জামায়াতের ‘সিলেট নির্বাচন’ কিসের ইঙ্গিত?

বাছির জামাল
 | প্রকাশিত : ২৯ জুলাই ২০১৮, ১০:৪৮

শেষ অবধি সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়নি জামায়াতে ইসলামী। ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে তারা তাদের প্রার্থিতা রেখে দিয়ে আলাদাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াত মনে করে, সিলেটে তাদের অবস্থান ভালো। অন্যান্য সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকেই সমর্থন দেওয়া হয়েছে কেবল এই আশায় যে, সিলেটে বিএনপি তাদেরকে সমর্থন দেবে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট যদি সমর্থন করত, তাহলে তাদের এ নির্বাচন ভালো করার সম্ভাবনা ছিল। যদিও বিগত সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও মুক্ত যতদিন ছিলেন, ততদিন সিলেট নগরীর উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন আরিফুল। অনেকেই মনে করেন, আরিফুল হকের একক প্রচেষ্টায় স্থানীয় জলাশয়গুলো রক্ষা পাওয়ায় সিলেট নগরীতে জলাবদ্ধতা এড়ানো গেছে। এ কারণেই সিলেট নগরীর ভোটারের কাছে আরিফুলের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় তার প্রতি সাধারণ ভোটারের একটি ‘সিমপ্যাথি’ কাজ করছে। বিএনপি সিলেট সিটি নির্বাচনে তাদের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর এসব দিক ‘ক্যাশ’ করতে চাচ্ছে। কিন্তু বাধা এখন জামায়াত।

সিলেটে বিএনপির জন্য একটি সুখবর হচ্ছে যে, তাদের বিদ্রোহী প্রার্থী নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যদিও কুশিয়ারা নদীর অনেক জল ইতিমধ্যে ঘোলা হয়েছে। কারণ বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় বদরুজ্জামান সেলিমকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করে দেয় বিএনপি। তবে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়ায় এখন আবার স্বপদে ফিরেছেন সেলিম। তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তুলনায় ‘কোণঠাসা আরিফুল’ আগের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় এসেছেন। এখন জামায়াত যদি তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিত, তাহলে আরিফুলের অবস্থা আরো ভালো হতো। যদিও বিগত দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথাই বলে।

সিলেট ছাড়াও অন্য দুই সিটি বরিশাল ও রাজশাহীতে জামায়াত মেয়র পদে বিএনপির আগেই প্রার্থী দিয়ে মাঠে নেমেছে। বরিশাল ও রাজশাহীতে জামায়াত মেয়র পদে যথাক্রমে মুয়ায্যম হোসাইন ও সিদ্দিক হোসেনকে প্রার্থী করে প্রচারে নেমেছিল। তবে এই দুই সিটিতে জামায়াত প্রার্থী সরিয়ে নিয়েছে। রাজশাহীতে জামায়াত নেতারা বিশেষ করে মহিলা কর্মীরা বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। বরিশালেও এমন অবস্থা দেখা গেছে। কিন্তু সিলেটের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ভিন্ন। তাদের যুক্তি, গাজীপুর ও খুলনা, তার আগে ঢাকা, রংপুরসহ সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই তারা বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে আসছে। সিলেটে তারা এর প্রতিদান চান। এ লক্ষ্যে জামায়াত দলের সিলেট মহানগর কমিটির আমির এহসান মাহবুব জোবায়েরকে প্রার্থী করে।

জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, অন্য সিটির তুলনায় সিলেটে তাদের সাংগঠনিক অবস্থান ভালো। তবে দলটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, সিলেটে প্রার্থী দিয়ে অনমনীয় অবস্থান নেওয়ার পেছনে দলের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমানের আগ্রহ বেশি কাজ করেছে। এর নেপথ্যে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।

জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে ‘সিলেট’ নিয়ে জামায়াতের এমন একগুঁয়ে মনোভাব নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে বিএনপিকে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন করে এলেও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়ে হঠাৎ নড়েচড়ে বসার চেষ্টায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। বিএনপি মনে করছে, এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসন নিয়ে দরকষাকষির একটি ইঙ্গিত। সিলেটে আরিফুলের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জামায়াতের নাছোড় অবস্থান নেওয়াকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। তারা এই সময়ে জোটের প্রধান দুটি দলের মধ্যে এ ধরনের প্রতিদ্ব›িদ্বতাকে ২০ দলীয় জোটের ভেতরে দ্ব›দ্ব ও সন্দেহ তৈরির সূত্রপাত হিসেবে দেখছেন। কারণ সিলেটে ২০ দলীয় জোটের অপর শরিক দল খেলাফত মজলিসের প্রার্থী কে এম আবদুল্লাহ আল মামুন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি আরিফুলের পক্ষে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।

এ ছাড়া বিএনপি যে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে, জামায়াতের হঠাৎ করে নড়েচড়ে বসার চেষ্টা সেই ঐক্য প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত সৃষ্টির কৌশল থেকে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিএনপি নেতাদের কারো কারো ধারণা, এসব ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য হলে জামায়াত জোটে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। তাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের আগের অবস্থান নষ্ট হবে। এ কারণে জামায়াত সিলেটে আলাদা নির্বাচন করে বিএনপিকে একটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখছে। আবার জামায়াতের কারণে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে ওই দলগুলোরও আপত্তি আছে বলে কথা বলাবলি আছে। তাই বিএনপিও বৃহত্তর স্বার্থে আপাতত জামায়াতকে পেছনে রেখে জাতীয় ঐক্য গড়তে চাইছে বলে জানা গেছে। অবশ্য এ বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার অতি সম্প্রতি ঢাকার একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, জাতীয় ঐক্যে জামায়াত সমস্যা, এমন আলোচনা তাদের কাছে আসেনি। তারাও আদর্শিক কারণে সবার সঙ্গে জোট করতে পারেন না, এমন দৃষ্টিভঙ্গি তো তাদেরও থাকতে পারে। তবে তিনি বলেন, এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যদি একটি দফার বিষয়ে ঐকমত্য থাকে, তাহলে জোটে জোটে লিয়াজোঁ হয়ে আন্দোলন হতে পারে।

আরেকটি কথা ইতিমধ্যে বাজারে চাউর হয়ে গেছে যে, সিলেট সিটি নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনে যখন জামায়াত আলাদা প্রার্থী নিয়ে এগিয়ে গেছে, তখন তাদের আমির মকবুল আহমাদ গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ১০ জুলাই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৩টির মতো মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ঢাকার মতিঝিল ও পল্টন থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলে তাকে জামিন দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদ ও নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ ৯ নেতাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মকবুল আহমাদ ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে শপথগ্রহণ করেন । জামায়াতে ইসলামীর রুকনরা গোপন ভোটের মাধ্যমে ২০১৭-২০১৯ কার্যকালের জন্য তাকে সংগঠনটির আমির হিসেবে নির্বাচিত করেন।

যদিও ধরে নেওয়া যায় যে, আইনি লড়াইয়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই জামায়াত আমির মুক্তি পেয়েছেন। তবুও এমন এক সময় তিনি জামিন পেলেন যখন সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটি টানাপড়েন মোটামুটিভাবে চলছে। মকবুলের হঠাৎ জামিন পাওয়াকে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের ‘বুঝাপড়ার’ ইঙ্গিত হিসেবে দেখতে চাইছেন অনেকেই। যদিও বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে বলতে চাইছেন যে, এটা স্থানীয় নির্বাচন। এখানে আলাদাভাবে যেকোনো দল নির্বাচন করতেই পারে। তবে ভেতরে ভেতরে যে বিএনপি নেতারা পুড়ছেন তা বলা বাহুল্য।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, শেষ পর্যন্ত জামায়াত সিলেটের নির্বাচন থেকে না সরলে ধরে নিতে হবে, এই অবস্থানের পেছনে তাদের রাজনৈতিক কৌশল আছে। তা হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের অবস্থান কী হতে পারে, তার পূর্বাভাস মিলতে পারে সিলেটের নির্বাচন থেকে। ইতিমধ্যে জামায়াত সিটি নির্বাচনে আগাম মেয়র প্রার্থী ঘোষণার মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও একই ধরনের কৌশল নিয়েছে। দলটি ৭০ থেকে ৮০টি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন চ‚ড়ান্ত করে তাদের এলাকায় কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। এসব প্রার্থীর অনেকে নিজ নিজ এলাকায় পোস্টার ছেপে জানান দিয়েছেন।

যদিও রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। দলটিকে এখন হয় জোটগতভাবে ধানের শীষ প্রতীকে অথবা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে হবে। জোটগত রাজনীতিতে থাকলেও জামায়াত স্বতন্ত্রভাবেও ভোট করার একটা প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দলটির একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। ‘সিলেট নির্বাচন’ জামায়াতের এমন কৌশলের একটি ‘ওয়ার্মআপ ম্যাচ’ কি না কে জানে!

বাছির জামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :