মুক্তগদ্য

ভাঙা আয়নাজুড়ে

ইরাজ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৮, ০৮:৪১

স্মৃতির ভেতরে রয়ে যাওয়া অনেক মুখ। মানুষের মুখ। প্রত্যেকের গল্পগুলো আলাদা। আলাদা তাদের জীবন, ভাষা, বেঁচে থাকার পদ্ধতি আর দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের কারুরই জীবনপথ সমান্তরাল ছিল না। রাজনীতি, হত্যাকা-, বেঁচে থাকার যুদ্ধ, প্রেম, প্রতারণা, রোমাঞ্চ আর পাগলামি জীবনের পথে তাড়া করে নিয়ে গেছে তাদের। এই ঢাকা শহরে জীবনের বিচিত্র প্রবাহে, অদ্ভুত মুহূর্তে সেইসব মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চকিতে হলেও জানা হয়েছিল তাদের জীবনের খ- কাহিনি। সেইসব মানুষের অনেকেই বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। অনেকের সঙ্গে দেখা হয় না বহু বছর। কারো সঙ্গে আজো রয়ে গেছে পরিচয়ের সেই সূত্র। জীবনের চেনা হিসাবের খাতার গ-ির বাইরের সেই মানুষদের সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্প খানিকটা হলেও আঁকা রইলো সাপ্তাহিক এই সময়-এর পৃষ্ঠায়। অনিবার্য কারণেই তাদের অনেকের নাম-পরিচয় লেখায় প্রকাশ করা হলো না।

আজো খুঁজি তাকে। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল প্র্রায় ৩২ বছর আগে। অনেকটা সময়। ভুলে যাওয়ার জন্য, মনে রাখার জন্যও। আমার সবসময়ই মনে হয়, একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের পরিচয়ের প্রক্রিয়ায় আলাদা আলাদা তরঙ্গ থাকে। সেই তরঙ্গের একটা অংশ মনের মধ্যে শেষতক রয়ে যায় স্মৃতির অবয়ব ধারণ করে। ধরা যাক, একটা বইয়ের ছেঁড়া পৃষ্ঠার কিছুটা অংশ। খানিকটা বইয়ের সঙ্গে রয়ে গেছে, বাকিটা উধাও। সেই রয়ে যাওয়া পৃষ্ঠার কিছুটা কাহিনি জানা হয়ে থাকে। ছেঁড়া অংশের লেখাটা আর জানাই হয় না। আমারও পড়া হয়নি এরকম অনেক গল্পের বাকি পৃষ্ঠাগুলো।

আশির দশকের উত্তাল সময়। পাতা ঝরে পড়ার মতো ঝরে পড়ছে তরুণদের প্রাণ। স্বৈরাচারী সরকারের উল্লাসমঞ্চের বিরুদ্ধে তারুণ্যই তখন বিদ্রোহী। আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। একটু আধটু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জড়িত সাংবাদিকতায়ও। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তখন একদল বিপজ্জনক এবং দুঃসাহসী তরুণের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমরা আড্ডা দিই তখন বিশ^বিদ্যালয়ে বিখ্যাত হাকিম ভাইয়ের চায়ের দোকানের পাশের মাঠে। পাশেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। আমাদের বহু ঝাঁজালো দিনরাত্রি কাটে ওই চত্বরে। এই স্মৃতির গল্পে হাকিম ভাইও এক উজ্জ্বল মুখ। তাকে বলা যেতে পারে আমাদের বন্ধু, স্বজন আবার কখনো অভিভাবকও।

ছাত্র রাজনীতিতে তখন চৈত্রের ঘূর্ণি ওঠা হাওয়ার দিন, মিছিলের দিন, প্রতিবাদের দিন। এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের কাল চলছে। বোমা, গুলি, অস্ত্র, পুলিশের ধাওয়া, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় হাকিমের মাঠ তখন সরগরম। হঠাৎ একদিন সেই হাকিম চত্বরে জাহিদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। বলে রাখা ভালো, জাহিদ তার আসল নাম নয়। বিশেষ কারণেই এই লেখায় প্রকৃত নাম পাল্টে দিলাম। চোখে কালো সানগ্লাস, গালে এলোমেলো গজিয়ে ওঠা দাড়ি, বেশ অস্থির এক তরুণ। দু-একটা কথার পরেই সেদিন আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। কিন্তু পরিচয়ের সূত্রটা ছিঁড়ে গেল না। এরপর প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হয় হাকিম ভাইয়ের চায়ের দোকানে। এই দেখা হওয়াটাই এক সময়ে আমাদের নিয়ে গেল এক ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কের ভেতরে। একটু আগে লিখছিলাম কয়েকজন দুঃসাহসী তরুণের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথা। আমার এই স্মৃতিগল্পের জাহিদ ছিল তাদেরই একজন। বেপরোয়া, সাহসী আর কোমরে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানো জাহিদ। সেই সময়ে এরশাদ সরকারের পেটোয়া গু-া বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতের মাঠে এক যোদ্ধা।

জাহিদের সঙ্গে আমি জুড়ে গিয়েছিলাম কিছুটা রাজনৈতিক কারণেও। সঙ্গে ছিল তারুণ্যের চিরকালের বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। ভীষণ টালমাটাল এক সময় আমাদের দুজনের মাঝে সম্পর্কের সেতু তৈরি করে দিলো। তৈরি হলো বন্ধুত্ব।

জাহিদের পদানত একটা শক্তিশালী মোটরবাইকে চেপে আমরা কখনো ঘুরে বেড়াই সেই শহরের নানা জায়গায়। পুরান ঢাকায় গিয়ে ভাত খেয়ে আসি, চলে যাই আগামসি লেনের আইন কলেজে। আমার অন্বেষণপ্রিয় মন একটু একটু করে জানার চেষ্টা করে জীবনবাজি রেখে চলা সেই মানুষটির মনের অন্দর মহলের গল্প। চাপা স্বভাবের যুবক ছিল জাহিদ। খুব বেশি কথা বলত না। এমনও সময় গেছে আমরা পাশাপাশি বসে আছি কোনো জায়গায় কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলিনি অনেকক্ষণ। তারপর এক সময় জাহিদ তার বাইকে উঠে স্টার্ট দিত। আমাকে ইশারা করত উঠে বসতে। আমাদের বাইক বাতাসে মিলিয়ে যেত পলকেই।

জাহিদ মাঝে মাঝে রাতে আমার বাসায় থাকত। তখন পুলিশ খুঁজছে তাকে। প্রথম রাতে জাহিদ এলো হুট করেই। আমি তখন থাকি কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টোদিকে সরকারি কলোনিতে। অনেক রাতে রাস্তার দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি, হঠাৎ শুনি শিস দিচ্ছে কেউ নিচ থেকে। তিনতলার জানালা দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে দেখি বাইকে বসে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে জাহিদ। চমকে গেলাম। দ্রুত নিচে নেমে ওর বাইকটা একতলার প্রতিবেশীদের বাগানে রাখার ব্যবস্থা করে ঘরে ফিরলাম। জানা গেল হলে পুলিশ রেইড হতে পারে তাই জাহিদ চলে এসেছে আমার এখানে। সঙ্গে কয়েকটি অস্ত্র আছে। বিশেষ কৌশলে অস্ত্রগুলো ঘরে লুকিয়ে রেখে জাহিদের খাবারের ব্যবস্থা করি। সে রাতে আমরা আর কেউ ঘুমাইনি। প্রায় পুরো রাতটাই গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রায়ই জাহিদের নিরাপদ নিশি যাপনের জায়গা ছিল আমার ঘর। কত কিছু নিয়ে গল্প করতাম আমরাÑসিনেমা, উপন্যাস, প্রেম, রাজনীতি। খুব সহজ মনের এক অচেনা মানুষকে তখন খুঁজে পাওয়া যেত জাহিদের ভেতরে। অচেনা বললাম এজন্য যে, ক্যাম্পাসে সংঘাত, রাজনীতি আর নানা অঘটনের মাঝে যে জাহিদকে প্রতিদিন দেখা যেত, তার সঙ্গে রাত জেগে আড্ডা দেওয়া মানুষটির কোনো মিল ছিল না।

আমাদের দুজনের সম্পর্কটাকে ঠিক কিভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনি। অস্ত্র হাতে বিপদের ব্যারিকেড ভাঙতে উদ্যত জাহিদ অন্তরঙ্গ আড্ডায় একেবারেই পাল্টে যেত। বাসায় এলে আমার সংগ্রহ থেকে নিয়ে যেত দর্শন আর রাজনীতির বই। দেখতে চাইতো জ্যাক নিকলসন আর আল পাচিনোর সিনেমা। আমরা আড্ডা দিতাম বিশ^ রাজনীতি নিয়ে, অনর্গল কথা বলতাম চে গেভারা প্রসঙ্গে। জীবনকে বোঝার আর জটিল সমস্যার সমাধান টানতে অদ্ভুত কৌশল জাহিদের জানা ছিল। বাইরে থেকে যাকে মনে হতো একরোখা, মোটা দাগের এক মানুষ তার ভেতরে ভীষণ সংবেদনশীল এক মনের পরিচয় পেয়ে চমকে উঠতাম আমি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একটি মেয়েকে ভালোবাসতো জাহিদ।

ভালোবাসা ছিল বেশ অনেকটাই একপাক্ষিক। যতদূর মনে পড়ে, জাহিদের বিষয়ে মেয়েটির এক ধরনের ভয় মিশ্রিত প্রত্যাখ্যানও ছিল। একবার মেয়েটিকে ফুল পাঠিয়েছিল জাহিদ। সেই ফুলের তোড়া বহন করে নিয়ে গিয়েছিল প্রায় ৮ থেকে ১০ জন তরুণ। জাহিদ নিজেই তোড়াটা দেওয়ার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি সেদিন। ঘটনাটা মনে পড়লে আজো হাসি পায়।

একবার কথা বলতে বলতে জাহিদকে রাজি করিয়ে ফেলেছিলাম আমাকে একটা সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য। পত্রিকার রিপোর্টারদের যা হয়। সবসময় প্রবল কোনো খবর খুঁজে ফেরে মন। বিষয়টা ছিল ছাত্ররাজনীতির অন্দরমহলের বিশ^াসঘাতকতা আর তার নিজের উত্থানের গল্প। যে গল্প কেউ আগে শোনেনি কখনো। জাহিদ কথা দিয়েছিল এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমাকে সব বলে যাবে। হাসতে হাসতে বলত, ওই ইন্টারভিউ দিয়ে আমি নাকি বিখ্যাত হয়ে যাব। এরশাদ সরকারের পতনের পর একদিন আচমকাই অনেক অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে আটক হয় জাহিদ। আবার ছাড়াও পেয়ে যায় অদৃশ্য হাতের ইশারায়। জেল থেকে বের হয়ে আসার পর দেখা হয়েছিল বিশ^বিদ্যালয় এলাকায়ই। আমি কেন জানি তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। মনের মধ্যে জাহিদকে নিয়ে আশঙ্কা কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল বিপদে পড়তে যাচ্ছে সে। সেই অজানা আশঙ্কার কথা তাকে জানিয়েও ছিলাম। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়েছিল জাহিদ। কিন্তু আমার আশঙ্কা যে সত্যি হয়ে যাবে ভাবিনি কোনোদিন। এক সকালে বাড়ির ল্যান্ডফোনে ফোন এলো।

জাহিদের প্রাণহীন শরীরটা দেখতে ছুটে গিয়েছিলাম বিশ^বিদ্যালয়ে। কফিনে নিথর শুয়ে আছে গলা আর পেটে তিনটি গুলির দাগ নিয়ে। দাড়িতে কর্পূরের সাদা দানা লেগে আছে। চোখ একেবারে বন্ধ। বহু বছর পার হয়ে গেছে। অস্ত্র হাতে সেই অশান্ত মানুষটি হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। তবু তাকে মাঝে মাঝে খুঁজি আমি মানুষের ভিড়ের মধ্যে। পথে হঠাৎ সানগ্লাস পরা দাড়িওয়ালা কোনো যুবককে দেখলে চমকে তাকাই। সেই অদ্ভুত চরিত্রের বন্দুকবাজ যুবকটি আমাকে আজো পেছনের সেই পোড়া সময়ে টেনে নিয়ে যায়।

ইরাজ আহমেদ: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :