‘আর নিতে পারছি না, মানুষ তো!’

মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন
 | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১৮:৩৭

কিছুদিন আগে টঙ্গীতে আমার এক বন্ধুর নতুন টয়োটা গাড়িটি থেতলে দেয় একটি অদম্য বাস। ড্রাইভারসহ বাসটি আটকের পর জানা যায়, মালিকের অজান্তে গাড়িটি রাস্তায় চলছিল। বাসটি নাকি সেদিন গ্যারেজে থাকার কথা ছিল। যাহোক, দিন শেষে জরিমানার টাকাটা সেদিন মালিককেই গুণতে হয়েছিল।

এদেশের ৯০% গাড়ি বেতনভুক্ত ড্রাইভার দিয়ে চলানো হয়। ফলে প্রতিটি ড্রাইভার 'গাড়ির সাইজ' কিংবা মালিকের 'ক্ষমতার পরিধি' বিবেচনা করে গাড়ি চালায়। এসব কারণেই রাস্তায় ট্রাক-বাস কিংবা দামি মডেলের গাড়ি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাউকে সাইড দিতে চায় না, যেন সাইড দিলেই গাড়ি কিংবা মালিকের ইজ্জত শেষ। অবশ্য বাসের ক্ষেত্রে পরের স্টপেজের যাত্রীগুলো হারানোর ভয়ও থাকে। আর এই হারানোর ভয়ের সাথে রয়েছে তাদের উপরি ইনকামের সম্পর্ক।

ঢাকা শহরের কোনো একটি বাসের জিওগ্রাফি (বডি) দেখলেই বোঝা যায় ড্রাইভার কতটা যত্ন নিয়ে গাড়ি চালায়! বডির ছাল (রং) তো উঠে গেছেই সেই সাথে বড় বড় টর্নেডোতে আক্রান্ত হবার আলামতও পাওয়া যায়। কোথাও ট্যাব খাওয়া, কোথাও ভাঙ্গা, কোথাও বডি খুলে গেছে আবার কোথাও বা বডির অংশ বিশেষ উড়ে গেছে। এর প্রধান কারণ ড্রাইভারদের নির্লজ্জতা, অসভ্যতা এবং দানবীয় মানসিকতা।

রাস্তা দিয়ে চলার সময় পাশাপাশি দু'টি বাস যখন প্রচণ্ড ভালোবাসা আর আবেগ নিয়ে আলিঙ্গন করতে করতে পরের স্টপেজের যাত্রীদের সেবা দিতে এগিয়ে যায় তখন তাদের জিওগ্রাফির এই পরিবর্তন ঘটে। আদতে তাদের এই প্রকাশ্য ভালোবাসার আলিঙ্গন খুবই অশ্লীল, বন্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা তাদের এই বেপরোয়া প্রেমের বলিদান দিতে হয় অনেককে।

পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে বাসের সাথে বাসের এই অসভ্য প্রেমালিঙ্গন আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তাদের এই অশ্লীল প্রেমের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর জন্য শহর এলাকায় তাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি লেন বরাদ্দ থাকে। ট্রেনের মতো তাদেরও কোনো ওভারটেক সিস্টেম নেই। সেই সাথে প্রতিটি স্কুল এলাকার শুরু এবং শেষ পর্যন্ত সর্বনিম্ন গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এমনকি হাসপাতাল এলাকার মতো হর্ন (বেপু) বাজানোও সেখানে নিষিদ্ধ। আর, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা গাড়ি থেকে নামার সময় কিংবা রাস্তা পাড় হবার সময় সমস্ত গাড়ি থেমে যায়। এটাই নিয়ম, এটাই সভ্যতা।

অচেনা ড্রাইভারের জন্য 'স্কুল এলাকা শুরু' এবং 'স্কুল এলাকা শেষ' সাইন বড় করে লাগিয়ে দেয়া হয়। আর, আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের অবস্থান জানার পরও ড্রাইভাররা তাদের স্টাইলের কোনো পরিবর্তন করে না। লক্কর ঝক্কর বাসের ড্রাইভাররাও এই জ্যামের শহরে 'ফাস্ট অ্যান্ড দ্যা ফিউরিয়াস' খেলতে চায়।

যাহোক, কিছুটা সুশৃঙ্খলতা না আনলেই নয়, যেমন-

(১) বাসের জন্য ১টি মাত্র লেন বরাদ্দ করা। লেন-এ লেখা থাকবে 'বাস লেন'।

(২) প্রতিটি রুটে বাস কোম্পানির সংখ্যা সীমিত করা। ফলে ওভার টেকিং দরকার হবে না।

(৩) ট্রাফিক রুলস অমান্য করলে ড্রাইভিং লাইসেন্সে পয়েন্ট কাটার সিস্টেম করা। সব পয়েন্ট শেষ হলে তিন বছরের জন্য ড্রাইভিং-এর জন্য অযোগ্য ঘোষণার ব্যবস্থা থাকা

(৪) 'জীবনের বিনিময়ে' শুধুই 'ক্ষতিপূরণ' নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ সৃষ্টি করা

(৫) স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি এলাকার অধিক পরিমাণ স্পিড ব্রেকার স্থাপন করা এবং ব্যাপক পরিমাণ 'হলুদ' রং-এর ট্রাফিক সাইন ব্যবহার করা

স্কুল-কলেজগামী নিজেদের সন্তানের 'বাসে চাকায় থেতলে যাওয়া' চেহারাটা না দেখতে একটা কিছু করুন। আর নিতে পারছি না! মানুষ তো! বাবা তো!

লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট স্পেশাল অ্যাকশন ডিভিশন, কাউন্টার টেরোরিজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ডিএমপি, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :