বাড়ি নয়, এক টুকরো ইতিহাস

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ০৮:১৫

রাফি, আদনান ও ইমতিয়াজ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মঙ্গলবার সকাল সকাল ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় আদনান তার বন্ধুদের বাংলাদেশ সৃষ্টির সূতিকাগার বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িটি দেখবে বলে প্রস্তাব করে। রাফি ও ইমতিয়াজ প্রিয় বন্ধু আদনানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

একটি বাড়ি ঘিরে যে কত ইতিহাস তা তাদের জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কথা তারা বই পড়ে ও লোকমুখে জেনেছে। কিন্তু জাতির জনকের বাড়ির এই জাদুঘর ঘুরতে এসে যেন নতুন এক ইতিহাস চোখের সামনে ধরা দিল। কিন্তু এত আটপৌরে সাধারণ আসবাবপত্র, কাপড়চোপড় দেখে তিন বন্ধু খুব অবাক।

রাফি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এক অসাধারণ মানুষ হয়েও যে সাধারণ মানুষ ছিলেন সেটা এখানে না এলে বুঝতাম না। সত্যি খুব খারাপ লাগছে আরও আগে কেন এলাম না! এখানে এসে যেটা বুঝলাম একবার হলেও সবার এই বাড়িতে পা রাখা উচিত।’

‘কারণ এখানে শুধু একটি পরিবারের স্মৃতিচিহ্ন নয়, রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের ছবি। যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।’

কথা বলতে বলতে তারা ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল। জাদুঘরের দেয়ালে বুলেটের চিহ্ন, বঙ্গবন্ধু গুলি খেয়ে যে সিঁড়িতে পড়েছিলেন সেটা দেখে ইমতিয়াজ বলছিলেন, ‘ইস্ কীভাবে পারল ওরা! যে মানুষটা আমাদের এতকিছু দিয়েছে তাকে আমরা মেরে ফেললাম!’

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাঙালির ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এছাড়াও আছে বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস, আছে হারানোর বেদনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল বিশ্বাসঘাতক খুনির হাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিকে ঘোষণা করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে।

ছায়া সুনিবিড়, সবুজ গাছে ঘেরা সাদা রঙের তিনতলা মূল বাড়ি এবং এর পাশের সম্প্রসারিত আরেকটি ভবন নিয়েই জাদুঘর। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘরটি। আছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এখানে আসতে হবে।

তিন তলা বাড়িতে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বলা যায়, এক তলার প্রথম কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তোলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এই ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এই তলায় আরও আছে পরিবারের নিহত অন্য সদস্যদের তৈলচিত্র। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়েছিল। আর এ ঘরের সামনে করিডোর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু।

এখনও গুলির স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। সিঁড়িটি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী পাইপ, তামাকের কৌটা।

এই কক্ষে আরও আছে টেলিফোন সেট, রেডিও। কিছু রক্তমাখা পোশাক। সামনের খাবার ঘরের পাশেই আছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তার সামরিক পোশাক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। এই কক্ষে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়িগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো।

এই ভবনের মোট নয়টি কক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে আরও আছে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশুপুত্র রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবহার্য আসবাবের মধ্যে আরও আছে খাবার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা, বাটি। আছে সোফা। বাড়ির দেয়াল, দরজায় বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার করে।

জাদুঘরের পেছনের অংশে রয়েছে সম্প্রসারিত নতুন ভবন। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে আর পঞ্চম তলায় পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।

এভাবে ঘুরে দেখতে দেখতে এক সময়ে ওরা টের পেল কখন যেন পুরো জাদুঘরটাই ঘুরে দেখা হয়ে গেছে তাদের। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর কেন আরও আগে দেখতে এলেন না, এমন আফসোস নিয়ে যার যার গন্তব্যে ফিরে গেলেন রাফি, আদনান ও ইমতিয়াজ। কিন্তু যাবার আগে, যারা এখনও বঙ্গবন্ধুর বাড়ি মাড়িয়ে দেখেননি তাদেরকে একবারের জন্য হলেও আসার পরামর্শ দিয়ে গেলেন।

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এনআই/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :