মানবতার করুণ দশা পৃথিবীতে আজ

হালিম আজাদ
 | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৮, ০৮:৫৬

জার্মানির বহুল পরিচিত ‘সুদ ডয়চে জাইটুং’ পত্রিকার ইতিহাসবিষয়ক পাতায় একটি সংবাদ প্রকাশ করে সম্প্রতি। ‘আত্মশুদ্ধি’ শীর্ষক এই সংবাদে বলা হয়, দুইশ বছর আগে ১৮২৪ সাল থেকে লাখ লাখ ইউরোপীয় নাগরিক অভাব-অনটনের কারণে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল জীবন বাঁচাতে। ১৮২৪ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ১০০ বছরে ৫ কোটি ২০ লাখ ইউরোপীয় নাগরিক আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল।

এই দেশত্যাগীদের ছিল নানা সংকট। খাদ্যের অভাব, নানা ধরনের নির্যাতন, বর্ণবাদী হামলা থেকে রক্ষা পেতে, জীবন রক্ষা করতে অনেকেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দেশ ছাড়েন। সংবাদের লেখক রনেন স্টাইন সেই সময়ে ফ্রাঙ্কফুটে বসবাসকারী পঁচিশ বছরের এলিজাবেথের একটি চিঠির অংশের উদ্ধৃতি দেন তার লেখায়। তার চিঠিতে আমেরিকা চলে যাওয়ার কারণ লিখে বলেছেন ‘ফ্রাঙ্কফুটে ১৯০১ সালে অব্যাহতভাবে রাজনৈতিক অনাচার, বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ এবং সেই বছর ৩০০ রাজনৈতিক হত্যাকা- ও হানাহানির পর জার্মান রাষ্ট্র বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বাঁচার জন্য আমার পরিবারের সবাই আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল।’ শুধু জার্মান নয়, সেইকালে পুরো ইউরোপ যুদ্ধ আর অভাবের ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছিল। মানুষ বাঁচবে কি মরবে এ চিন্তা রাষ্ট্রনায়করা ভাবার সুযোগ পাননি। তার নাগরিকরা কোথায় গিয়ে রক্ষা পাবে তাও তারা ভাবেনি। এর ফলে অভাব এবং মনুষ্যসৃষ্ট খুনের হাত থেকে রক্ষা পেতে সাগর পাড়ি দেওয়াই ছিল ইউরোপীয়দের জন্য নিরাপদ।

মানবতায় ঘাটতি দেখা দিলে তাকে মানবিক বিপর্যয় বলা হয়। কিন্তু কতটা নির্যাতনের শিকার হলে সেটা বিপর্যয় ছাড়িয়ে মানবতার ধস বলা যায় পৃথিবীর ইতিহাসে এর প্রমাণ রয়েছে অসংখ্য। অতিমাত্রায় কিংবা বর্বরোচিতভাবে মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু হলে সেটা তো নৃশংসতা। এই নৃশংসতা এখন বিশ্বজুড়ে চলছে। গত কয়েক বছর ধরে নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে পৃথিবীর অসংখ্য দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশত্যাগ করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ দেশত্যাগী হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ মানুষ ২০১৭ সালে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে সর্বোচ্চ ৬৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করেছে। দেশত্যাগী মানুষ নিরুপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশেই বেশির ভাগ আশ্রয় নিয়ে শরণার্থী হচ্ছে। শতকরা ৮৫ ভাগই পাশের দেশে প্রবেশ করে। কেউ ঢুকতে না দিলেও জীবন বাঁচাতে তারা ঢুকে যান।

পৃথিবীর গত কয়েকশ বছরের শরণার্থীদের ইতিহাসে এ তথ্যই রয়েছে। শরণার্থীরাও তো মানুষ। জীবনের সাথে জীবিকার কোনো দূরত্ব নেই। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ ভালো পরিবেশ চান। এ কারণে আফ্রিকা, আরব, এশিয়ার শরণার্থীদের বেশ সংখ্যক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে। শুধু আটলান্টিক নয়, অসংখ্য সাগর পাড়ি দিয়েও লাখ লাখ শরণার্থী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করছে। কিন্তু বর্তমান ইউরোপের প্রায় সব দেশই শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না। সভ্য, সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জার্মানি। এই দেশের চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের উদার নীতির কারণে ২০১৬ সালে ১২ লাখ শরণার্থী জার্মানি প্রবেশ করেছিল। সে সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশ ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ অন্যান্য দেশও অনেক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। তারপরও বিশ্বের এ পর্যন্ত শরণার্থীদের ৫ ভাগও ইউরোপে ঢুকতে পারেনি। ভূমধ্যসাগরে লাখ লাখ শরণার্থীর ঠিকানা খোঁজা এবং আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষের ভেসে বেড়ানোর ঘটনা বেশিদিনের আগে নয়। সাম্প্রতিককালের এই মর্মন্তুদ ঘটনায় কত মানুষ সাগরে ডুবে মারা গেছে তার সংখ্যাটা আজও প্রকাশ পায়নি। ইতালি দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে বার হাজার মানুষ ভিড় করেছিল। তার একভাগও ইতালিতে প্রবেশ করতে পারেনি। সাগর থেকে কোনোক্রমে বেঁচে গিয়ে যারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে বিক্ষোভ করেছে, এই দৃশ্য তো বছরব্যাপী বিশ্বের সব মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

বাংলাদেশে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা গত এক বছরে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের যে বর্বরোচিতভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছে, পৃথিবীর শরণার্থীদের ইতিহাসে এত নির্মম ঘটনা আর কোথাও ঘটেনি। বাংলাদেশ মানবতার ইতিহাসে রোহিঙ্গাদের প্রতি যে সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছে এবং হচ্ছে। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত যে উদার মানসিকতায় এক কোটি বাঙালিকে আশ্রয় দিয়েছিল, তা তো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের মাঝে এই উদারতার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন বিপুলভাবে। কিন্তু রোহিঙ্গারা মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়ে ভারতে প্রবেশ করতে গেলে সে দেশের সীমান্ত রক্ষীরা বাধা দেয়। ফলে কোনো রোহিঙ্গা ভারতে ঢুকতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীর ভারত বর্তমান ভারত যে নেই, এই ঘটনায় তা বের হয়ে এলো। অথচ আমরা বলি বিশ্বের সবচেয়ে শীর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত।

আজকের ইউরোপ ক্রমেই শরণার্থীদের প্রতি জিঘাংসা রূপ নিচ্ছে। বৈভব ও বিত্তের খোলসে ইউরোপ তাদের অতীত ইতিহাসকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। তারা শত বছর আগে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল। এই সংখ্যাটা ছিল প্রায় আট কোটি। শুধুমাত্র জার্মানিরই ছিল সাড়ে পাঁচ কোটি। সেই বোধ কাজ করেছে অ্যাঙ্গেলার মস্তিষ্কে। এ কারণেই তিনি বার লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু এখনকার অ্যাঙ্গেলা তো বড় কঠোর হয়ে উঠেছেন। ইউরোপের একাধিক রক্ষণশীল দেশের নেতাদের চাপে অ্যাঙ্গেলা তার নীতি বদল করছেন। সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, গত জুনে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় নেতাদের বৈঠকে শরণার্থী বিষয়ে যে দুটি সিদ্ধান্ত হয়, তাতে শরণার্থী ঠেকানোই এর উদ্দেশ্য। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এখন থেকে যেন ইউরোপের সীমান্ত দিয়ে কোনো শরণার্থী প্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যাপারে সব দেশ কঠোর অবস্থান নেবে।

আফ্রিকার শরণার্থীদের সহায়তা দিতে মহাদেশটির কোনো দেশেই শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হবে। ভূমধ্যসাগর দিয়ে যে সব শরণার্থী ঢুকতে চাইবে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ করা হবে এবং বাকিদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। কিছু দিন আগে সাগরে ভাসমান পৌনে পাঁচশ শরণার্থী ইতালিতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তাদের বহনকারী ট্রলার সাগর পারে নোঙ্গর করতে দেওয়া হয়নি। কয়েক দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ট্রলারটি। সবাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে ভূমধ্যসাগরে টহলরত ইতালির নৌ-সেনারা এই সব মানুষকে একটি বড় জাহাজে তুলে নেয়। তাদের ভাগ্যে কি জুটেছে সেই তথ্য এখনো সংবাদে পরিবেশন হয়নি।

উত্তর জার্মানির উত্তর সাগরের সমুদ্রবন্দর হচ্ছে ‘ব্রামাহাফেনে’। এখানে একটি দেশান্তরি জাদুঘর রয়েছে। এই জাদুঘরের নাম হচ্ছে ‘দেশান্তরি জাদুঘর’। এই জাদুঘরে রয়েছে ইউরোপীয় দেশত্যাগীদের মর্মন্তুদ কাহিনি, আটলান্টিকের ওপারে তাদের জীবন গড়ার কাহিনি, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ। এই জাদুঘরে প্রবেশ পথে লেখা রয়েছে ‘এই পথ দিয়েই ৭০ লাখ জার্মান ও মধ্য ইউরোপীয় অভিবাসী অজানা পৃথিবীর দিকে পাড়ি দিয়েছিল। জানা যায়, এই পথ দিয়েই আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদা ফ্রিডরিশ ট্রাম্প ভাগ্যের অন্বেষণে মাত্র ১৬ বছর বয়সে দক্ষিণ জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালৎস রাজ্য ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিলেন।

হালিম আজাদ: কবি, কথাশিল্পী ও সিনিয়র সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :