পাকিস্তান: ব্যালট ও বুলেটের লড়াইয়ে বিপন্ন গণতন্ত্র

হাসান জাবির
 | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৮, ০৯:০৬

সদ্য সমাপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে প্রধান আলোচিত ইস্যু ছিল সেনাবাহিনী ও পাঞ্জাব। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ওস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান ও সুরিন্দর করের জন্মস্থান পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই ‘পাঞ্জাব’ প্রদেশ। দেশটির সর্বমোট সংসদীয় আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ১৪১টি আসন আছে পাঞ্জাবে। পাকিস্তান মুসলিম লীগের (এন) দুর্গ হিসেবে খ্যাত এই পাঞ্জাব প্রদেশকে ভেঙে আলাদা ‘দক্ষিণ পাঞ্জাব’ প্রদেশ গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল চলতি নির্বাচনের অন্তরালের কুশীলবরা। সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত না হলেও পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনে অন্তরালের কুশীলবদের অন্যান্য ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২৬ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত প্রাপ্ত নির্বাচনি ফলাফলে গত কয়েক মাসের আশঙ্কারই প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় কয়েক মাস আগে। উল্লেখ্য, দেশটির ৭০ বছরের ইতিহাসে পরপর দ্বিতীয় বারের মতো রাজনৈতিক সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জেতা পাকিস্তান পিপলস পার্টি ২০১৩ সালে প্রথম এবং ওই বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জয়লাভ করে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) চলতি বছর নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করার নজির স্থাপন করে। যদিও সর্বশেষ মুসলিম লীগ সরকারের মেয়াদপূর্তি নির্বিঘ্ন ছিল না। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পদচ্যুত হন। পরবর্তীতে নওয়াজবিহীন মুসলিগ লীগ সরকার পরিচালনা করলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে। বলা চলে একটানা দশ বছর নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক দেশ পরিচালনার ব্যাপারটি ভালোভাবে নেয়নি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি সামরিক বাহিনী। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বরাত দিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, ‘সর্বশেষ নির্বাচন ঘিরে সামরিক নেতৃত্ব নিজেদের চাহিদামাফিক ফলাফল আনতে নানা কৌশল অবলম্বন করে।’ এক্ষেত্রে সেনা বিরাগের শিকার পাকিস্তান মুসলিম লীগপ্রধান ও তার পরিবার। এছাড়াও দলটির শীর্ষ নেতাদের ওপর নানা ধরনের দমন-পীড়নের খবর সবারই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে। মূলত ‘পানামা পেপার্স’ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত তিনবারের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্তেফাক গ্রুপের কর্ণধার বড় মিয়াখ্যাত নওয়াজ শরিফ ও তার মেয়ে মরিয়মের তড়িঘড়ি বিচার প্রক্রিয়া এখানে প্রণিধানযোগ্য। একই সঙ্গে মুসলিম লীগসহ অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপকভাবে আইনি জটিলতার সম্মুখীন হন। শুধুমাত্র মুসলিম লীগেরই প্রায় সতের হাজার কর্মী রাজনৈতিক হেনস্তার শিকার হয়েছে। এ ধরনের নানা ঘটনার মধ্যে দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা পাকিস্তান তেহরিক-ই- ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খানের প্রতি সেনা আনুকূল্যের বিষয়টিও প্রায় পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ ঘোষিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে- ইমরানের দল নিশ্চিত জয়ের পথে আছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) দ্বিতীয় ও তরুণ রাজনীতিক ভুট্টো পরিবারের সন্তান বিলওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বে থাকা পাকিস্তান পিপলস পার্টি আছে তৃতীয় অবস্থানে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন কিছু আসনে। ৩৪২ আসনের পাকিস্তান পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ ‘ন্যাশনাল এসেম্বলীর’ ২৭২টি আসন জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকে। অবশিষ্ট ৭০ আসনের মধ্যে ৬০টি আসন নারী ও ১০টি আসন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত। সর্বশেষ নির্বাচনে দেশটির সর্বমোট ১০ কোটি ৬০ লাখ ভোটারের মধ্যে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচনি নিরাপত্তা বিধানে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রায় আট লক্ষাধিক নিরাপত্তা রক্ষী। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ সেনাবাহিনীর সদস্য। মোট ৮৫ হাজার ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫ হাজার কেন্দ্রকেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল দেশটির নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন নির্বিঘœ করতে ঝুঁকিপূর্ণ পাক আফগান ‘চামান’ সীমান্ত দুদিনের জন্য সীল করে দেয়া হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও নির্বাচনের দিন সন্ত্রাসী হামলায় প্রকম্পিত হয়েছে কোয়েটা। এই জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় একত্রিশটি প্রাণ। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত উত্তাপের রেশ ধরে চরম অস্থিতিশীল দেশটির ভবিষ্যৎ আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকেই ধাবিত হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

ইতিমধ্যে ইমরান খানের পিটিআই ছাড়া পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই নির্বাচনি ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে পিএমএল (এন)সহ অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল । বর্তমানে কারা অন্তরীণ নওয়াজ শরিফের অনুপস্থিতিতে দলটির অন্তর্র্বর্তী প্রধান তার ভাই শাহবাজ শরিফ জন রায় ছিনতাই হওয়ার অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে তিনি কাছে টানার চেষ্টা করছেন। যদিও অনেকটাই ফুরফুরে মেজাজে আছেন পিটিআইপ্রধান ইমরান খান ও তার সমর্থকরা। নির্বাচন-উত্তর সমীকরণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যকার ধারাবাহিক দ্বন্দ্ব আরও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকা দেশটিকে আরও একঘরে করে তুলবে। পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে প্রায় ৩৫ বছরই সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে দেশটি। এর প্রতিক্রিয়ায় পরমাণু শক্তিধর দেশটির জাতীয় অগ্রগতি কখনই সঠিক পথে ছিল না। ৯০০ হাজার ২০০ কোটি ডলার আন্তর্জাতিক ঋণের চাপে দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতি এমনিতেই ভয়াবহ। আছে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা। এর মধ্যে সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের এই দ্বন্দ্ব দেশটিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে। গত দশ বছরে দেশটির ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার এই গতিশীলতা দেখে কিছুটা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনে সেনা হস্তক্ষেপের আলামত দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে চরমভাবে বিপন্ন করবে নিঃসন্দেহ। এই ঘটনার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া দেশটির প্রত্যাশিত অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

ভারত, আমেরিকা, আফগানিস্তান, ইরানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের টানাপড়েন সামলে নেয়া নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইমরান খান কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অন্যদিকে ইমরান নিজেও বিভিন্ন ইস্যুতে একেক সময় একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন। কখনো আমেরিকার আবার কখনো চীনের বিরোধিতা করে তিনি কার্যত কিভাবে দেশ চালাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। অন্যদিকে ইমরানের দলের জোটসঙ্গী হিসেবে আছে বেশ কিছু চরমপন্থি দল, যা দেশটিতে নতুন করে চরমপন্থার উত্থান ঘটাতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে একই সঙ্গে আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা। পাশাপাশি ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন জটিল চ্যালেঞ্জ।

ইমরান খান নতুন প্রজন্মের ভোট পেয়েছেন বেশি। নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি দশ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কিভাবে এসব সম্ভব করবেন।

দুনিয়াজুড়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার পাকিস্তান। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষ পাকিস্তানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে। এর প্রধান কারণ দেশটির সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যকার ধারাবাহিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করে একটি বিকাশমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করলো সেনারা। যার মূল্য দিতে হবে দেশটির জনগণকে।

হাসান জাবির: বিশ্লেষক; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :