ভোটের আগে জোটের খেলা!

বাছির জামাল
 | প্রকাশিত : ২৫ জুলাই ২০১৮, ০৮:৩৪

জাতীয় একাদশ নির্বাচন সামনে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লে ব্যাপক পোলারাইজেশন দেখা যাচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সমমনা ও ক্ষমতাসীনদের আপাতত পছন্দ করে নাÑ এমন দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেছে। এতে বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টসহ বাম ঘরানার কয়েকটি দলের সঙ্গে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলও তাদের জোটের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষমতাসীন এ জোটটির ১৮ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। জোটের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানিয়েছেন, বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তিনি বলেছেন, বিএনপিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পরাজিত করার লক্ষ্যে তৃণমূল বিএনপিসহ ৯টি দল আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। এজন্য ৯টি দলের নীতি-নির্ধারকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, সিদ্ধান্ত নেবেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের অশুভ শক্তিকে চূড়ান্ত পরাজিত করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। নাসিম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যাপারে নির্দেশনা আছে, এ লক্ষ্যে আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। একাত্তরের ঘাতকদের লালনকারী খালেদা জিয়ার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সেখানে ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে চায় তারা। এ লড়াইয়ের সঙ্গে শরিক হতে চায় বলে তাই তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যে অশুভ শক্তি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়েছিল তারা আজও চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত আছে। তিনি আরো বলেন, সামনে ডিসেম্বরে নির্বাচন। কমিশনের নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে। সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। মানবতার নেত্রী হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন এমনকি এই ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আর সেই নেত্রীকে বারবার বাধাগ্রস্ত করার জন্য চক্রান্ত হচ্ছে। তার পরও বাংলাদেশকে বিস্ময় স্থানে নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। ১৪ দলের মুখপাত্র আরো বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের পরাজিত করবÑ এই লড়াই আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে চাই ।

ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো হলোÑ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক জোট। তৃণমূল বিএনপির নাজমুল হুদা বলেন, জাতীয়তাবাদী শক্তি বলতে তাদেরই বোঝায় যারা অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিশ্বাস করে। এজন্য জাতীয়তাবাদী জোট হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অনুরাগী হয়ে কাজ করতে চাই। বিশেষ করে যে সব চক্রান্ত হচ্ছে জনগণের বিরুদ্ধে সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই এই অসাম্প্রদায়িক জোট করার জন্য কাজ করব।

তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশের জনগণ হবে সব ক্ষমতার উৎস। এখন আর জ্বালাও-পোড়াও হয় না, কারণ শেখ হাসিনা তার বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু বন্ধ করছেন। বিএনপি ভুল করেছে এজন্য আমরা সমর্থন করি না। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী জোট গঠন অশুভ শক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রস্তাব রাখবেন।

এদিকে দেশের রাজনীতিতে যুক্ত হলো আরো একটি নতুন জোট। গত ১৮ জুলাই রাজধানীর পুরানা পল্টনের মৈত্রী মিলনায়তনে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ৮ দলের সমন্বয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ঘোষণা দেন বামপন্থি নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান। আর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্তী। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক।

সংবাদ সম্মেলনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, রাষ্ট্র ও সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের রাজনীতিতে ধনী-গরিবদের মধ্যে আয় ও সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত, মার্কিন ও পাকিস্তানসহ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অপতৎপরতা চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় দুই দলের বিদেশি প্রভুদের কাছে ধরনা বাংলাদেশে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়িয়ে তুলেছে, বিপদগ্রস্ত করছে দেশের সার্বভৌমত্বকে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের’ মডেল নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকারকে প্রহসনে পরিণত করেছে।

সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সব দল ও সমাজের অপরাপর অংশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বে নেতারা দেশ বাঁচানো, গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। সংবাদ সম্মেলনে ৮টি রাজনৈতিক দলÑ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সমন্বয়ে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

জোটের প্রথম সমন্বয়ক হিসেবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের নাম ঘোষণা করা হয়। জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা হচ্ছেনÑ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মো. শাহ আলম, খালেকুজ্জামান, বজলুর রশীদ ফিরোজ, সাইফুল হক, আকবর খান, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ফখরুদ্দিন কবির আতিক, জোনায়েদ সাকি, ফিরোজ আহমেদ, মোশাররফ হোসেন নান্নু, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, মোশরেফা মিশু, মমিন উর রহমান বিশাল, হামিদুল হক, রনজিৎ কুমার।

সংবাদ সম্মেলনে জোটের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দুঃশাসন, জুলুম, দুর্নীতি-লুটপাটতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র প্রতিরোধ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে আগামী ২৪ জুলাই ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় বিকেল ৪টায় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ। আগামী ৪ আগস্ট ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় মতবিনিময় সভা। আগামী ১০ ও ১১ আগস্ট দেশের ৬টি বিভাগীয় শহর, যথাক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুরে সভা-সমাবেশ, জনসভা ও মিছিল। জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা এসব কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। এদিকে দুই ধরনের কার্যক্রম নিয়ে মাঠে নামছেন চারদলীয় যুক্তফ্রন্টের প্রভাবশালী দুই নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ও মাহী বি. চৌধুরী।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করবেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। আর মাহী বি. চৌধুরী আসছেন ‘প্রজন্ম উদ্যোগ’ নিয়ে। দুই উদ্যোগেই যুক্তফ্রন্টসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করার আশা প্রকাশ করেছেন তারা। গত ১৭ জুলাই রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাহমুদুর রহমান মান্নার উদ্যোগে ‘ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট স্টেট করাপশন’-এর আত্মপ্রকাশ হয়। মূলত অনলাইনের মাধ্যমেই এর প্রচারণার মূলপর্বটি পরিচালিত হবে। জানা গেছে, ‘ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট স্টেট করাপশন’-এর মূল স্লোগান ‘দুর্নীতির মহোৎসবে দেশ।’ এই ক্যাম্পেইন উপলক্ষে সারা দেশে পোস্টার, লিফলেট ও অনলাইনে পেজ ওপেন করা হবে।

মাহমুদুর রহমান মান্না জানান, সাধারণ সরকারি চাকরিতে ৭-৮ লাখ টাকা ঘুষ লাগে। প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকা। মেগা প্রকল্পের বাইরে প্রতিবছর কমপক্ষে ৭৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এই ক্যাম্পেইনে পদ্মা সেতুর বাজেট বৃদ্ধিকরণ, রেল নির্মাণে ব্যয়, ভারতের সঙ্গে তুলনাসহ সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে অত্যধিক ব্যয় এবং ব্যাংকের দুর্নীতিগুলোর বিষয়েও বলা হবে।

যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সমন্বয়ে ‘প্রজন্ম উদ্যোগ’ করছেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী। সমসাময়িক বিভিন্ন পেশার দায়িত্বশীলরা তার এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হবেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র তারকা, তরুণ ব্যাংকারসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আরও অনেকে যুক্ত হবেন। ‘প্রজন্ম উদ্যোগ’ যুক্তফ্রন্টের পলিটিক্যাল কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব পালন করবে। জোটের প্রোগ্রামগুলোর আয়োজন, মিডিয়া কভারেজ, ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক, পোস্টার, ডিজাইনসহ এ ধরনের কাজগুলো দেখভাল করবে তারা। ইতিমধ্যে মাহী বি. চৌধুরীর বাসায় ‘উদ্যোগ’-এর সঙ্গে জড়িতদের একাধিকবার বৈঠকও হয়েছে।

বাছির জামাল: সিনিয়র সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :