাল বেয়ে দশটার আগেই বাজারে মাছ উঠাইতাম। কাওরে ভাগ ভাটওয়ারাও দিতে অইতো না। যা কামাইতাম ওতেই সংসার চইলা যাইত। অহন মাছ সব পালা। খোলা পানিতে চাইলেই মাছ পাই না। অহন পালা মাছ মাইরা দিতে অয়। একদিন একজনের পুকুরে পালা মাছ মাইরা দিলে পরের দিন বেকার বইয়া থাকি।’ এভাবে কথাগুলো বললেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের জেলেপাড়ার ফনিন্দ্র রাজবংশী। ফনিন্দ্রের মতো জেলে সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

মা মাছ নিধন, কারেন্ট জালের ব্যবহার, কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় জলাশয়ে মাছ অনেক কমে গেছে বলে মনে করছেন জেলা মৎস অফিসসহ এ অঞ্চলের জেলেরা।

ক’দিন আগেও বলা হতো, মাছে-ভাতে বাঙালি। গোলার ধান আর পুকুরের মাছ যেন সহজলভ্য ছিল প্রতিটি বাঙালির কাছে। নব্বই দশকেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। একবিংশ শতাব্দি বাঙালি দরজায় যখন থেকে নাড়া দিল- তখন থেকেই মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা যেন হারিয়ে যেতে লাগল।

টাঙ্গাইলে নদ-নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় দিনদিন পেশা ছাড়ছেন এ অঞ্চলের জেলেরা। দরিদ্র জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্থাভাবে অন্য কোন পেশায়ও যেতে পারছেন না। ফলে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি, আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু দেশীয় মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না।

দেশি সরপুটি, গজার, জেব্রা, এলঙ, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারা বাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৫০টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।

জেলে লক্ষ্মণ রাজবংশী বলেন, এক সময় মাছ ধরতে গেলে মাছে নৌকা বোঝায় হয়ে যেত। কিন্তু এখন আগের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগও মাছ ধরা যায় না। খাল-বিলে মাছ কমে যাওয়ায় অনেক জেলে বাব-দাদার পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে খোলা নদী-নালা থেকে স্বাধীনভাবে মাছে ধরে সংসার ভালোভাবেই চলে যেত। এখন মুক্ত নদ-নদীতে আগের মতো মাছ না থাকায় চাষ করা পুকুরে দিনমুজুর হিসেবে মাছ ধরে দিতে হয়। এতে সপ্তাহে দু-একদিন এধরনের পুকুরে মাছ ধরার সুযোগ পেলেও বেশিরভাগ দিন কাটে অবসরে।

বছরে একবার মৎস সপ্তাহের সময় নানা পদক্ষেপে স্বপ্ন দেখালেও সারাবছর বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না- এমন অভিযোগ জেলেদের।

জেলা মৎস্য অফিস জানায়, জেলায় ৪১ হাজার ৪৯৫টি পুকুর রয়েছে। এছাড়াও বিল ২৯৮টি, বাওড় ৩টি, পেন কালচার ৪টি, ৮টি নদী ও ১২৮টি খাল রয়েছে। এ এলাকায় মাছের চাহিদা ৭৩ হাজার মেক্ট্রিক টন। মুক্ত জলাশয়ে মাছ কমে যাওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ বাড়িয়ে মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। বর্তমানে হাইব্রিড বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে এসব মাছ চাষের আগে পুকুর ও ডোবার পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোয় মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণির প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

এদিকে অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় প্রাকৃতিক মাছ অনেক কমে গেছে। এক সময় জেলেরাও মাছ ধরে ভালভাবে সংসার চালাতে পারত। কিন্তু এখন তাদের সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশি মাছ সংরক্ষণে হ্যাচারি স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যেই এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেককেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

যেখানে পানি কম থাকে, সেখানে মৌসুমী মাছ চাষ করা হবে বলেও তিনি জানান।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুলাই/নিজস্ব প্রতিবেদক/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :