পাসের হারে কিসের ইঙ্গিত?

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০১৮, ০৮:৩৮

এইচএসসি পরীক্ষায় গত দশ বছরের মধ্যে এবার পাসের হার সবচেয়ে কম। অথচ এই রেজাল্ট নিয়ে সবাই বোধকরি গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুশি।

কম পাসের সঙ্গে বেশি খুশির সম্পর্কটা কোথায়? ধরা যাক একটা পরিবার থেকে দশজন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরিবারের সিনিয়ররা তো তখনই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে, যখন ওই দশজনই পাস করবে। দেশটা তো একটা পরিবারই। তাহলে কম পাসে খুশি কেন? এ এক জটিল প্রশ্ন।

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বরং একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। আমরা যদি ২০১০ সাল থেকে দেখি, এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার বাড়তে বাড়তে ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। সেটা ২০১২ সালের কথা, পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এটা ধীরে ধীরেই বাড়ছিল, বেড়ে গিয়ে এখানে উঠেছিল। ২০১০ সালে ছিল ৭৪ দশমিক ২৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ৭৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০১২ সালের পরের বছরগুলোতে অবশ্য একটু কমেছিল, কিন্তু সেটা তেমন কিছু কম নয়। যেমনÑ ২০১৩ সালে ৭৪ দশমিক ৩০, ২০১৪ সালে ৭৪ দশমিক ৩২, ২০১৫ সালে ৬৯ দশমিক ৬০, ২০১৬ সালে ৭৪ দশমিক ৭০, ২০১৭ সালে ৬৮ দশমিক ৯১ এবং এবারের ২০১৮ সালে ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আসলে এই কমাটা শুরু হয়েছে গত বছর থেকে।

পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারে কমবেশি হওয়াটা নতুন কিছু নয়। যতদিন ধরে পরীক্ষা ব্যবস্থা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই চলে আসছে এই প্রবণতা। একবার বাড়বে তো আর একবার কমবে অথবা এর উল্টোটা হবে। কিন্তু নতুন বিষয় হচ্ছেÑ পাসের হার কমার কারণে খুশি হওয়াটা, পাসের কম হার দেখে সকল মানুষের চোখে মুখে স্বস্তির প্রকাশ দেখাটা। খুশি হয়েছেন অভিভাবকরা, শিক্ষকরা, মন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা, এমনকি এতদিন যাদের মুখে সমালোচনা উচ্চারিত হতোÑ তারাও। সকলের এই স্বস্তি দেখেই প্রশ্নটা জোরালো হয়েছেÑ কম পাস করায় খুশি কেন?

আমার মনে হয় কেবল রেজাল্ট নয়, খুশির পিছনে আরও একটা কারণ রয়েছে। সেটি হচ্ছেÑ প্রশ্নপত্র ফাঁস না হওয়া। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেলে পরীক্ষা আর পরীক্ষা থাকে না। তখন শিক্ষার্থীর যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। সারা বছর পড়ে একজন যে নম্বর পায়, আর একজন দুর্নীতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বাগিয়ে নিয়ে কোনো লেখাপড়া না করেই তার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে যায়। আগের কয়েক বছর ধরেই প্রশ্নপত্র ফাঁস এতটাই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, এক পর্যায়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রীকে পর্যন্ত বলতে শোনা গিয়েছিল, এটা নাকি বন্ধ করা সম্ভব নয়। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই তার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেই ওই হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তখন এ বিষয়ে সরকারি বিশেষজ্ঞের বাইরে নানা জনের কাছ থেকে নানা পরামর্শ এসেছে। আমার ধারণা মন্ত্রী মহোদয় সেসব পরামর্শ থেকেই একটা কার্যকর পদ্ধতি বের করতে পেরেছেন। সবশেষ এসএসসি এবং এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো কথা শোনা যায়নি। এই সুখবরেও সাধারণ মানুষ এক ধরনের স্বস্তিতে ছিল।

বিগত বছরগুলোতে যখন পাসের হার অবলীলায় ৭৫ শতাংশের উপরে উঠে যাচ্ছিলো, বাড়ছিল জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা, তখন তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দের চেয়ে যেন আতঙ্কই বেশি ছিল। মানুষ আতঙ্কিত ছিল শিক্ষার মান নিয়ে। সেসময় একটি টেলিভিশনে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রদের নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রচারিত হলে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। দেখা যায়, একেবারে প্রাথমিক স্তরের জ্ঞান না থাকা ছাত্ররাও জিপিএ-৫ পেয়ে গেছে। প্রশ্ন ওঠে উত্তরপত্র মূল্যায়নের মান নিয়ে। অনেকে এমন কথাও বলেন যে, ছাত্রছাত্রীদের বেশি বেশি করে নম্বর দেয়ার জন্য নাকি পরীক্ষকদের প্রতি কড়া নির্দেশনা দেয়া আছে।

এইসব অভিযোগ আসলেই ভয়ংকর। মূল্যায়ন পদ্ধতিই যদি এরকম হয়, তাহলে তো পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই আতঙ্কিত হতে হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারই বা কেন এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন? কেবল কি এটাই বোঝাতেÑ তাদের আমলে শিক্ষার পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা এতটাই বেশি ছিল যে, পাসের হার বেড়ে গেছে? হতে পারে। কিন্তু এই ধারণা যে কার্যকর নয়, সেটা উপলব্ধি করতেও বেশি সময় লাগেনি। মানুষ দ্রুতই বিষয়টা বুঝে গেছে। হয়তো কিছুটা বেশিই বুঝেছে, তাই এ নিয়ে অতিরঞ্জিত নানা কথাবার্তা বা ট্রলও তখন বেশ দেখা গেছে।

তবে সে সব ট্রল বা কৌতুকে সরকারপক্ষ যে মোটেই বিচলিত হননি, সেটাও দেখা গেছে। যেমন ২০১২ সালের কথাই ধরা যাক। এইচএসসি পরীক্ষায় সেবার পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সবাই যখন পাসের এই হারে হতবাক, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তখন এটা নিয়ে রীতিমতো উল্লসিত। এতটাই গর্বিত যে, সে উল্লাস তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে পর্যন্ত। এখানে প্রধানমন্ত্রীকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব দেশেই প্রধানমন্ত্রী যখন অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের সাফল্য নিয়ে কথা বলেন, তখন সেটা সেই মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিবেশিত তথ্য-উপাত্ত আর ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই বলেন। বাংলাদেশেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?

তাহলে এখানে কিন্তু সেই অনিবার্য প্রশ্নটি এসেই যায়, আজ ৬৬ শতাংশ যদি সাফল্য হয়, তাহলে সেদিনের ৭৮ শতাংশও সাফল্য ছিল কিভাবে? আজকের ফল নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় যা বলছেন, সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে সেদিনের কথাগুলোকেও সত্য বলা যাবে কিভাবে? নাকি রাজনীতিবিদদের কাছে সত্য বারবার পাল্টে যায়? তা যেতে পারে। তা নিয়ে হয়তো কেউ আপত্তিও করতে চাইতো না। কিন্তু ঝামেলটা হয় তখনই, যখন এই সত্য-মিথ্যার কারণে পুরো জাতির ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আমাদের এখানে সেই আশঙ্কাটা কিন্তু বেশ জোরালোভাবেই রয়ে গেছে।

২০১২ সালের সেই অস্বাভাবিক মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে যারা অনেক অনেক সাফল্য পেয়ে গেছে, তারা এখন এই সমাজেই আছে। গত ছয় বছরে তাদের অনেকে হয়তো কর্মজীবনেও প্রবেশ করেছে। কিন্তু যে যোগ্যতার পরিচয় তাদের সনদপত্রে ছিল, সেটা কি তাদের জীবনেও আছে? কেবল ২০১২ সালের একটি ব্যাচই নয়, গত কয়েক বছর ধরেই কি এরকম বিবর্ধিত কয়েকটি প্রজন্ম তৈরি করা হয়নি?

আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় অর্ধশতক হতে চললো। কিন্তু অতি বেদনার বিষয় হচ্ছে, আমরা আজও পর্যন্ত একটা আধুনিক শিক্ষা নীতি, শিক্ষা পদ্ধতি তৈরি করতে পারলাম না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন চলছে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে। একবার একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, তারপর সেটার কুফল দেখে আবার পাল্টানো হচ্ছে। আবার ‘কুফল’-এর সংজ্ঞাটাও বারবার পাল্টে যাচ্ছে। যদি নাও পাল্টাতো, তাহলেই বা কি হতো? কারণ সেই কুফলের প্রভাব যাদের গায়ে লেগে গেল, তাদের জীবনের গতিটা কি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল না? কিংবা তার প্রভাবে পুরো সমাজই কি ঝুঁকির মুখে পড়ে গেল না?

ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতির ঝুঁকিটা কোথায়, সে বিষয়ে একটা গল্প বলি।

বৈদ্যুতিক খুঁটিতে লাইন মেরামত করছিল ওস্তাদ আর তার সাগরেদ। ওস্তাদ বললোÑ রহমত, বামপাশের ওই তারটা একটু এদিকে দে তো। সাগরেদ রহমত বললো, ওস্তাদ আমার কাছে তো প্লায়ার্স নেই, খালি হাতে ধরবো? ওস্তাদ বললোÑ ধর। রহমত তারটি ধরে টেনে এনে ওস্তাদের হাতে দিলো। ওস্তাদ তখন বললো, আগেই জানতাম, বিদ্যুৎ এই দুই তারের যে কোনো একটিতে আছে। এখন বুঝলাম, তাহলে ওই ডান দিকের তারটিতেই বিদ্যুৎ আছে! আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা হয়েছে ওই সাগরেদ রহমতের মতোই।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :