বদলের ডাক এসেছে, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করুন

আফরোজা সোমা
 | প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০১৮, ১৫:১০

ক.

মুসা ও এক মেষপালকের গল্প

মুসা নবী যেতে পথে একবার দেখলেন এক মেষ পালক আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছে। এই দৃশ্য তার বড় ভালো লাগলো। তাই প্রার্থনার কথাগুলো শোনার জন্য উনি আরো নিকটে গিয়ে নিবিড়ভাবে কান পাতলেন।

কিন্তু কান পেতে যা শুনলেন তাতে মুসা রীতিমতন ক্ষুব্ধ। তিনি শুনলেন যে, সেই আনপড় রাখাল পরমপ্রভুর প্রেমে এতই মশগুল যে সে তার সব পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত। প্রভুর পা সে পরম যত্নে ধুইয়ে দিতে পারে প্রতিবার। এমনকি তার ভেড়ার পাল থেকে সবচেয়ে তাগড়া মেষটিকে জবাই করে রেঁধে দিতে পারে দারুণ বিরিয়ানি। তবু, যেন প্রভু কবুল করেন এই রাখালের প্রেম।

রাখালের এই আজব প্রার্থনা শুনে মুসা ক্ষেপে গিয়ে বেশ তিরস্কার করলেন। এটা যে মোটেও প্রার্থনা নয় সেই কথা জানালেন। আর কীভাবে প্রার্থনা করতে হয় সেটিও শিখিয়ে দিয়ে এলেন আনপড় রাখালকে।

কিন্তু মুসার এই পণ্ডিতিকে প্রভু ভালো ভাবে নিলেন না। তিনি বললেন, তুমি করেছ কি হে মুসা! একটি সহৃদয় দিলের প্রার্থনার নিবিষ্ট ভাষাকে তুমি বন্ধ করে দিলে!

মুসা একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে প্রভুর কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। প্রভু জানালেন, এই মেষপালক তার খুবই প্রিয়। কেননা, কোন ভাষায় সে প্রার্থনা করছে সেটি বড় নয়। সে যে পরম ভক্তি আর তুলনাতীত গভীর প্রেম নিয়ে ডাকে সেই ডাকটাই মুখ্য। নিবেদনটাই মুখ্য। ভাষার রকমফেরটা নয়।

খ.

‘পড়ো আমার হৃদয়’

হে নীতিনির্ধারকগণ, স্কুল, কলেজের যে শিশু-কিশোররা আন্দোলনে নেমেছে আপনারা পড়ুন তাদের হৃদয়।

তারা কী চায়? খতিয়ে দেখুন তাদের সেই চাওয়া। তারা লাইসেন্স পরীক্ষা করছে কেন, এইসব করে আদৌ সুরাহার সমাধান হবে কি না, তারা স্লোগানে চ-বর্গীয় শব্দাবলী লিখেছে কেন—এতে করে ‘ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল’ বলে যারা ভাবছেন তারা দয়া করে একটুখানি দম নিন।

আসুন, খতিয়ে দেখি এই যুবাদের হৃদয়। কী তাদের প্রত্যাশা? আনপড়, অধৈর্য ভাষার আড়ালে কী তাদের নিবেদন?

এই আন্দোলনকে আমার মতন করে খতিয়ে দেখে এই কয়েকটা বিষয় পেয়েছি। গেগুলো আপনার সাথে মিলে কিনা দেখতে পারেন।

-তারা মূলত চায় একটি নিয়মতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

-তারা চায় সড়কে শৃঙ্খলা।

-তারা চায় দুর্নীতির ফাঁক গলে রাস্তায় তৈরি হবে না মরণ-ফাঁদ।

-তারা চায়, কোনো ঘটনা বা অঘটন যদি ঘটেই যায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে।

-তারা চায় চালকেরা হবে সংবেদনশীল। প্রতিটি জীবনকে তারা অমূল্য হিসেবে ভাবতে শিখবে। দুই টাকা পাওয়ার আশায় কারও বুকের উপর উঠিয়ে দিবে না চাকা।

ব্যাস এইটুকুই চাওয়া তাদের।

কিন্তু এই চাওয়াকে বোঝাতে গিয়ে তারা ফিটনেসের কথা বলছে, লাইসেন্সের কথা বলছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের কথা বলছে, আইনের কথা বলছে।

তারা তরুণ। তাদের আছে জগতকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দেয়ার অদম্য, বেহিসেবী সাহস। তাই, নুয়ে পড়া ভাষায় কথা বলার সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙৃল দেখিয়ে তারা রাগের ভাষায়, সব কিছু ভেঙে দেয়ার ভাষায় কথা বলছে। হতে পারে, এই ভাষাকে কারও কাছে মনে হতে পারে অশালীন।

কিন্তু হে মান্যবর, আপনি জানবেন যে, কারো প্রশংসা বা কারো তিরস্কারে কোনো প্রকৃত আন্দোলনের কিছু এসে যায় না। আন্দোলন চলতে থাকে তার নিজের ভাষায়, নিজের গতিতে। তাই, এই মুহূর্তে নীতি শিক্ষা দেয়ার বোগদামী চেষ্টা না করে আসুন আমরা পাঠ করি এদের হৃদয়। আর ক্ষমা চাই তাদের কাছে।

গ.

ক্ষমা করো হে সন্তানেরা, সব লজ্জা আমাদের

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে আর কিছু দিনের মধ্যেই। অথচ এই দীর্ঘ কয়েক যুগেও আমরা এই দেশে আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। জনজীবনে ফিরিয়ে আনতে পারিনি শৃঙ্খলা। নারীর জন্য নিরাপদ করতে পারিনি দেশ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বন্ধ করতে পারিনি নৈরাজ্য। দেশে অবস্থা এখন এমন যে, ঠগ বাছতে গা উজাড়।

এই সর্বৈব নৈরাজ্য, হতাশা ও বিশৃঙ্খলার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা, বুড়া ভামেরা। মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় প্রজন্মের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যাবস্থা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই আজ তাদেরকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। তাই, তাদেরকে আপনার নৈতিকতার নিক্তি দিয়ে মাপামাপি করা বন্ধ করুন। আর কবুল করুন আমাদের সমন্বিত ব্যার্থতা।

তবেই, হয়তো হতে পারে বদলের শুরু।

ঘ.

দোহাই লাগে, আর নয় শুভঙ্করের ফাঁকি

রাস্তায় নামা শিশু-কিশোররা সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করতে চায়। এইখাতের আগাপাশতলা পাল্টাতে চায়।

শুধু আইনের নামে ধুয়া তুলে নতুন দিনের সূচনা হবে না। আইনের বাস্তবায়ন জরুরি।

বাস, ট্রাক ও পিকাপ ভ্যানের বহু চালক কিশোর বা অপ্রাপ্তবয়স্ক। কেন তারা এই বয়সে এই পেশায় আসে?

কারণ তাদের পরিবারে দৈন্যদশা আছে। এখন হুট করে আপনি এই চালকদের ভাগিয়ে দিতে পারেন না। বরং একটি বিধিমালা তৈরি করুন।

ধরা যাক তাতে বলা থাকবে, ষোলোর নিচে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে না। এবং এই নিয়মকে কঠোরভাবে মানতে বাধ্য করুন। পাঁচশ টাকা বা পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ খেয়ে যে ব্যক্তি এই বয়সের কম কাউকে লাইসেন্স দেবে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অন্যদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিন। যেনো আর কেউ এইরকম অনিয়ম করার সাহস না করে।

যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালায় সেইসব চালকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন। সেই প্রশিক্ষণে গাড়ি চালনাগত দক্ষতার দিকটিকে বাড়ানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করুন। পাশপাশি, চালকেরাও যে মানুষ, তাদের যে সংবেদনশীল স্বত্ত্বা আছে সেটির উপর জোর দিন।

সংবেদনশীলতাকে জাগিয়ে তোলার বিষয়টিও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বা লাইসেন্সবিহীন গাড়ি গিয়ে নিজে-নিজে মানুষের উপরে উঠে যায় না। গাড়ি যিনি চালান তার মানসিকতা এই ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই, গাড়ির ফিটনেস গাড়ির কাগজপত্র, লাইসেন্স ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা আদতে কোনো কাজেই আসবে না যদি চালকের এটিচিউড না পাল্টায়।

আর চালকের এটিচিউটও ততক্ষণ পাল্টাবে না যতক্ষণ না আপনি তাকে দিচ্ছেন একটা মানুষের জীবন। সারাদিন ধরে গাড়ি চালানো, টাকা কামানোর প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বন্ধ করুন। তাদের জন্য একটা সময়, একটা বেতন, ছুটি, বোনাস ইত্যাদি নির্ধারণ করুন।

সড়ক পরিবহনখাতে যে বিপুল দুর্নীতি, ঘুষ-বাণিজ্য সেগুলো বন্ধ করুন। ইত্যাদি বন্ধ হলে আপসে-আপ একটা নিয়ম প্রতিষ্ঠা হবে।

এত সব বদল একদিনে হবে না।

কিন্তু বদলের শুরুটা হতে পারে। যদি আন্তরিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসা যায় তাহলে না হবার কোনো কারণই নেই।

যেই শিশু-কিশোররা পথে নেমেছে তারা পথ দেখিয়েছে। তাদের হৃদয়কে আপনাদের ঘষেটিপনা দিয়ে, কূটচাল দিয়ে, আইনের মূলা দেখিয়ে শুভঙ্করের একটা ফাঁকির মধ্যে ফেলে দেবেন না।

স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল। অথচ আজও এই দেশে পিষে ফেলার সংস্কৃতিই বিদ্যমান। ঘরে, সড়কে, বিদ্যমান সিস্টেমে পিষে ফেলাই চলমান। গরীবের জন্য, হিন্দু-মুসলমান সকলের জন্য এই দেশ আজো সমান হয়নি। আজো পেষণ চলছেই। দুর্নীতির নিচে, পেশিশক্তির নিচে, চাকার নিচে পিষে মরাই বেশির ভাগেই নিয়তি এই দেশে।

তাই বলছি, বদলের ডাক এসেছে। শুনুন। হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করুন।

এইবার আর শুভঙ্করের ফাঁকি দেবেন না। যদি দেন তবে, মনে রাখবেন, কেউ কাউকে ফাঁকি দিতে পারে না। যে ফাঁকি আজ আপনি রচনা করবেন, সেই ফাঁকিতে একদিন আপনিও পড়বেন। কেননা ফাঁকিই যেখানে সিস্টেম সেখানে সিস্টেমের বাইরে্ আপনি যাবেন কী করে?

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :