জীবনবিমা: দিলাম এক লাখ ৮৫ হাজার, ফেরত পেলাম ৩১ হাজার

সুমন মাহবুব
 | প্রকাশিত : ২৯ জুলাই ২০১৮, ১৭:৪১

রাবরই আমার ইন্সুরেন্স কোম্পানির প্রতি এলার্জি। কেন জানি এদেরকে আমি সহ্য করতে পারি না। এ পেশা সর্বদা আমার কাছে প্রতারণা, ভণ্ড, ধোঁকাবাজি লাগে (হয়তো আমার ধারণা ভুলও হতে পারে)। তবে যাই হোক, ইনসুরেন্স কোম্পানির সাথে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করছি যদি কারও উপকারে আসে।

ঘটনার সূত্রপাত ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে। আমি তখন পোস্ট গ্র্যাজ্যুয়েশন কোর্স শেষে জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে পুনরায় যোগ দিয়েছি। আমার সাথে মেটলাইফ আলিকোর একজন লোক রীতিমত সাক্ষাৎ শুরু করলেন এবং আমাকে উনি বিভিন্ন ভাবে ইনফ্লুয়েন্স করতে চেষ্টা করলেন একটা পলিসি স্টার্ট করতে।

চেষ্টা চলতে থাকল ২০১২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু আমি তো আগেই বলেছি, ইন্সুরেন্স কোম্পানির প্রতি আমার এলার্জি। তাই শত চেষ্টা করেও ও আমাকে দিয়ে কোনো পলিসি শুরু করাতে পারেনি।

তাই ভাববেন না আমি বেঁচে গেছি। ওরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ওদের স্বভাব হচ্ছে জোঁকের মতো। ধরলে আর সহজে ছাড়াতে পারবেন না। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সাল শেষ। ২০১৬ সাল থেকে আবার সাক্ষাতৎ শুরু। এবার আমাদের মেডিকেলের এক সিনিয়র ডাক্তার ভাই ওর ফ্রেন্ড, আমাদের মেডিকেলের আরেক জন সিনিয়র ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর ওনার বীমার সব টাকা ওনার পরিবারকে ফেরত দেয়া ইত্যাদি প্রচার করতে লাগল। আর আমিও আস্তে আস্তে ওর মিষ্টি কথায় ধরা দেয়া শুরু করলাম।

যার মাধ্যমে আমি এই মহান পলিসি করি তিনি হচ্ছেন মি. লিয়াকত। এই মেডিকেলের অনেকেই ওনাকে চেনে। হ্যামিলনের বাঁশিওলার মত যাদুকরী সুর ওর কথায়। সেই কথা শুনে যে কেউ ধরা দিতে বাধ্য। তাই শেষ পর্যন্ত আমিও ধরা দেই। মনে মনে ঠিক করলাম কাউকে কিছু বলব না। এমনকি আমার সহধর্মিণীকে ও জানালাম না।

২০১৬ সালের মে মাসে আমি মেটলাইফ এর Life Line policy for 20 years শুরু করি। আমার পলিসি নং ২৭৭৯৯৭৩ ও কোড নং ৭৯১-০১-৬০৪।

প্রতি মাসে সাত হাজার ৪৩১ টাকা আমার স্যালারি অ্যাকাউন্ট থেকে অনলাইনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওরা নিয়ে যেত। চালু করার এক বছর পর আমি যখন পলিসি বন্ধ করতে চাচ্ছিলাম তখন মিঃ লিয়াকত আমাকে বলল এক বছর পর বন্ধ করলে আমি কিছুই পাব না। কমপক্ষে দুই বছর চালু রাখতে হবে তাহলে আমি আমার মূল টাকা ফেরত পাব।

যদিও পলিসি চালু করার আগে সে বলেছিল আমি যখনই বন্ধ করতে চাইব তখনই বন্ধ করতে পারব এবং মূল টাকা ফেরত পাব, সে সব ব্যবস্থা করবে। আমি ওর যাদুকরী সুরের মূর্চ্ছনায় এতটাই বিমোহিত হয়েছিলাম যে বলেছিলাম ভাই আপনি যখন আছেন তখন আমার আর শর্ত পড়ে সময় নষ্ট করে লাভ কি? তাই ওর মুখের কথায় সবকিছুতে সাক্ষর করি ।

আমি ওর কথা বিশ্বাস করে পলিসিটি আরও এক বছর চালু রাখলাম। দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর ২০১৮ সালের মে মাসে আমি যখন ওকে বললাম আমি পলিসিটা এখন বন্ধ করব আপনি সব ব্যবস্থা করেন, তখন সে আমাকে বলল এখন বন্ধ করলে একটা পেনাল্টি ফি আসবে।

আমি ভাবলাম, পেনাল্টি ফি আর কত আসবে? বললাম, ‘পেনাল্টি ফি আসুক, তারপর ও বন্ধের ব্যবস্থা করেন।’ তারপর তিনি আবেদনপত্র তৈরি করল আর আমাকে বলল, ঢাকা হেড অফিস থেকে আমাকে ফোন দেবে।

৩-৪ দিন পর একদিন সকালে হেড অফিস থেকে ফোন আসে। একজন ভদ্র মহিলা আমার কাছে জানতে চান, আমি কি সত্যি পলিসি বন্ধ করতে চাই এবং কেন চাই ?

আমি তাকে আমার সমস্যাগুলো বললাম এবং বন্ধ করতে আগ্রহী জানালাম। তখন সে আমাকে জানাল, মে মাস পর্যন্ত আমার ১,৮৫,০০০ (এক লক্ষ পঁচাশি হাজার) টাকা জমা হয়েছে। আমি যদি এখন বন্ধ করি তবে ৩১,০০০ (একত্রিশ হাজার) টাকা পাব।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই টাকাটা কি আপনারা লাভ দেবেন?’ তখন সে আমাকে বলল, এটা আমার মূল টাকা যা আমি ফেরত পাব।

শুনে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম আমার বাকি টাকার কী হবে? বলল ওইটা পেনাল্টি ফি। বললাম, ‘কি বলেন এক লাখ ৮৫ হাজার টাকার মধ্যে ৩১ হজার টাকা ফেরত দেবেন আর এক লাখ ৫৪ হাজার টাকা পেনাল্টি ফি? এটা কি মগের মুল্লুক পেয়েছেন?’

আমি লিয়াকতকে ফোন করে এসব জানাই। সে আমাকে বলে এটা লাইফণাইন পলিসি? এটাতে আপনাকে অনেক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আপনি যদি অসুস্থ হতেন তবে কোম্পানি আপনার চিকিৎসার খরচ দিত। অথবা আপনি যদি মারা যেতেন তাহলে আপনার ফ্যামিলিকে পুরো টাকা দেয়া হতো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কি আমার বদনসিব যে আমি অসুস্থ হইনি বা মারা যাইনি? যেখানে আমি জীবিত অবস্থাতেই আমার মূল টাকা ফেরত পাচ্ছি না, সেখানে মারা গেলে আপনারা কী দেবেন সেটা বুঝতে পারছি।’

তখন সে আমাকে আবার বলল, ‘আপনি পলিসিটা চালু রাখেন।’ আমি বললাম, ‘কখনো নয়। আমি এক বছর আগে যদি বন্ধ করতাম তাহলে এতটা ক্ষতি হতো না। যা ক্ষতি হবার হয়েছে। আপনি এটা এখনই বন্ধ করেন।’

তারপর তারা আমার অ্যাকাউন্টে ৩০ হাজার ৯৫২ টাকা ফেরত পাঠিয়েছে। আমি আর কোন আইনি ব্যবস্থায় যাইনি । কারণ এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা খুবই কঠিন কাজ। নামে যেমন American Life Insurance Company (ALICO) ঠিক তেমনি এদের পলিসির মারপ্যাঁচ। এদের ফাঁদে পা দেয়ার আগে হাজার বার চিন্তা করবেন। কারণ পা দেয়ার পর আর কিছুই করার থাকবে না।

ওরা আপনাকে বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দিবে, বলবে ইন্সুরেন্স করলে আপনার ট্যাক্সের ক্ষেত্রে অনেক উপকার পাবেন। আপনার পরিচিত ২/১ জনের নাম বলবে যারা ইন্সুরেন্স করে লাভবান হয়েছেন (যদিও তাদের সংখ্যা অনেক অনেক কম। ব্যবসাটা সচল রাখতে ২/১ জনকে ডামি হিসেবে ব্যবহার করে ওরা)।

আমার অনুরোধ আমি যেভাবে তাদের ফাঁদে আটকা পড়ে নিজের টাকা তাদের আয়েশের কাজে নষ্ট করেছি আপনারা যাতে সে ভূল না করেন। নিজের কষ্টের উপার্জনের টাকা নিজের কাছে রাখুন অথবা ব্যাংকে রাখুন যেখান থেকে প্রয়োজনের মুহূর্তে আপনি তৎক্ষণাৎ ফেরত পাবেন।

এ ধরনের ভণ্ড, প্রতারকদের প্রতারণা যদি আমরা সমাজে সবার কাছে তুলে ধরি তাহলে সাধারণ মানুষগণ রক্ষা পাবে আর ওরাও ওদের চোরাবালির ফাঁদে আর কাউকে আটকাতে পারবে না।

আজ অনলাইনে মেটলাইফের একটা নিউজ পড়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই, আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাটা ও শেয়ার করা উচিত। এতে হয়তো কারও না কারও উপকার হতেও পারে।

লেখক: চিকিৎসক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :