'এই জ্ঞ্যানা, আহতদের হাসপাতালে নে'

অধ্যাপক দুর্লভ বিশ্বাস
| আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১৬:০৩ | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৩৯

সামান্য দুই দিনের পরিচিত অতি সাধারণ কাউকে প্রায় দেড় যুগ পরে মনে রাখা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজে সম্ভব নয়। যারা অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী, তাদের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব। এমনই স্মৃতিশক্তি ছিল আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, যার প্রত্যক্ষদর্শী আমিসহ আরও অনেকে।

স্বাধীনতার পর জাতির জনক দুবার টাঙ্গাইল এসেছিলেন। দুবারই সড়কপথে। প্রথমবার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি, কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে। দ্বিতীয়বার ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে। জাতির জনককে সংবর্ধনা জানানোর জন্য মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। তখন বাসস্ট্যান্ডের মাঝখানে ছিল একটি ছোট্ট আইল্যান্ড। কোনো মঞ্চ না করে সেই আইল্যান্ড থেকেই তিনি যাতে মির্জাপুরবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হয়।

সেই সংবর্ধনা সভায় হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে। বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে ছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি টিনের বিরাট গুদামঘর। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে একনজর দেখা ও তার বক্তৃতা শোনার জন্য সেই গুদামঘরের চালের উপর ওঠে অনেক লোক। বেলা আনুমানিক সাড়ে এগারোটার দিকে বঙ্গবন্ধু যখন সেই আইল্যান্ডে উঠে মহান মুক্তিযুদ্ধে মির্জাপুরের শহীদ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাসহ অন্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন, তখনই গুদামঘরটি (বর্তমানে যেখানে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে) ভেঙে পড়ে, আর তাতে আহত হয় অনেকে। তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘এই জ্ঞ্যানা, ওদের হাসপাতালে নিয়ে যা।’

এই জ্ঞ্যানার প্রকৃত নাম জ্ঞানেন্দ্র কুমার সাহা। কুমুদিনী হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়দের প্রধান ছিলেন তখন। তাকে তৎকালীন ছাত্র-তরুণরা সাধারণত জ্ঞ্যানা কাকা বলে সম্বোধন করত।

ওই সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের মির্জাপুরের এমপি বর্তমানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক, নাগরপুরের এমপি প্রয়াত ব্যারিস্টার শওকত আলী খানসহ টাঙ্গাইলের অন্য নেতারা।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার অতি পরিচিত এই নেতাদের কাউকে নির্দেশ না দিয়ে মঞ্চ থেকে আনুমানিক ২৫ গজ দূরে দাঁড়ানো জ্ঞ্যানা কাকাকে আহতদের কেন হাসপাতালে নিতে বললেন এবং কীভাবে বঙ্গবন্ধু তার নাম জানলেন তা নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল ছিল। পরে স্থানীয় প্রবীণ রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে আমিসহ অনেকেরই জ্ঞ্যানা কাকার নাম বঙ্গবন্ধু কীভাবে জানলেন তা জানতে পারি।

১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনের কথা আমরা সবাই জানি। ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সে সময়ের মুসলিম লীগবিরোধী সব কেন্দ্রীয় নেতা অংশ নেন। কিন্তু তখন টাঙ্গাইল ছিল একটি ছোট মহকুমা শহর। সেখানে নেতাদের রাত যাপনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হয় মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের রয়্যাল গেস্ট হাউজে। জাতীয় নেতারা দুই দিনই সম্মেলন শেষে রাতে এসে কুমুদিনী হাসপাতালের রয়্যাল গেস্ট হাউজে অবস্থান করেন।

হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় প্রধান, যিনি সব সময় সাদা গেঞ্জি, সাদা হাফপ্যান্ট আর সাদা কাপড়ের জুতা পরে থাকতেন, সেই জ্ঞ্যানা কাকা নেতাদের রাতের খাবার ও সকালের চা-নাশতা পরিবেশন করতেন। তখনই জ্ঞানেন্দ্র কাকার নামটি জাতির জনক জানতে পারেন।জ্ঞানেন্দ্র কুমার সাহা কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছিলেন না, ছিলেন হাসপাতালের একজন অতি সাধারণ কর্মচারী। মাত্র দুই দিনের পরিচিত একজন সাধারণ হাসপাতাল কর্মচারীর নাম বঙ্গবন্ধু প্রায় দেড় যুগ পরে এক দুর্ঘটনায় সবার আগে স্মরণ করলেন কীভাবে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা আর জীবনের ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে যিনি সাহসিকতার মাধ্যমে মাত্র ২৪ বছরে একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিতে পরিণত করে একটি দেশ উপহার দিতে পারেন, সেই নেতার পক্ষেই অতি অল্প সময়ের পরিচিত নগণ্য একজন ব্যক্তির নাম মনে রাখা সম্ভব।

লেখক: সাবেক কমান্ডার, মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :