এক কাপ কফি ও চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১৯:২৩ | প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১৯:১৮

এক কাপ কফিকে কেন্দ্র করে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ভূরাজনৈতিক ঝড়। গত রবিবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন।

শুক্রবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, লস অ্যাঞ্জেলসে তাওয়ান ভিত্তিক কফি চেইন শপ ৮৫সি বেকারি ক্যাফে-তে ঢুঁ মারেন প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন। সেখানে তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানানো হয় এবং এক কাপ কফি দেয়া হয়।

এই দৃশ্যের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে চীনা নাগরিকরা। তারা এই কফি শপ বর্জনের আহ্বান জানায়।

তাইওয়ানকে চীন তাদের ভূখণ্ডের অংশ মনে করে। তাওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থন করে এমন কোনো কিছু পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে চীনা নাগরিকরা।

কফি শপটির পক্ষ থেকে দ্য ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) নেত্রী ও দেশটির প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন-কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বেকারি চেইন শপটি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দ্রুত একটি বিবৃতি দিয়েছে। তারা তাইওয়ানের স্বাধীনতা অনুভূতির পক্ষ থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ তাওয়ানের নাগরিকরা। তাদের দাবি, চীনের চাপে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি এমন বিবৃতি দিয়েছে।

এটা কেন ইস্যু হলো?

তাইওয়ানের অবস্থান একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন। দেশটির স্বায়ত্তশাসিত গণতন্ত্র রয়েছে। ১৯৫০ সালের পর থেকে চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার কমিউনিস্ট বাহিনীর কাছে পরাজিত ও মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে যায়। এরপর দেশটি তাদের স্বাধীনতার পক্ষে সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।

চীন এই দ্বীপ দেশটিকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি প্রদেশ মনে করে। দেশ হিসেবে তাদের কোনো অধিকার নেই। প্রয়োজনে জোরপূর্বক হলেও তাইওয়ান একদিন চীনের মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হবে বলে চীন মনে করে।

চীন অন্যান্য দেশগুলোকে ‘এক দেশ নীতি’ মেনে চলতে বাধ্য করে। অর্থাৎ কোনো দেশ তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলে চীনের সঙ্গে রাখতে পারবে না। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তাইওয়ানের সঙ্গে নয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং এই দাবির পক্ষে বেশ জোরেশোরে অবস্থান নিয়েছে। চীন জাতীয় সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করছে।

কফি শপে কি ঘটেছিল এবং তারপর কি ঘটল?

গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন দক্ষিণ আমেরিকার কিছু মিত্র দেশের সঙ্গে সফরে গিয়ে লস অ্যাঞ্জেলসে যাত্রাবিরতি দেন।

সেখানে তিনি ৮৫সি বেকারি ক্যাফেতে যান। এই কফি শপটি তাইওয়ানে যাত্রা শুরু করেছিল, পরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়ায়।

স্থানীয় কর্মীরা আনন্দের সঙ্গে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান। তাকে একটি ছোট্ট ব্যাগ উপহার দেন, হাসিমুখে ছবি তোলেন এবং ব্র্যান্ড মাসকটে তার অটোগ্রাফ নেন।

এই ছবিগুলো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকা একজন প্রতিনিধি ফেসবুকে পোস্ট করেন। এরপর থেকে তার পাবলিক টাইমলাইনটি বন্ধ রাখা হয়েছে।

যদিও ২০১৬ সালে তাইওয়ানের নির্বাচনে জয়ী হবার পর থেকে সাইয়ের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নমনীয়। কিন্তু তবুও তাকে বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী দেখা হয়।

সোশ্যাল মিডিয়াতে একজন চীনা নাগরিক লিখেছেন, ‘৮৫সি ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা’ চাওয়া একটি দ্বিমুখী কোম্পানি। এ ধরনের বাজে প্রতিষ্ঠানকে আমাদের বর্জন করা উচিত।’

খাবার সরবরাহকারী অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের অ্যাপস থেকে এই কফি শপটিকে বাদ দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটির প্যারেন্ট কোম্পানি গোরমেট মাস্টারকে অবহিত করেছে।

ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, এতে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা ৭.৫ শতাংশ কমে গেছে। কোম্পানিটির ক্ষতি হয়েছে ১২০ মিলিয়ন ডলার।

কফি শপটির অর্ধেকের বেশি আয় হয় চীন থেকে। তারা দ্রুত এই বিষয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে।

বিবৃতিতে ১৯৯২ সালে হওয়া তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে সমঝোতার প্রতি দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে। কিন্তু তাদের এই বিবৃতিতে খুব একটা ফল আসেনি।

বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস

চীনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ।

এক সময় ওলন্দাজ উপনিবেশ ছিল। তবে ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের রাজারাই শাসন করেছে তাইওয়ান। এরপর জাপানিরা দখল করেছে এই দ্বীপ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয় চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন চীনা সরকারের হাতে তুলে দেয়া হয় দ্বীপটি।

কিন্তু চীনে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিষ্ট বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে হারতে থাকে চিয়াং কাইশেকের সরকার। চীনের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায় তারা। এরপর চিয়াং কাইশেক আর তার কুওমিনটাং সরকারের লোকজন তখন পালিয়ে যায় তাইওয়ানে। সেখানে তারা ‘রিপাবলিক অব চায়না’ নামে এক সরকার গঠন করে। নিজেদেরকে সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বলেও দাবি করে তারা।

কোন একদিন কমিউনিস্টদের কাছ থেকে আবার পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণ তারা নেবে, এমনটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।

বহুদিন পর্যন্ত জাতিসংঘ থেকে বিশ্বের অনেক দেশ চিয়াং কাইশেকের সরকারকেই চীনের সত্যিকারের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ অনেকের কাছে শুনতে অবাক লাগতে পারে, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কিন্তু তাইওয়ানের সরকারই চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

কিন্তু ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ বেইজিং এর সরকারকেই চীনের আসল সরকার বলে স্বীকৃতি দিল। তারপর থেকে একে একে বিশ্বের প্রায় সব দেশই বেইজিং এর পক্ষ নিল এবং তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কমতে থাকল।

১৯৮০’র দশক পর্যন্ত চীন আর তাইওয়ানের মধ্যে চলেছে তীব্র বাকযুদ্ধ। কিন্তু এরপর সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ‘এক দেশ, দুই পদ্ধতি’ নামে চীন এক প্রস্তাব দেয়। যেখানে তাইওয়ান মূল চীনে বিলুপ্ত হবে, কিন্তু তাদের স্বায়ত্বশাসন দেয়া হবে। কিন্তু তাইওয়ান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য এর মধ্যে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকেনি।

২০০০ সালে তাইওয়ানের নুতন প্রেসিডেন্ট হন চেন শুই বিয়ান। ২০০৪ সালে তিনি ঘোষণা দেন যে তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। তার এই অবস্থান চীনকে ভীষণ রুষ্ট করে। ২০০৫ সালে চীন তড়িঘড়ি করে এক আইন পাশ করে। যাতে বলা হয়, তাইওয়ান যদি চীন থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে, সেটা ঠেকাতে চীন প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে।

তাইওয়ানের অর্থনীতি এখন চীনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এখন আর স্বাধীনতাকে কোন বাস্তবসম্মত বিকল্প বলে ভাবে না।

তাইওয়ানের বড় দুই দলের মধ্যে ‘ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি’ এখনো অবশ্য স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যদিকে কুওমিনটাং পার্টি (কেএমটি) চায় মূল চীনের সঙ্গে একত্রীকরণ।

(ঢাকাটাইমস/১৭আগস্ট/এসআই)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

কলকাতা হাইকোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ মমতার

ভারী বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার, পালালো শতাধিক বন্দি 

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে ১৩ রাজ্যের ৮৮ আসনে ভোটগ্রহণ শুক্রবার

ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে চায় আর্জেন্টিনা, কিন্তু কেন?

স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, দায়িত্বপালন থেকে বিরত থাকবেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী 

ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: সিরিয়া কি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হবে?

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিবে জ্যামাইকা

পাকিস্তানের পর এবার শ্রীলঙ্কা সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট

বিরল সফরে ইরানে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিদল

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :