নির্বাচনে পরিযায়ী নেতা এবং লঞ্চে নীল নকশার নাটক

আলম রায়হান
| আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৮, ২১:০৫ | প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০১৮, ১০:৪৭

নির্বাচনে যেসব বেফজুল বিষয় বিশেষভাবে চোখে পড়ে তার মধ্যে একটি হচ্ছে বিভিন্ন দলের বহিরাগত নেতাদের দাপুটে বিচরণ। এরা থাকে ফুরফুরা মেজাজে। অবার পরিযায়ী পাখির মতো নিজ ভূমে ফিরে যায়। এই বহিরাগত নেতাদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে নানান ধরণের নিয়মনীতি এলান করতে হয়। নির্বাচনী প্রচারণায় কারা অংশ নিতে পারবেন, কারা পারবেন না; কখন এলাকা ছাড়তে হবে- এন্তার নিয়ম জানান দিতে হয় নির্বাচন কমিশনকে। সে এক উদ্বেগের পরিবেশ। যেনো শান্ত জলে হাঙ্গরের অনুপ্রবেশ!

বাস্তবতা হচ্ছে, পরিযায়ী নেতাদের আগমনে নির্বাচনে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না; উল্টো আলাদা চাপ তৈরি হয়। এমনকি এদের উপদ্রবে মানুষ অনেক সময় বিরক্ত হয়। এরপরও প্রতিটি নির্বাচনে এদের দেখা যায়। টেলিভিশনের কারণে এদেরকে সারা দেশের মানুষ দেখতেও পায়। সঙ্গে ফেসবুক তো আছেই। কিন্তু এই বহিরাগত পরিযায়ী নেতারা যে প্রার্থীর পক্ষে ফটোসেশনের মতো ভূমিকা রাখেন তাতে কার কি লাভ হয়? গত ১৪ জুলাই বরিশালে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনায় এর সহজ উত্তর অনুসন্ধানে সহায়ক হতে পারে।

ঢাকা দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বরিশাল গিয়েছিলেন ৩০ জুলাই অনুষ্ঠেয় সিটি নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। বিষয়টি শুনতে ভালো। কিন্তু এর প্রভাব কি? অথৈ পাথারে কলার খোসার উপযোগ কতটুকু! কলাগাছ হলেও একরকম সান্ত্বনা ছিলো। অবশ্য সান্ত্বনা পর্যন্তই! বহিরাগতদের আগম-নির্গমনে ভোটে কোনো প্রভাব ফেলে না। এর উদাহরণ আছে খোদ বরিশালেই।

ডা. নাসিম বিশ্বাসের অকাল মৃত্যুতে বরিশাল সদর আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ এবং বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মুজিবুর রহমান সরোয়ার। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে চার শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং সত্তর জন সংসদ সদস্য অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি প্রার্থী। তবে এটি বরিশালে বিএনপি’র জনপ্রিয়তার ইন্ডিকেটর নয়।

এ প্রসঙ্গে একটু পেছনে ফেরা প্রয়োজন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাদের বাসায়ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সেদিন ঘটনাচক্রে বেঁচে গেছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এরপরও তাকে হত্যার জন্য বরিশালে অন্তত দুই বার গুলি চালানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তিনি বেঁচে গেছেন ভাগ্যক্রমে। শুধু তাই নয়, যে বরিশাল ১৬ ডিসেম্বরের এক সপ্তাহ আগে পাক হানাদার মুক্ত হয়েছে সেই বরিশাল দ্রুত হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের ঘাঁটি। সেই দশা থেকে বরিশালকে টেনে তোলার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। কিছুটা সফলও হয়ছেন। এ প্রক্রিয়ায় তার হাত ধরে অনেকে বরিশালের নেতা হয়েছেন। এর মধ্যে উজ্জ্বলতম ছিলেন শওকত হোসেন হিরন। হিরনকে সন্তানতুল্য বিবেচনা করেছিলেন আবুল হাসানাত। অথচ মেয়র নির্বাচিত হবার পর রহস্যজনক কারণে তিনি আবুল হাসানাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন দুর্বিনিত দাপটে। অবশ্য পরের মেয়র নির্বাচনে আহসান হাবিব কামালের সঙ্গে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে এর ফলও হাতেহাতে পেয়েছেন জনাব হিরন।

এরপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি বরিশাল সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। অবশ্য সে নির্বাচনে ভোটাভুটির বালাই ছিলো না। তবু তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু অসময়ে তিনি প্রকৃতির কাছে পরাজিত হলেন। এরপর উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ। এবং ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হন তিনি, যা বরিশালবাসীর জন্য অন্য এক রকম ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে।

এরপর বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে এলো রাজশাহী ও সিলেটের সঙ্গে বরিশালে সিটি নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বরিশালের জন্য। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদাজল খেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে ৭৫-এর থিংক ট্যাংক। এরা লবিং করতে থাকে, আর যাই হোক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ যাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পায়। তবে তাদের এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কিন্তু তাই বলে একেবারে হালও ছেড়ে দেয়নি। লেগে থাকার চলমান প্রক্রিয়ায় বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নিশ্চিত করেছে মুজিবুর রহমান সরোয়ারকে। বরিশালের মেয়র প্রার্থী হিসেবে সরোয়ার খুবই শক্তিশালী-এ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সিটিরই সাবেক সফল মেয়র, চারবারের সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ এবং বিএনপির ডাকসাইটে কেন্দ্রীয় নেতা মুজিবুর রহমান সরোয়ারকে এবার বরিশালে মেয়র প্রার্থী হতে হলো কেন? সাবেক পদে ফিরতে চাইলে তো তিনি গতবারই মেয়র প্রার্থী হতে পারতেন। বলা হয়, আহসান হাবিব কামালের মতো নাজুক প্রার্থী হিরনের মতো শক্তিশালী সিটিং মেয়রকে বিপুল ভোটে হারাতে পেরেছিলেন সরোয়ারের ক্যারিশমেটিক ভূমিকার কারণে। সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতিবাচক তৎপরতা ছিলো বলে প্রচারণা আছে।

বরিশালের সেই ক্যারিশম্যাটিক নেতা মুজিবুর রহমান সরোয়ার এবার সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে প্রবেশ করেছেন। অনেকটা জেনেশুনে বিষ পান করার মতো। অনেকে মনে করেন, প্রথম যৌবনে চাকর পাড়ায় এক রাতের ঘটনায় তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিলো। এবার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তার রাজনৈতিক জীবন। এমনটাই অভিমত বরিশালের পর্যবেক্ষক মহলের। তবে অন্যরা যা বোঝেন, তা সরোয়ার বোঝেন না- এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি এ ঝুঁকিতে নিজকে সঁপে দিলেন কেন? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এ ক্ষেত্রেও ৭৫-এর থিংক ট্যাকং কাজ করেছে। তারা কোনো অবস্থাতেই ৭৫-এর শহীদ পরিবারের সদস্য সাদিককে বরিশালে নির্বাচিত হবার সুযোগ দিতে চায় না। কিন্তু এই না চাওয়ার বিষয়টি হালে পানি পাচ্ছিল না বরিশালের আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে আরিফিন মোল্লার মতো নৌকার অসংখ্য সমর্থক সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় আদাজল খেয়ে নামার কারণে।

এদিকে সাদিক নিজে জনসংযোগে রাত-দিনের ব্যবধান ঘুঁচিয়ে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এমন সব এলাকায় ভোটারদের দ্বারেদ্বারে যাচ্ছেন যেখানে কাঁদা-জল পেরিয়ে নগ্ন পদব্রজ ছাড়া যাবার আর কোনো উপায় নেই। এর আগে তিনি দল গুছিয়েছেন নিজের মতো করে। ফলে তাকে সহজে নির্বাচনী মাঠে কোণঠাসা করা যাবে না- এটি সকলের কাছেই ছিলো স্পষ্ট। কিন্তু তাই বলে তো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হাতপা গুটিয়ে বসে থাকে না। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। কিন্তু খুব একটা সুবিধা হচ্ছিলো না।

এ অবস্থায় সামগ্রিক বিবেচনায়ই হয়তো শেষ চেষ্টা হিসেবে ৭৫-এর থিংকট্যাকং বরিশাল সদরঘাটে ১৪ জুলাই লঞ্চে নীল নকশার নাটক সাজিয়েছিলো। যেখানে স্কেপগোট বানানো হয়েছে শেখ হাসিনার জন্য ১/১১ সরকারের সময় চরম ঝুঁকি নেয়া শাহে আলম মুরাদকে। অতীত বলে দেয়, নেতার প্রতি অনুগত থাকা শাহে আলম মুরাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট। এই বৈশিষ্টের কারণেই নদী ভাঙ্গণে বরিশাল ছাড়া হবার পর ঢাকার জীবনে প্রথম নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টুর প্রতি অনুগত থেকে গণফোরামেও গিয়েছিলেন তিনি। তবে তার ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শাহে আলম মুরাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। অথচ তাকে কেন্দ্র করেই বিরাট রহস্যজনক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

যতটুকু জানা যায়, ১৪ জুলাই বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ অসীম ধৈর্য এবং প্রজ্ঞার পরিচয় না দিলে অকল্পনীয় ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিলো। যার জেরে বরিশালের সিটি নির্বাচন কেবল নয়, অনেক কিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু অনেকটা ভাগ্যক্রমে এই সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ১৪ জুলাইর ঘটনায় সরকার বা আওয়ামী লীগের কোনই ক্ষতি হয়নি। বড় রকমের সর্বনাশ কিন্তু ঠিকই হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, একটি বাহিনীর সাধারণ সদস্যের সঙ্গেও মাত্রাছাড়া আচরণ করলে তা বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বরিশাল মেট্টোপলিটন পুলিশ প্রধানের সঙ্গে কতটা মাত্রা ছাড়া আচরণ করা হয়েছে তা তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়।

আলম রায়হান, লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :