যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই

প্রভাষ আমিন
 | প্রকাশিত : ৩০ জুলাই ২০১৮, ১১:৪৫

ওয়ানডে সিরিজে ঘুরে দাঁড়ালেও বাংলাদেশ চলমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজটি আসলে ভুলে যেতে চাইবে। সিরিজ তো নয় যেন দুঃস্বপ্ন, দীর্ঘ ও ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ আকাশে উড়ছিল। বিনা নোটিশে হাথুরুর চলে যাওয়ার পর যেন নিয়ন্ত্রণটা ছুটে যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন এখন ভোকাট্টা, সুতো ছেড়া ঘুড়ি। এলোমেলো, আজ এদিকে গোত্তা মারছে তো কাল ওদিকে। টি-২০তে ততটা না হলেও ওয়ানডেতে বাংলাদেশ এখন প্রতিষ্ঠিত শক্তি। কিন্তু আসল ক্রিকেটেই আমরা দুর্বল। ঠিক ধরেছেন, আমার বিবেচনায় ক্রিকেট মানেই শুভ্রতা, ক্রিকেট মানেই টেস্ট ক্রিকেট। ওয়ানডে যেমন-তেমন টি-২০ আমি দেখিই না। আমার মনে সব ম্যাচই পাতানো, এ যেন ক্রিকেট নয়, জুয়া খেলা।

আমার দুঃখ, আসল যে ক্রিকেট, সেই টেস্ট ক্রিকেটেই বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ। কেন খারাপ? এই প্রশ্নের অনেক উত্তর আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ধৈর্য কম, স্ট্যামিনা কম, টেম্পারমেন্ট কম, সবচেয়ে বড় কথা টেস্টের ব্যাপারে আগ্রহ কম। আগ্রহ কম কেন? কারণ ওয়ানডে বা টি-২০-এর মতো টেস্টে টাকার ঝনঝনানি কম। ক্রিকেটাররা এক মৌসুম শুধু টি-২০ খেলে যত টাকা কামাতে পারে, সারা জীবন টেস্ট খেলেও ততটা পারে না। আর একটু ভালো খেললে বিপিএল, আইপিএল, বিগব্যাশ; হেন-তেন; মোটামুটি ভ্রাম্যমাণ ক্রিকেটার হয়ে যাওয়া যায়। তবে ক্রিকেটের এই অধঃপতন যে শুধু বাংলাদেশে তা নয়; বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা ক্রিকেটার টি-২০ ক্যারিয়ার লম্বা করতে টেস্ট আর ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়ে নেন। এই লোভের বিষ ছড়িয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের রন্ধ্রে রন্ধ্রেও। টেস্ট মানে পরীক্ষা। এখন আর কেউ লম্বা পরীক্ষা দিতে চায় না। এমসিকিউতে টিক দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে যেতে চায়।

বাংলাদেশ টেস্টে খারাপ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের টেস্ট সিরিজে যা হয়েছে তা কিন্তু অবিশ্বাস্য। খেলায় জয়-পরাজয় আছেই। তবে সিরিজের দুই টেস্টেই যে গো-হারা হেরেছে, বাংলাদেশের নামের সঙ্গে তা বড্ড বেমানান। টেস্ট অধিনায়ক সাকিব আল হাসান স্বীকার করেছেন, সিরিজের প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানে গুটিয়ে যাওয়ার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহসটাই ছিল না বাংলাদেশের। কিন্তু ওয়ানডে সিরিজেই দারুণ সাহসের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে দুর্দান্ত জয়, দ্বিতীয় ম্যাচে মাত্র ৩ রানের পরাজয়। এই সাহস বাংলাদেশ পেলো কোত্থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে অনেক রহস্যের সমাধান। মাশরাফি দলের সঙ্গে যোগ দিয়েই যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় জাগিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটারদের। মাশরাফি কী এমন মন্ত্র দিয়েছেন? মাশরাফি খালি ক্রিকেটারদের দেশের জন্য উজাড় করে খেলতে বলেছেন। এটা তো খুবই সহজ কথা। সবাই বলতে পারে। কিন্তু মুখে বললেই হবে না। আপনাকেও সেটা করতে হবে। দলের অন্যরা যখন দেখবে মাঠে আপনি নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন, তখনই কেবল আপনার কথা অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে। নইলে এই বদলে দেওয়ার মন্ত্র শুধুই কথার কথা, কাজ করবে না। শরীরে ৯টি অপারেশন নিয়ে যখন মাশরাফি মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তরুণ ক্রিকেটাররাও লজ্জা পায়, তারপর নেতাকে অনুসরণ করে।

সাকিব পারফরমার হিসেবে বিশ্বসেরা। সাকিব দলে থাকা মানেই দুজন ক্রিকেটারÑ একজন পরিপূর্ণ বোলার এবং একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই সাকিবের নিবেদনে ঘাটতি আছে। সাকিব নিজের পারফরম্যান্স-ক্যারিয়ার নিয়ে যতটা চিন্তিত, দল নিয়ে ততটা নয়। সাকিবের নিবেদনের ঘাটতির কথা আমি অনেকবার বলেছি। সবাই ‘সাকিব হেটার’ ধরে নিয়ে আমাকে গালাগাল করেছে। কিন্তু এতদিন আমি যেটা বলেছি, এখন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সেটা বলছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপর্যয়ের পর পাপন বলেছেন, সাকিব-মোস্তাফিজ টেস্ট খেলতে চান না। মুখে না বললেও বারবার তারা সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। পাপন যেটা বলছেন, তিনি সেটা দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন। তিনি তো ক্রিকেটারদের কাছ থেকে দেখেছেন। আর তার বলার পক্ষে যুক্তি তৈরি করে দিয়েছেন সাকিবই। বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় সাকিব ক্লান্তির অজুহাতে টেস্ট সিরিজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে ঘুরে ঘুরে টি-২০ খেললে ক্লান্ত তো আপনি হবেনই। তবুও ছুটি নিয়ে যদি আপনি ক্লান্তি দূর করতে কোথাও বেড়াতে যেতেন, তাহলে বোঝা যেত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট পিচে খাবি খাচ্ছে; সাকিব তখন আওয়ামী লীগের দুই সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়েছেন, এমনকি শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিয়েছেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের ট্র্যাজেডিটা হলো, যিনি টেস্ট খেলতে চান না, তিনিই টেস্ট অধিনায়ক। মুশফিক হয়তো একটু রক্ষণাত্মক। কিন্তু তার নিবেদনে কোনো ঘাটতি নেই। উজাড় করে খেলেন। সেই মুশফিকের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব কেড়ে নিয়ে দেওয়া হলো সাকিবকে। যে দলের অধিনায়ক টেস্ট খেলতে অনাগ্রহী, সে দলের কাছ থেকে আপনি টেস্টে ভালো কিছু আশা করতেই পারবেন না।

মুখে না বললেও সাকিব টেস্ট খেলতে আগ্রহী নন, এটা বিসিবি সভাপতি বুঝে গেছেন। কিন্তু মাশরাফি মুখ ফুটেই বলেছেন তিনি টেস্টে ফিরতে চান। শুধু মুখে বলেই বসে থাকেননি। নিজেকে ফিট রাখতে ঘরোয়া ক্রিকেটে লঙ্গার ভার্সনের ম্যাচও খেলেছেন। টেস্ট দলের অনেকেই যেখানে জাতীয় লীগে খেলতে চান না, সেখানে টেস্টে ফেরার সম্ভাবনা কম জেনেও মাশরাফি নিজেও তৈরি রাখছেন। বিসিবি মাশরাফির টেস্টে ফেরার আগ্রহকে গুরুত্ব না দিলেও তাকে টি-২০তে ফিরতে বলেছেন। মাশরাফি আবার টি-২০তে ফিরতে চান না। অন্য ক্রিকেটাররা যখন টেস্ট ফেলে টি-২০ খেলতে চান, তখন মাশরাফি টি-২০ ফেলে টেস্ট খেলতে চান। এই সময়ে বড্ড বেমানান। কেউ হীরার খোঁজে কাটিয়ে দেন জীবন। আর কেউ হীরা ফেলে ঝকমকে কাচ তুলে পকেট ভর্তি করেন।

টেস্ট খেলতে না চাওয়া সাকিবকে জোর করে অধিনায়ক বানিয়ে দেওয়া আর মাশরাফির আগ্রহ থাকার পরও তাকে বিবেচনায় না নেওয়ার পরিস্থিতি দেখে আমার খালি মনে হয়Ñ

যাহা চাই, তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :