শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শেষ কোথায়?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৮, ২২:১১ | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০১৮, ২১:৫৭

মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। চোখের সামনে সহপাঠীর মৃত্যু যেমন শিক্ষার্থীদের কাছে অবিশ্বাস্য ছিল, এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু-পরবর্তী আন্দোলনও নানা কারণে এবং বৈশিষ্টে অবিশ্বাস্য।

স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসছে, বাসের চালকদের লাইসেন্স চেক করছে, লাইসেন্স থাকলে চকলেট দিচ্ছে, না থাকলে আটক করে পুলিশে দিয়ে দিচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকছে সড়ক, মহাসড়ক। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে না!

মন্ত্রীরা দেরিতে হলেও সক্রিয় হয়ে নানা আশ্বাস দিচ্ছেন, কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাঁদের বিশ্বাস করতে পারছে না। রাজনীতিবিদদের মানুষ বিশ্বাস করে না, এটা আমরা বুঝি, কিন্তু যাঁদের বোঝা উচিত সবার আগে সেই রাজনীতিবিদরা বুঝেও না বোঝার, দেখেও না দেখার ভান করেন।

তারা এমনভাবে চলাফেরা করেন, এমন ভাবে কথা বলেন, যেন দেশে কোনো সমস্যাই নাই। আর সরকারের ভেতরে থেকে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটান, সেই দুষ্টচক্রকে কেউ কিছু করতে পারে না।

এখন প্রশ্ন হল, কী করলে পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্লাস বা ঘরে ফিরে যাবে? কলেজ শিক্ষার্থীরা যে কোন মন্ত্রী বাহাদুরের আশ্বাসে ক্লাসে ফিরে যাবে না, সেটি এখন পরিষ্কার। পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল সরকার দুর্ঘটনার পরের দিন, কিন্তু পারেনি। বরং আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। একটা ‘শেষ’ না দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে ফিরে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে, ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েকজনকে আহত করে বেশ সমালোচিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ বোধহয় নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে।

নিজেদের সন্তানদের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে লজ্জার যে কিছু নেই, সেটি পুলিশ বুঝতে পেরেছে। অথচ পুলিশ কিন্তু এই সড়ক পরিবহন নৈরাজ্যের জন্য একা দায়ী নয়? একটা দুষ্টচক্র দেশের সড়ক পরিবহনের নৈরাজ্যের জন্য দায়ী। এই দুষ্টচক্রের সাথে পুলিশের, আমলাদের একাংশের নিবিড় সম্পর্ক। পুলিশ এবং বিআরটিএ’র চোখের সামনেই লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে, ফিটনেসবিহীন বাসগুলো চলাচল করছে। পুলিশ একশন নিলেও রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

মালিকদের অতি মুনাফালোভও সড়ক পরিবহন নৈরাজ্যের জন্য দায়ী। বাসের চালক, সহকারীদের কাজের নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নেই। বেতন-ভাতাও নির্দিষ্ট নয়। টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়। টার্গেট এ পৌঁছুতে গরিব চালকদের পাগলের মত ছুটে বেড়াতে হয় সড়কে। যাত্রী ধরার জন্য প্রতিযোগিতা চলে চালকদের মধ্যে। দশ টাকা বাড়তি আয়ের জন্য মানুষ ফেলছে চালকরা।

পুলিশও অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা পেয়ে অপরাধী যান বা চালকের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয় না। অল্পবয়সী, অদক্ষ চালকদের লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। কোনো পরিবর্তন নেই।

প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক চেষ্টা করেছিলেন কিছু পরিবর্তন আনার। কাজের চাপে মানুষটা মারাই গেলেন। আজ আনিসুল হক থাকলে বাচ্চারা হয়ত তাঁর কথায় ভরসা করে আন্দোলন বন্ধ করতে পারত। আনিসুল হক রাজনীতিবিদ না হয়েও প্রকৃত রাজনীতিবিদের ভূমিকা পালন করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। আফসোস, আজ আনিসুল হকদের বড় অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আনিসুল হক নগরীর জন্য কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে কয়েক হাজার আধুনিক বাস ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা আজও বাস্তবায়িত হল না। অন্যদিকে মেট্রো রেলের অগ্রগতি খুব ধীরগতির। ঠিকাদার আর প্রকৌশলীদের যোগসাজশে রাজধানীর প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রলম্বিত হচ্ছে। মানুষের কষ্টের যেন সীমা নেই।

তবু মানুষ ধৈর্য ধরে ছিল। এক ভয়ংকর হাসি দিয়ে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছেন এক মন্ত্রী। মন্ত্রী নৌপরিবহন এর হলেও, সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের নেতা হিসেবে শাজাহান খানের প্রাসঙ্গিকতা বেশ। সাংবাদিকরা বাচ্চাদের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি হাসি মুখে ভারতের দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। মানুষের কষ্ট ক্ষোভে পরিণত হয়। মানুষ অবাক হয়ে যায়, সন্তানের মৃত্যুর খবরে একজন মন্ত্রী কীভাবে এভাবে হাসতে পারেন! পরে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ বলেছেন শাজাহান খান, কিন্তু এতে শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না।

দুর্ঘটনা ঘটানো বাসের চালক আর সহকারীদের গ্রেপ্তারের পরও আন্দোলন থামছে না। শিক্ষার্থীরা যে কয়েক দফা দাবি দিয়েছে, সেখানে শাজাহান খানের পদত্যাগও আছে।

বাস্তবতা হল, আন্দোলন আপনা-আপনি থেমে যাবে, এমন কোন লক্ষণ নেই। সরকার অবশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে শেষ রক্ষা হবে কি না, এখনি বলা যাচ্ছে না।

তবে সমস্যার আশু সমাধান খুব দরকার। এসব আন্দোলনের ফাঁকে সরকার ফেলে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর। জামায়াত-বিএনপি চক্র খুব অপপ্রচার করছে। কখনো আর্মিকে জড়ানোর চেষ্টা করছে, কখনো প্রধানমন্ত্রীর নামে ভুয়া সংবাদ ছেড়ে দিচ্ছে। এভাবেই জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিবিদ, স্বার্থপর আমলা আর সরকারবিরোধী অশুভ শক্তির তৎপরতায় বিপদ তৈরি হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :