জাপানের আদালতে কিছুক্ষণ

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০১৮, ১৭:১৮ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০১৮, ১৭:২১

মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন
আদালত প্রাঙ্গণে শিক্ষক ও সহপাঠিদের সাথে লেখক (সর্ব বামে)

সম্ভবত পুলিশে চাকরি করার কারণেই জাপানে আসার পর থেকেই জাপানের অপরাধ সম্পর্কে জানার কৌতুহল একটু বেশি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, গত এক বছরে আমার চোখের সামনে কোন ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হতে দেখিনি।

এমনকি এখানে সকালবেলা এবং সন্ধ্যায় ট্রেনগুলোতে আমাদের দেশে ঈদের সময় যে রকম ভিড় হয় সে রকম ভিড় হলেও কখনও কাউকে ট্রেনে উঠা নিয়ে সামান্যতম ধাক্কাধাক্কি করতেও দেখিনি। আর জাপানি ভাষা না জানায় স্থানীয় পত্রিকা পড়া এবং টিভি দেখা হয় না। যে কারণে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় জাপানে কোনো অপরাধই নেই। আসলেই কি তাই? অবশ্যই না।

জাপানেও অপরাধ আছে এবং সব ধরনের অপরাধই সংঘটিত হ্য় এখানে। তবে অপরাধের ধরন ও মাত্রা কিছুটা ভিন্ন। আর সংখ্যার দিক বিবেচনা করলে তা মোটেই উদ্বেগজনক নয়। কিছু ইংরেজি নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে জাপানের অপরাধ সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা পাওয়া যায়।

তবে এটা নিশ্চিত যে, জাপানে অপরাধ করলে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আসতেই হবে। কারণ, এখানে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির সাথে এরা পরিচিতই নয়। উল্লেখ্য যে, জাপানে সাজার হার নিরানব্বই শতাংশের ওপরে যা নিঃসন্দেহে ঈর্ষনীয়।

জাপানের আদালতগুলোতে ফৌজদারি অপরাধের বিচারকার্য কীভাবে পরিচালিত হয় তা দেখার আগ্রহ অনেক দিনের। গত সপ্তাহে শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে আমার অন্যান্য সহপাঠিদের সঙ্গে জাপানের ওকিনাওয়ায় নাহা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি ফৌজদারি মামলার বিচারকার্য দেখার সুযোগ হয়েছিল।

আদালতে ঢুকতেই কঠোর নিরাপত্তা, পরিপাটি পরিবেশ ও সুনসান নীরবতা ছিল চোখে পড়ার মতো। আদালত চত্বরে কোন অবাঞ্চিত লোকজনের আনাগোনা নেই। নেই কোনো কোলাহল। আদালতের অ্যাটর্নি কেইসুকে ইশী আমাদের বিচার্য মামলাটি সম্পর্কে আগেই প্রাথমিক ধারনা দিয়েছিলেন।

এপটি ছিল একটি চুরির মামলা। গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে অভিযুক্ত ফ্যামিলি মার্ট নামক একটি কনভিনিয়েন্স স্টোর থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করেছিল যা সিসিটিভিতে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে অভিযুক্তকে সনাক্ত করে গ্রেপ্তারপূর্বক মামলা রুজু করা হয়।

তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার পরে ওইদিনই ছিল মামলার বিচারের জন্য প্রথম ধার্য তারিখ। আর প্রথম দিনেই মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে বিচারক বিচারকার্য শেষ করে আসামিকে দুই বছর চার মাসের সাজা প্রদান করেন। বিচারক আগেই মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে এজলাসে আসেন। প্রথমেই বিচারক আসামিকে জিজ্ঞাসা করে তার নাম

ঠিকানা সঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত হন। এরপর প্রসিকিউটরের বক্তব্য শোনেন। তারপর বিচারক আসামিকে অভিযোগের সত্যতা জিজ্ঞাসা করলে আসামি তার অপরাধ স্বীকার করেন। তবে তিনি বিচারককে বলেছিলেন যে, ঘটনার সময় তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। যে কারণে সে এটা করেছিল।

এরপর বিচারক আসামির আইনজীবীকে তার বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেন। তিনিও আসামির মতো একই বক্তব্য প্রদান করেন। অন্যান্য সাক্ষী এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তার উপস্থিতিও বিচারক প্রয়োজন মনে করেননি। মাত্র ৩০ মিনিটেই বিচার কাজ শেষ করে বিচারক মামলার রায় পাঠ করে শোনান। বিচারকার্য শেষ হলে অ্যাটর্নি ও কোর্ট স্টাফরা আমাদের মামলার বিস্তারিত ব্রিফ করেন।

তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, আসামি স্বভাবগতভাবেই অপরাধী। এর আগেও একাধিকবার এ ধরনের অপরাধ করে সাজা ভোগ করেছেন। আসামি ক্লেপ্টোম্যানিয়া নামের রোগে আক্রান্ত। আর এ কারণেই সে এ ধরনের অপরাধ করে থাকে।

মামলা রুজুর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে মামলার তদন্তকার্য সম্পন্ন করে প্রথম ধার্য তারিখেই মাত্র আধা ঘন্টায় বিচার কাজ শেষ করে সাজা প্রদান করা হলেও এটাকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কারণ, যে সমাজে মানবাধিকারকে ধর্মীয় অনুশাসনের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়, সে সমাজে আর যাই হোক অন্যায়ভাবে কারও শাস্তিভোগের কোনো সুযোগ নেই।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ শুধুমাত্র জনগনের ন্যায় বিচারই নিশ্চিত করে না। বরং জনভোগান্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও অপচয় হ্রাসেও সুদূরপ্রসারী ভুমিকা রাখতে পারে।

লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ ও শিক্ষার্থী, কিউশু ইউনিভার্সিটি, জাপান।