কিংবদন্তি গোপাল ও বাঙালির হাসির রাজারা

ফারুক নওয়াজ
 | প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট ২০১৮, ১৪:১০

বাঙালি যেমন ত্যাগে বলীয়ান, সংগ্রামে দুর্নিবার, অতিথিপরায়ণতায় অনন্য তেমনি কৌতুকপ্রিয়তায় তার জুড়ি মেলা ভার। আমাদের মোল্লা হোজ্জা বা আফেন্দি নেই, তবে আছে কিংবদন্তির হাসির রাজা গোপাল ভাঁড়। বাস্তবে এই রাজার অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে প্রকট সন্দেহ রয়েছে গবেষকদের মাঝে। এমনকি পণ্ডিতদের যাবতীয় বিবেচনায় এ-নামের কোনো অস্বিত্ব আদৌ জগতে নেই বলে সাব্যস্ত হয়েছে। তারপরও পণ্ডিতজনরা দূর-অতীতের একজনকে প্রখরভাবে সন্দেহ করেন, যিনি গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচারিত কৌতুকসর্বস্ব চুটকি এবং রসসিক্ত গল্পকথাগুলোর প্রকৃত স্রষ্টা। আবার কারো কারো ধারণা যুগ-যুগ ধরে গোপাল ভাঁড়ের নামে যেসব কাহিনি বাংলার লোকমুখে ছড়িয়ে চলেছে সেসব একজনের সৃষ্টি নয়, এগুলো বহুজনের বানানো কথারস। পণ্ডিতদের এই সন্দেহ বা ধারণার কোনোটিই অযৌক্তিক নয়। কারণ বহুকাল ধরেই পণ্ডিত-গবেষকরা হাসির গোপালের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। অথচ যাকে খোঁজেন না তাকেও অতীতে ওরা পেয়ে গেছেন এমন নজিরও আছে। যেমন মহা মহোপাধ্যায় মহাশয় না-খুঁজতেই পেয়ে গেছিলেন বাঙালির প্রথম সাহিত্য-নিদর্শন সহস্র বছর আগের চর্যাপদের পান্ডুলিপি। পণ্ডিতরা নিরন্তরই কিছু না কিছু অতীত নিদর্শন পাচ্ছেন। অথচ যার নিদর্শন আছে কাল-কালান্তর ধরে তাকেই পাচ্ছেন না। আর পাচ্ছেন না বলেই শেষমেশ ধরেই নিয়েছেন, না, হাসির গোপাল নামে কেউ ইহজগতে নেই।

অথচ আমরা সেই শৈশব থেকেই গোপাল ভাঁড়ের রসকথা শুনে আসছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরাও গোপালের বিচিত্র সেসব হাস্যরসের চটুল কাহিনি শুনেছেন। তাদের পূর্বসূরিরাও নিঃসন্দেহে শুনেছেন। এই অধুনা ডিজিটাল যুগেও গোপাল সমানে হাসিয়ে যাচ্ছেন সবাইকে। এখনো ফুটপাতে, বাসে-লঞ্চে, যাত্রাপথে, বইয়ের বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে গোপাল ভাঁড়ের নামসর্বস্ব সস্তা কাগজে ছাপা রঙিন মনকাড়া প্রচ্ছদের কমমূল্যের চটি বইগুলো। মানুষ হয়তো সে বই সংগ্রহে রাখে না, পথে বা অবসরে সময় কাটানোর জন্য সেগুলো পড়ার জন্য কেনে। পড়ে আনন্দ পায়। আপন মনে হাসে। আর পড়া শেষ হলে পথেই হয়তো সেটা রেখে যায়। তারপরও আমাদের অস্তিত্বহীন বা ছদ্মবেশি গোপাল ভাঁড় মানুষকে হাসিয়ে প্রফুল্ল রাখে। তার মনের দুঃখ-ব্যথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে রাখে! এটাও কি কম!

কিন্তু যখন বাস্তবে ফিরে আসি, গোপাল ভাঁড়ের বইয়ে আঁকা তার সেই অদ্ভুত চিরচেনা পেটমোটা, টাকওয়ালা ছবিটার মতো কাউকে পথে-ঘাটে, সাহিত্যসভা, কোথাও কাউকে দেখি না। পক্ষান্তরে সাহিত্যের পণ্ডিত-গবেষকদের লেখায়ও দেখি না, গোপাল ভাঁড় নামে কেউ কখনো ছিল না এবং এখনো নেই। তখন মনটা খারাপ হওয়ারই কথা। তবে গোপাল ভাঁড় নামে যদি অতীতে কেউ থেকেই থাকেন তবে তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় সশরীরে ছিলেন। রাজা রাজ্যশাসনের জটিল কাজকর্মে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তখন প্রিয় গোপালের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। গোপাল তখন বুঝতেন রাজা একটু মন খুলে হাসতে চাচ্ছেন। আর গোপাল তখনই উপস্থিত বুদ্ধিবলে উদ্ভট একটা মন্তব্য বা চুটকি ছুঁড়ে দিতো। তা শুনেই রাজা মুচকি হাসতেন বা শøীলতাবর্জিত রসকথার আধিক্যে বাঁকাচোখে তাঁর দিকে চেয়ে গম্ভীর হয়ে যেতেন।

সেই হাসির রাজা গোপাল রাজার যাত্রাপথের সঙ্গী হতেন। রাজা জটিল কোনো বিষয় নিয়ে সমস্যায় পড়লে গোপাল মাথা চুলকে সহজেই একটা সমাধানের পথ বাতলে দিতেন। পরনে সাধারণ ধুতি, গায়ে হলুদ রঙের হাফহাতা ফতুয়া, ঘাড়ে গামছা ড্যাবডেবে চোখের টাকওয়ালা পেটমোটা গোপাল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার উচ্চপদের সভাসদ না হলেও ছিলেন রাজা ও রাজমহিষীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

কিন্তু পণ্ডিতরা খানাতল্লাশি করে তাঁর হদিস না পেয়ে বলছেন ভিন্নকথা। পণ্ডিত সুকুমার সেনের মতে, কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড় ছিলেন না। শঙ্করতরঙ্গ নামে রাজার যে পার্শ্বচর বা দেহরক্ষী ছিলেন তিনি বাগ্বিদগ্ধ ব্যক্তি ছিলেন, ভাঁড় ছিলেন না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় কথিত ও প্রচলিত গোপাল ভাঁড়ের কোনো চুটকি গল্প আসলে শঙ্করতরঙ্গেও হওয়া সম্ভব। গোপাল ভাঁড়ের বেশির ভাগ গল্পই গ্রাম্য, মাঝে-মাঝে অশ্লীলও। সুপণ্ডিত সুকুমার সেনের কথা যদি সত্য বলেই ধরে নিই, তাহলে রাজার দেহরক্ষী শঙ্করতরঙ্গই যে নামের ছদ্মাবরণে হাসির রাজা গোপাল ভাঁড়ই; এটাও মানতে হয়। আমরা জানি ইতিহাসে এমন ছদ্মনামের আড়ালে বিখ্যাত অনেকেই সাহিত্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রই শুধু যে একসময় নামের ছদ্মাবেশ ধরেছিলেন তা নয়, চর্যাপদের রচয়িতরা এবং মধ্যযুগের অনেকেই ছদ্মনামেই লিখে গেছেন। আমরা আজো চণ্ডিদাস সংকটের সুরাহা পাইনি, সে-হিসেবে হয়তো একদিন সত্যি-সত্যিই চিরকালের হাসির রাজা গোপাল ভাঁড়ের হদিস আমাদের ভবিষ্যৎ-পণ্ডিতরা পেয়ে যাবেন। তবে সুকুমার সেনের অভিমতকে আপাতত মেনে নিয়ে আমরা ধরে নিতে পারি, আমরা যাকে গোপাল ভাঁড় মনে করছি, তিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাগ্বিদগ্ধ দেহরক্ষী শঙ্করতরঙ্গ এবং গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচলিত চুটকিগুলো তাঁরই সৃষ্টি।

তবে অন্য একটি অভিমত, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ ও হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচলিত গল্পগুলোর স্রষ্টা সম্ভবত একজন নয়। বটতলা থেকে প্রচারিত রহস্যগল্পের ও চুটকি-ঠাট্টার বইগুলো গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচলিত হয়েছে। যে-সময় এই বইগুলো প্রকাশিত হয় তখন কলকাতায় গোপাল উড়ের যাত্রার খুব পসার। মনে হয়, সে-সূত্রেই কোনো এক বাক্যবাগীশ রসিক ব্যক্তি গোপাল ভাঁড়ের খ্যাতি পেয়েছিলেন। জাতিতে তিনি নাপিত বলে কল্পিত হয়েছেন।” (সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান-পৃ. ১৯৬) অবশ্য, এই মতটি কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তিনি নাপিত নাকি অন্যজাত সেটাও জানার বিষয় নয়। প্রশ্ন আসে, সে-সময়কার গোপাল উড়ের যাত্রার পসারের সঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের সম্পর্কটা কি? আর সেই সুযোগে আর কেউ গোপাল উড়ে না হয়ে গোপাল ভাঁড়ই-বা হতে যাবে কেন? আর আমাদের জানা মতে, যাত্রার গোপাল উড়ে উনবিংশ শতকের লোক। আর গোপাল ভাঁড়ের এসব গল্প আরো আগে থেকেই সম্ভবত প্রচলিত ছিল এবং সেটাই। পণ্ডিতদের গবেষিত তথ্যেও কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার প্রসঙ্গ আসছে গোপাল কাণ্ড আলোচনায়। সে-সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর। এ-হিসেবে ধরে নেয়া যায়, গোপাল ভাঁড়ের নামে এসব কিচ্ছা গোপাল উড়ের জন্মশতকের আগের শতক থেকেই লোকমুখে প্রচারিত হতো। কারো অনুমানসিদ্ধ কথাবার্তায় আমরা না গিয়ে বলব, গোপাল ভাঁড়ের প্রচলিত গাল-গল্পগুলো অনাদিকাল টিকে থাকুক, আমাদের হৃদয়ে ঠায় করে নেয়া গোপাল ভাঁড় নামের অজ্ঞাত চিরকালের সেই হাসির রাজাটিও অমর হয়ে থাকুক। তাঁর রসকাহিনিগুলো ছড়িয়ে যাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। জড়িয়ে থাক বাঙালির ঠোঁটে ও অন্তরে হাসির চুটকি হয়ে। হোক না তা কিছুটা অশালীন গ্রামবাংলার সাদামাটা সাধারণ জীবনে সেসব কিছুটা হলেও তো আনন্দ দেবে।

২.

পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশের সিনেমা হলে উর্দু ছবিই বেশি চলত। বাংলা ছবি নির্মাণ শুরু হয় অনেক পরে। ১৯৫৬ সালে এদেশে প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণ করেন আবদুল জব্বার খান। তার আগে কলকাতায় নির্মিত বাংলা ছায়াছবিই এদেশের মানুষকে আনন্দ দিতো।

বলব, ১৯৬৫ সালের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ঢাকায় বাংলা ছবি খুব বেশি নির্মিত হয়নি। সে সময় জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, মুস্তাফিজ প্রমুখ পরিচালক বিশেষ ভ‚মিকা রাখেন।

অন্যদিকে কলকাতায় তখন একের পর এক বাংলা ছবি তৈরি হয়ে চলেছে।

এদেশের বাঙালিদের কাছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবি তখন সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণে নতুন উদ্যম লক্ষ্য করা যায়।

চলচ্চিত্র মানুষকে আনন্দ দেয়। একটি কাহিনির মধ্যে অনেক চরিত্র। অনেক খণ্ড খণ্ড আনন্দ-বেদনার দৃশ্য। আর বিশেষ কিছু চরিত্র থাকে, যারা দর্শকদের হাসিয়ে হাসিয়ে আনন্দে ভাসিয়ে রাখেন। এরা হলেন কৌতুক অভিনেতা। একটি ছবিকে জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল করে তুলতে কৌতুক অভিনেতাদের ভ‚মিকা থাকে বেশি।

কোনো কোনো কৌতুক অভিনেতা নিজস্ব অভিনয়শৈলীর সুবাদে দর্শকমনে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকেন।

বাংলা ছায়াছবির এমন কয়েকজন কালজয়ী হাসির মানুষের কথাই আমরা এখন বলব।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকৃত নাম শ্যামানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট বিক্রমপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর অভিনয়জীবনের শুরু ঢাকার মঞ্চে। শৈশব থেকেই অভিনয়ে ঝোঁক। ঢাকাইয়া ভাষায় রসাত্মক সংলাপে শ্রোতা-দর্শকদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পাড়ি জমান কলকাতায়। প্রথম ছবি ‘জাগরণ’ (১৯৪৭)। এরপর অভিযোগ, সর্বহারা, তথাপি, মানদন্ড, মন্ত্রমুগ্ধ, বরযাত্রা, পাশের বাড়ি, কেরানীর জীবন, নতুন ইহুদি, বসুপরিবার, আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ এবং অসমাপ্তসহ তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন। তার সর্বশেষ ছবি শোরগোল। মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। হিন্দি ছবিতেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি অডিওতেও তিনি বাঙালি হৃদয় মাতিয়ে রেখেছেেিলন। ঢাকার গাড়োয়ান, সিনেমাবিভ্রাট, ফটিকলাল, যুগের অভিযোগ ইত্যাদি তার বিখ্যাত অডিও ক্যাসেট। কালজয়ী হাসির রাজা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

কথার পরতে পরতে হাসি। অভিনয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ হাসির মানুষ অনুপ কুমার। প্রকৃত নাম সত্যেন দাস। বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দাস ছিলেন সংগীতশিল্পী। ১৯৩০ সালের ১৭ জুন অনুপ কুমারের জন্ম।

প্রথম ছবি হালখাতা (১৯৩৮)। এরপর নিমন্ত্রণ, পলাতক, বসন্তবিলাপ, দাদার কীর্তি, ফেলুদা, মৌচাক, সাক্ষীগোপাল, সংকল্প, বিদ্যাসাগর, ভক্তিরঘুনাথ, বাঁশের কেল্লা, শ্বশুরবাড়ি, অগ্নিপরীক্ষা, সাগরিকা, আজকালপরশু, দুরন্ত চড়াই, বিরাজবউ, নতুনদিনের আলোসহ তিন শতাধিক ছবিতে দর্শক হাসিয়েছেন এন্তার।

জীবনের শেষপ্রান্তে ১৯৯৭ সালে তার শেষ অভিনীত ৬টি ছবি একসাথে মুক্তি পায়। এই হাসির মহাশিল্পী ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে ৬৮ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

রবি ঘোষ। বাংলা চলচ্চিত্রের যুগশিল্পী। হাসির রাজা তিনি। প্রকৃত নাম রবি ঘোষ দ¯িÍদার। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৩১ কলকাতায়।

ছোটখাটো সুঠাম দেহ। চোখ দুটি যেন বুদ্ধির গোলা। হাসি, সংলাপ, অঙ্গভঙ্গি সবকিছুতেই একেবারে নিজের মতো। বিশ্বখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আগমন।

গুপী গায়েন বাঘা বায়েনের গুপী চরিত্রে তিনি যেমন অমর হয়ে আছেন, তেমনি ‘গল্প হলেও সত্যি’ চলচ্চিত্রে পুরো তিন ঘণ্টা কী অদ্ভুত জাদুকরি অভিনয়শৈলীতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন দর্শকদের। কলকাতার বাংলা ছবিতে রবি ঘোষ থাকবেন না এমনটি ভাবাই যেন অবান্তর। পরিচালকরা তাকে ছাড়া ছবি করবেন কি করে? সে ছবি কি চলবে?

এমন অনিবার্য হাসির শিল্পী রবি ঘোষ। চার শর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।

উল্লেখযোগ্য ছবি কাহিনী, বাক্স রহস্য, আগন্তুক, হীরক রাজার দেশে, গুপী বাঘা ফিরে এলো, নৌকাডুবি, ধন্যি মেয়ে, বাঘিনী, মহাপুরুষ, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, গুপী গায়েন বাঘা বায়েন, বসন্তবিলাপ, মর্জিনা আব্দুল্লা, পদ্মানদীর মাঝি, মেঘ, কিছুক্ষণ ইত্যাদি।

নিধিরাম সর্দার এবং সাধু যুধিষ্ঠিরের করচা তাঁর পরিচালিত দর্শকনন্দিত দুটি ছবি।

৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

এবার ঢাকার বাংলা ছবি প্রসঙ্গে আসি। কলকাতার মতো এখানকার ছবিগুলোও কৌতুক অভিনেতাদের দর্শকনন্দিত অভিনয়শৈলীতে ধন্য হয়েছে।

বিশেষ করে ষাট ও সত্তর দশকের ঢাকাই ছবিতে প্রতিভাদীপ্ত কৌতুক অভিনেতাদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।

এ সময়ের দর্শকমাতানো শিল্পীদের মধ্যে হাসমত, রবিউল, খান জয়নুল, আনিস, মতি, টেলিসামাদ প্রমুখ আপন অভিনয়শৈলীগুণে দর্শকমনে ঠায় করে নিয়েছিলেন।

হাসমত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন বেঁচে থাকতেই। এমনকি তাকে নিয়ে ‘হাবা হাসমত’ নামে একটি ছবিও নির্মিত হয়েছিল। হাবাগোবা অভিনয়ে তার জুড়ি ছিল না।

খান জয়নুল তার উল্টো। খুব চালাক-চতুর এবং চোখ-কান নাচিয়ে হাসির অভিনয়ে দর্শকনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন।

রবিউল ক্ষীণস্বাস্থ্যের বীরত্ব জাহির করতে পটু ছিলেন। তার উপস্থিতিই দর্শকদের হাসির উদ্রেক করত।

এই সময়ের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা টেলিসামাদ। লিকলিকে, লম্বাটে গড়নের অদ্ভুত মজার শিল্পী। টেলিভিশনের কৌতুক অভিনয়শিল্পী ছিলেন প্রথমদিকে। ফলে চলচ্চিত্রে এসে ‘টেলিসামাদ’ নাম ধারণ করেন।

আনিস, সাইফুদ্দীন এবং আশীষ কুমার লৌহ ছিলেন এ সময়ের তিন শক্তিশালী কৌতুক অভিনেতা। আশীষ কুমার লৌহ লেখক ও কাহিনিকার হিসেবেও প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। এ পর্যায়ে এটিএম শামসুজ্জামানও হাস্যরসিক অভিনেতা হিসেবে দর্শকনন্দিত হন।

এদের মধ্যে টেলিসামাদ ও এটিএম শামসুজ্জামান ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। টেলিসামাদ এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন। তবে যুগের পালাবদলে চলচ্চিত্রের এই হাসির মানুষটি অনেকটাই আড়ালে চলে গেছেন। তবে এটিএম শামসুজ্জামান এখনো চলচ্চিত্রের সেরা চরিত্রাভিনেতা।

দেশের বিখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্রের শুরুটাও কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। আরো দুজন শক্তিশালী কৌতুক অভিনেতা সত্তর দশকের মতি এবং পরবর্তী সময়ের দিলদার। এ দুজনও হারিয়ে গেছেন।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতিভাদীপ্ত হাসির নায়কদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের কোনো জানার সুযোগ নেই।

মাত্র অর্ধশত বছর আমাদের চলচ্চিত্রের বয়স। অথচ চলচ্চিত্রের আনন্দস্পন্দন কৌতুক অভিনেতারা আসেন, হাসান, মাতান এবং চলে যান। প্রিয় এই হাসির মানুষদের আমরা কেউ মনে রাখি না।

পরিশেষে বলব, আমাদের সাহিত্যেও হাস্যরস কম নেই। বিশেষ করে শিশুসাহিত্যে এই হাসির তোড়টা একটু বেশিই। সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়রা যেমন হাসিয়েছেন, তেমনি এ যুগে এদেশের নিয়ামত হোসেন, এহসান চৌধুরী, কাইজার চৌধুরী, আহসান হাবীবরাও শিশুদের লেখার গুণে নিরন্তর হাসিয়ে চলেছেন। আর সৈয়দ মুজতবা আলী, আবুল মনসুর আহমদরা তো সমাজের সত্যচিত্র তাঁদের রম্যধর্মী রচনাসমূহে তুলে ধরেছেন অদ্ভুত কথামালায়।

আর রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্ররা শুধু লেখায় হাসাননি, নানা পরিবেশে টুকরো কথার ছটায় হাসিয়ে গেছেন এন্তার। তাঁদের সেসব হাসির কাহিনি নানাজনের স্মৃতিচারণে লিপিবব্ধ হয়ে আছে। আমাদের জীবনে শোক আছে, দুঃখ আছে। আছে জ্বরা-ব্যাধি। আছে দেনা ও বিরহ। এর মধ্যেই আমাদের বাঁচতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়। আর সেজন্য হাসতে হবে। হাসতে হাসতে আমরা কাঁদব, আবার কাঁদতে কাঁদতে হাসবো। এই হাসিকান্না নিয়েই তো জীবন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :