এবার যুদ্ধটা হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে

জহির উদ্দিন বাবর
 | প্রকাশিত : ২৯ জুলাই ২০১৮, ১০:৩৩
ফাইল ছবি

সম্প্রতি দেশে মাদকের বিরুদ্ধে বড়ধরনের একটি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ‘চল যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ এই স্লোগানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি এই অভিযানে নামে। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত কয়েক মাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজার হাজার লোককে। বর্তমানে কারাগারে যত বন্দি আছে এর বড় অংশটি মাদকে অভিযুক্ত। মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে সারাদেশে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক লোক র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ কয়েকটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কিছুটা সমালোচনা হয়েছে বটে। তবে সার্বিকভাবে মাদকবিরোধী অভিযান সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন এবং কথিত সুশীল সমাজ এই অভিযানের সমালোচনা করলেও সাধারণ মানুষ এতে বেশ খুশি। কারণ মাদক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে এমন একটি অভিযান ছিল অনিবার্য। এই অভিযানের ফলে মাদক যে নির্মূল হয়ে গেছে তা নয়, তবে মাদক কারবারি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটা ভয় অন্তত ঢুকেছে। আশা করা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি থাকলে মাদক পুরোপুরি নির্মূল না হলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

আমাদের দেশে মাদকের মতোই দুর্নীতি অনেক বড় একটি সমস্যা। দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারের আমলেই দুর্নীতির মাত্রা শুধু বেড়েছেই। মাঝে আমরা পরপর কয়েক বার দুর্নীতিতে বিশ^চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো লজ্জাজনক পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম। তবে সূচকে কিছুটা উন্নতি করায় সেই লজ্জার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু দুর্নীতির মাত্রা খুব একটা কমেনি। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অসততা বাসা বেঁধেছে। জনগণের সেবা দানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দিন দিন দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী নানা প্রচার, সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এর মাত্রা কমছে না। সামাজিক এই অপরাধটি দিন দিন নতুন রূপ ধারণ করছে। যেসব খাতে দুর্নীতির কথা একসময় কল্পনাও করা যেতো না সেখানেও এখন দুর্নীতির সয়লাব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন এমনকি বিচার বিভাগ পর্যন্ত দুর্নীতির ভেড়াজালে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে চোখ বুলালে শুধু দুর্নীতির খবরই চোখে পড়ে। সোনা থেকে কয়লা কী বাদ যাচ্ছে দুর্নীতি থেকে!

অসততা আজ আমাদের সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে। প্রশাসনের বড় কর্তা থেকে শুরু করে একজন সাধারণ কেরানি পর্যন্ত অসৎ উপার্জনের পথ বেছে নিচ্ছেন। শিল্পপতি থেকে শুরু করে একজন সাধারণ দিনমজুর পর্যন্ত নানাভাবে অসততার আশ্রয় নিচ্ছেন। রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক কোন পেশাজীবী আছেন যারা অসততা থেকে পুরোপুরি মুক্ত? একজন রাজনীতিবিদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের কাজে আসছেন না। জনগণকে দেয়া কোনো ওয়াদাই পূর্ণ করছেন না। একজন আইনজীবী সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে টু পাইস কামাচ্ছেন। অর্থের লোভে ভয়ংকর অপরাধীর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। একজন ব্যবসায়ী পদে পদে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন। একজন শিক্ষক সামান্য অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁসের মতো জাতি ধ্বংসের ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠছেন। একজন চিকিৎসক রোগীকে কাঁচির নিচে শুইয়ে অনৈতিকভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন এমন সাংবাদিক পাওয়া আজ অনেক কঠিন ব্যাপার। এমনকি মসজিদের ইমাম, আলেম-উলামা পর্যন্ত আজকাল নানা অসততায় জড়িয়ে যাচ্ছেন।

মূলত আমাদের সমাজব্যবস্থা আজ অসততার একটি চেইনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। আমরা নিজেরা আরেকজনকে ঠকাচ্ছি, কিন্তু এই আমরাই আবার অন্য জায়গায় গিয়ে ঠকছি। সরকারি অফিসের কোনো কর্মকর্তা হয়ত বাড়তি আয়ের লোভে ঘুষ নিচ্ছেন। বেতনের বাইরে প্রতি মাসে কয়েক হাজার টাকা আয় করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। সেই কর্মকর্তাই হয়ত বিদ্যুৎ বিলের ঘাপলায় পড়লেন। পরে সেই অফিসের কর্মচারীকে বাড়তি কয়েক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হলো। বিলের ফাঁদে ফেলে বিদ্যুৎ অফিসের যে কর্মচারী বাড়তি সুবিধা নিলেন তিনিই আবার কোনো চিকিৎসকের কাছে গিয়ে অহেতুক টেস্টের ফাঁদে পড়লেন। যে চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কসাইয়ের মতো আচরণ করে অনৈতিক অর্থ কামাই করলেন তিনিই আবার নিজের বাচ্চাটিকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে ধরা পড়লেন কোনো অসৎ কর্মকর্তার হাতে। স্কুলের কর্মকর্তা ভর্তি বাণিজ্যে তার পকেট মোটা করলেও হয়ত ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এভাবে একটি চেইনের মাধ্যমে আমরা সমাজের এক শ্রেণির মানুষ আরেক শ্রেণিকে ঠকাচ্ছি, কিন্তু দিনশেষে নিজেরাই ঠকে যাচ্ছি।

অসততা কোনোদিন কারও উন্নতির কারণ হতে পারে না। স্বাধীনতার এতো বছর পর জাতি হিসেবে আমাদের যে জায়গাটিতে থাকার কথা ছিল সেখানে যে আমরা নেই এটা সবাই স্বীকার করবেন। আর এর জন্য প্রধানত দায়ী দুর্নীতি ও অসততা। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটা দিয়ে আমরা কয়েকটি পদ্মা সেতু করতে পারতাম। আমাদের সমাজের রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী নামের রাঘববোয়ালেরা অনৈতিকভাবে উপার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনের ধাপে ধাপে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও লুটপাট হয় তা বন্ধ করতে পারলে আমাদের দেশ অনেক আগেই মধ্যম আয়ে উন্নীত হতে পারতো। অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে থাকা অসততা ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমরা কখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছতে পারবো না।

সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে যেভাবে একটি যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে সেভাবেই আরেকটি যুদ্ধ হওয়া উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সমাজকে অসততার চেইন থেকে মুক্ত করার এই যুদ্ধ শুধু সরকারের একার নয়, প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। সরকারের উঁচু মহল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও তা তেমন সুফল বয়ে আনবে না যতক্ষণ না এর সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণ জড়াবে। সরকারের উদ্যোগ এবং জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই সম্ভব দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সফল অভিযান। সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো অন্যায় ও অসততাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। গত এসএসসি পরীক্ষার সময় প্রশ্নফাঁস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। বেশির ভাগ পরীক্ষার প্রশ্ন আগেই ফাঁস হয়ে যায়। এমনকি ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করলেও তা রুখতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। তবে এর কিছুদিন পর যখন এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো তখন কিন্তু প্রশ্নফাঁসের তেমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এর কারণ হলো ছিদ্রগুলো বের করে তা বন্ধ করার প্রচেষ্টা ছিল কর্তৃপক্ষের। প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই প্রমাণ করে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো অসততা রুখে দেয়া সম্ভব।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুরু হতে হবে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, দলীয় নেতাকর্মীদের সবসময় দুর্নীতিমুক্ত থাকার তাগিদ দেন। মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বড় কোনো অভিযোগ নেই। তবে শুধু উচ্চমহলের উদ্যোগের দ্বারা দুর্নীতি রোধ করা কখনও সম্ভব নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা ধাপে গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা বসে আছেন তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে উঁচু থেকে নিচু পর্যায় পর্যন্ত দায়িত্বশীলদের মধ্যে দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। সমাজের সবস্তরের মানুষকে এই অভিযানে ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিক নিজ নিজ অবস্থান থেকে দুর্নীতি ও অসততার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে তা অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার একটা প্রবণতা দিন দিন সমাজে প্রবল হচ্ছে। আমরা চোখের সামনে অন্যায় দেখেও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছি না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করছি না। ফলে অন্যায়কারীরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এজন্য সমাজ থেকে দুর্নীতি রুখতে হলে আগে সবাইকে সচেতন করতে হবে। সমাজের সর্বশ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া দুর্নীতি রোধ করা যাবে না।

আমাদের দুর্নীতিবিরোধী একটি সংস্থা আছে। তাদের কিছু কর্মকা- বেশ দৃশ্যমান। তবে মানুষ দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের কাছে যতটা সক্রিয়তা আশা করে ততটা পায় না। এর হয়ত অনেক যৌক্তিক কারণ আছে। তবুও মানুষের আশার জায়গা হলো এই প্রতিষ্ঠানটি। মন্দের ভালো দুদকই পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাজকে ঝাঁকুনি দেয়ার মতো একটি অভিযান শুরু করতে। সরকার, প্রশাসন, জনগণ সবাইকে নিয়ে এই অভিযানটা শুরু করলে আশা করা যায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অসততার চেইন ভেঙে যাবে। দুর্নীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এলে উন্নয়ন ও প্রগতির পথে আমাদের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না।

জহির উদ্দিন বাবর: বার্তা সম্পাদক, ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :