চুগতাইয়ের দোস্ত-দুশমন মান্টো

বিধান রিবেরু
| আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৮, ১২:২০ | প্রকাশিত : ২৪ আগস্ট ২০১৮, ১২:১৮

চেয়ারে জবুথবু হয়েই বসেন তিনি। হুট করে দেখলে মনে হবে বামন, ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু যখন চেয়ার ছেড়ে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ান, তখন বোঝা যায় লোকটি বেশ লম্বা। সেদিন তার গায়ে ছিল খদ্দরের কুর্তা-পায়জামা আর নেহেরু কোট। বেশ উৎফুল্ল হয়েই তিনি স্বাগত জানালেন, আসুন আসুন।

অতিথি বললেন, আপনি কি জানেন আমি ভেবেছিলাম, আপনি আরেকটু কালো হবেন, আর গুটিয়ে থাকা লোক হবেন?

উত্তরে গৃহকর্তা জানান, তিনি ভেবেছিলেন অতিথি হবেন বেশ হৃষ্টপুষ্ট কোনো পাঞ্জাবি, যে গান গাইতে পারে বেশ উচ্চৈঃস্বরে।

এমন উত্তর শুনে অতিথি ভাবলেন, দাঁড়ান এর জবাব আপনি পাবেন।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো দুজন মিলে কি নিয়ে যেন তর্ক জুড়ে দিয়েছে। তারও কিছু সময় পর একে অন্যকে বাক্যবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। তবে এই ঝগড়া থেকেই তাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত।

অতিথির নাম ইসমত চুগতাই, আর গৃহকর্তার নাম সাদাত হাসান মান্টো। দুজনই উর্দু ভাষার বিখ্যাত গল্পকার। চুগতাই মান্টোর চেয়ে তিন বছরের ছোট। মান্টোর জন্ম ১৯১২ সালে। আর চুগতাইয়ের জন্মসাল ১৯১৫। কাছাকাছি বয়সী এই দুই মেধাবী গল্পকারের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। দুজনই ছিলেন দুজনের কাজের সমঝদার। তাই তো চুগতাই মান্টোকে নিয়ে লিখলেন ‘আমার দোস্ত, আমার দুশমন!’ চুগতাইয়ের সঙ্গে শুধু মান্টোরই নয়, মান্টোর স্ত্রী সাফিয়ার সাথেও সখ্য গড়ে ওঠে। মান্টো আর সাফিয়ার পারিবারিক বন্ধুই বনে যান চুগতাই আর চুগতাইয়ের স্বামী শহীদ লতিফ। শহীদই প্রথম বন্ধু মান্টোর বাসায় চুগতাইকে নিয়ে আসেন। এরপর ভিন্ন মাত্রার এক দোস্তি হয় চুগতাই আর মান্টোর। তাদের দুজনের মধ্যে গল্প লেখা ছাড়াও আরো একটি অভিন্ন জায়গা ছিল সেটি হলো চলচ্চিত্র। চুগতাই ও মান্টো দুজনই চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, সংলাপ লিখেছেন। যুক্ত থেকেছেন চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে।

প্রথম সাক্ষাতে মান্টোর চোখের পাতাকে ময়ূরের পেখমের মতোই মনে হয়েছিল চুগতাইয়ের। মান্টোর চোখে চুগতাই দেখেছিলেন অহঙ্কার, দুর্বিনীত ভাব ও সজীবতা। ময়ূরের কথাই মনে হয়েছিল তার। মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দনও থেমে গিয়েছিল, ওই চোখ দেখে। মাথা ভর্তি প্রচুর চুল, হলদে গাল, আকাবাঁকা কয়েকটি দাঁত, অপূর্ব হাত-পা...সব মিলিয়ে মান্টো ছিলেন মনোমুগ্ধকর, চুগতাইয়ের চোখে। চুগতাইয়ের এই মুগ্ধতায় অবশ্য পরে ছেদ পড়ে। কেন পড়ে, সেটা আমরা জানবো একটু পরই। আগে বলে নিই গত শতাব্দীর উর্দু ভাষার এই দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের সম্পর্কের ধরনটা কেমন ছিল।

বলা যেতে পারে অম্ল-মধুর বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মধ্যে। মান্টো ‘বেহেনজি’ বলতেন বলে খেপে যেতেন চুগতাই। কারণ ভাইদের মধ্যে অনেকেই তাকে ওটা বলে খেপাতেন। দশ ভাইবোনের মধ্যে চুগতাই ছিলেন ৯ নম্বর। তার ভাইয়ের সংখ্যা ছিল ৬ জন। ভাইয়েরা বোনকে বোন বলে সম্বোধন করবে তাতে রাগের কি আছে? মান্টোর প্রশ্নের উত্তরে চুগতাই বলতেন, তাকে খেপানোর জন্যই ওই নামে ডাকা হতো। আর এর ফলও ভোগ করতেন ভাইয়েরা। বেশ মারকুটে ছিলেন চুগতাই। অবশ্য বড় ভাই বাদে। কারণ বড় ভাই চুগতাইয়ের অনেক বড়, আর তাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। এই ভাইয়ের যক্ষ্মা হয়েছিল। তাই কাশির ধরনটা পরিচিতই ছিল চুগতাইয়ের কাছে। মান্টোর কাশি দেখে তাই মনে শঙ্কা হয় তার। মান্টোকে তিনি বলেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন?

মান্টোর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো চিকিৎসা? ডাক্তারগুলো তো গর্দভ। তিন বছর আগে ওরা বলে দিলো আমি যক্ষ্মার কারণে মারা যাবো এক বছরের মধ্যে। দেখতেই পারছেন আমি তাদের বাধ্যগত হইনি। তাই এখন সব ডাক্তারকেই আমার বেকুব মনে হয়। ওদের চেয়ে আমার কাছে জাদুকর, কবিরাজ ঢের ভালো।

চুগতাই বললেন, আপনার আগেও আমি একই কথা শুনেছিলাম এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে।

কে সেই ভদ্রলোক? জানতে চাইলেন মান্টো।

চুগতাই জানালেন, সেই ভদ্রলোক তার ভাই, আজিম বেগ। তিনি এখন কবরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

এখান থেকে আলাপ হয় তো চলে গেলো আজিম বেগের শিল্প সাধনা প্রসঙ্গে। দুজন সৃষ্টিশীল মানুষ একত্রে থাকলে যা হয় আর কি! শিল্প আর সৃষ্টিই তাদের আলোচ্য হয়ে ওঠে বারবার। চুগতাই স্বামী শহীদের সঙ্গে এসেছিলেন মান্টোর বাসায়, এসেছিলেন কয়েক মিনিটের জন্য। কিন্তু দেখা গেলো সেই বৈঠক সকাল গড়িয়ে চলে গেলো বেলা এগারোটার দিকে। তারা দুজন বকবক করেই যাচ্ছেন, আর দূরে চুগতাইয়ের স্বামী শহীদ বসে বসে তাদের বাগযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছেন, পেটে ক্ষুধা নিয়ে।

অবশ্য কেবল যুদ্ধই নয়, শান্তিও বিরাজ করতো তাদের মধ্যে। মান্টো প্রথম দেখায় চুগতাইয়ের ‘লিহাফ’ বা ‘লেপ’ গল্পটার বেশ প্রশংসা করেন।

এই গল্প নিয়ে চুগতাই বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। গল্পটি নারীদের সমকামিতা নিয়ে। এক কিশোরীর বয়ানে উঠে আসা পূর্ণবয়স্ক দুই নারীর প্রেম নিয়ে এই গল্প। এটির জন্য আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছিল চুগতাইকে। কিন্তু বিচারক এমন কোনো শব্দ সেই গল্পে পাননি, যাতে কাহিনিটিকে অশ্লীল বলে সাব্যস্ত করা যায়। সে রকম কিছু না বলেই চুগতাই সবটাই বলে দিয়েছিলেন। আর ওখানেই ছিল তার মুন্সিয়ানা।

‘লেপ’ গল্পে সমকামিতা, ‘গেন্দা’ গল্পে ধর্ষণ, ‘বাঁদি’ উন্নাসিকায় এক সাধারণ বাঁদি ঘরের মেয়েকে এক নবাবপুত্রের সঙ্গে বিয়ে একের পর এক এমন সব প্রচল ভঙ্গকারী গল্প লিখে চুগতাই তৎকালে বেশ সাহসী লেখিকা হিসেবেই নিজেকেই প্রতিষ্ঠা করেন। মান্টোও একই পথের পথিক। সমাজের অচলায়তন ও কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রাখা সত্যকে আফসানার মাধ্যমে দেখিয়ে দেয়াই যেন তার কাজ, তাদের কাজ। তাই তো বন্ধুত্বটা জমে উঠেছিল।

চুগতাই মাঝে মাঝে অবাক হতেন, মান্টো প্রায় সময়ই অবলীলায়, সাবলীল ভঙ্গিতে ‘নিষিদ্ধ’ বা তথাকথিত ‘অশ্লীল’ জিনিস নিয়ে আলাপ করতে পারতেন এবং সেসময় বিন্দুমাত্র লজ্জাক্রান্ত হতেন না। আর যার সঙ্গে আলাপ করছেন, তারও অস্বস্তি বোধ হতো না, সেটার সুযোগই থাকতো না। মান্টো এমন ভাবে কথার পিঠে কথা বলতেন যে, শ্রোতা কথা শুনে বিরক্ত বা মেজাজ খারাপ করতেন না, বরং বেশ মন হালকা করে হাসতেন, কারণ মান্টো হাসাতে জানতেন। চুগতাই সাক্ষ্য দিচ্ছেন:

এক বিকেলে স্ত্রী সাফিয়ার কথা বারবার বলছিলেন মান্টো। তখন চুগতাই বললেন, স্ত্রীকে কাছে এনে রাখলেই তো হয়।

আরে...আপনি কি ভাবছেন, তাকে ছাড়া আমি শুতে পারি না? স্বভাবসুলভ কণ্ঠে মান্টোর সওয়াল।

চাইলে তো অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠের উপরও শুতে পারে। হেসে উত্তর দেন চুগতাই। এরপর জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি সাফিয়াকে অনেক ভালোবাসেন?

ভালোবাসা! মান্টো এমন করে চেঁচিয়ে উঠলো যেন চুগতাই তাকে গালি দিয়েছেন। আমি তাকে মোটেও ভালোবাসি না। আমি ভালোবাসাতে বিশ্বাসই করি না। গোল গোল চোখ করে বলেন মান্টো।

তার মানে আপনি কখনো কারও প্রেমে পড়েননি? কপট বিস্ময়ের ভাব নিয়ে প্রশ্ন করেন চুগতাই।

না।

তাহলে তো আপনার কখনো ঘাড়ের উপর ব্রণও হয়নি, হামও না। তবে নির্ঘাত হুপিং কাশি হয়েছিল, আমার বিশ্বাস।

এ কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠেন মান্টো। আপনি ভালোবাসা বলতে কি বোঝেন? মান্টোর গলা এরপর ভারী হয়ে ওঠে। বোঝা যায় তিনি আর হালকা চালে নেই। বলেন, ভালোবাসা বেশ প্রগাঢ় আর সর্বব্যাপী জিনিস। আমরা আমাদের মাকে ভালোবাসি, ভাই, বোন...স্ত্রীকেও ভালোবাসি। আমরা তো আমাদের স্যান্ডেল আর জুতাকেও ভালোবাসি। আমার এক বন্ধু ছিল, সে তার কুকুরীকেও ভালোবাসতো। অবশ্যই, আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসতাম।

ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই মান্টো গুটিসুটি মেরে বসেন। বলতে থাকেন, ছেলেটা ছোট ছোট পায়ে টলমল করতে করতে দৌড়াতো। দুষ্টুর হাড্ডি ছিল। মেঝেতে হামাগুড়ি দেয়ার সময় সামনে যা পেতো সরাসরি মুখে চালান করে দিতো। আমার খুব নেওটা ছিল। আর দশটা বাবার মতোই মান্টো আবেগ নিয়ে নিজের সন্তানের কথা বলতে শুরু করলেন।

চুগতাইকে মান্টো বলছেন, বিশ্বাস করুন, ওর ছয় কি সাত দিন বয়স থেকে ওকে আমার পাশে নিয়ে শুতাম। ওর শরীরে তেল মেখে দিতাম, গোসল করিয়ে দিতাম। যখন ওর মাত্র তিন মাস বয়স, তখন ও হাসতো খিলখিল করে, সারা ঘরে হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়তো। ওকে দুধ খাওয়ানো ছাড়া সাফিয়াকে আর কিছুই করতে হতো না। রাতে সাফিয়া যখন ঘুমিয়ে থাকতো, তখন আমিই ওকে নিঃশব্দে খাওয়াতাম। খাবার খাওয়ানোর আগে বাচ্চাদের গা কোলন বা স্পিরিট দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়, নয়তো সারা শরীরে রেশ উঠতে পারে। বেশ গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলছিলেন মান্টো। আর চুগতাই অবাক হয়ে শুনছিলেন তার কথা। কোন ধরনের মানুষ এই মান্টো? শিশুযত্নে ও একেবারে পাকা!

কিন্তু সে বাঁচেনি, ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় দুমড়ে যাচ্ছেন মান্টো, বাইরে উৎফুল্ল। বললেন, মরেছে ভালোই হয়েছে। ও আমাকে আয়া বানিয়ে দিয়েছিল। ও যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো ওর নোংরা কাপড় ধোয়াতেই আমার সময় চলে যেতো। এই দুনিয়ার কোনো কাজেই আমি আসতাম না, মূল্যহীন হয়ে পড়তাম! সত্যি ইসমত বোন, আমি ওকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম।

অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যেই সাফিয়া, মান্টোর স্ত্রী চলে আসেন মান্টোর ডেরায়। আর সাফিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে দেরি হয়নি চুগতাইয়ের। মেয়েলী আলাপই বেশি হতো তাদের মধ্যে। মান্টো আবার তাদের আলাপে দুষ্টুমি করে কান পাততেন, এরপর খেপানোর জন্য বলতেন, তওবা তওবা, আমি ভাবতেও পারিনি মেয়েরা এত নোংরা নোংরা কথা বলতে পারে! একথা শুনে লজ্জায় কান লাল হয়ে যেত সাফিয়ার। সাফিয়াকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে চুগতাই বলতেন, মহল্লার নারীদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়। অভিজ্ঞতার একটা দাম তো আছে!

তখন মান্টো বলতেন, সাফিয়া তো একেবারেই বোকা, ও শিল্পসাহিত্যের কিচ্ছু বোঝে না। উপরন্তু চুগতাই যা লিখতেন সেটাও পছন্দ করতেন না সাফিয়া। তো এমন নারীর সাথে চুগতাইয়ের আলাপ করতে খারাপ লাগে না? এমন চোখা কথার থোরাই পাত্তা দিতেন চুগতাই! বরং সাফিয়ার সঙ্গে গপ্পো করতে তার ভালোই লাগতো। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, মান্টোকে মন থেকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসতেন চুগতাই। যখনই পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করার কথা বলে মান্টোর বাসায় এসেছেন, তখনই সেটা পাঁচ ঘণ্টার তর্ক-বিতর্ক-আড্ডায় পরিণত হতো। সাহিত্য থেকে দর্শন, সেখান থেকে গৃহস্থালির নানা বিষয়। এসব আলাপ মাঝে মাঝে তিক্ততায় রূপ নিতো। মান্টো কখনো খেপেটেপে ঘর থেকেই বেরিয়ে যেতেন। শহীদ চুগতাইকেই ধমকাতেন। বলতেন, দেখো আমার বন্ধুর সঙ্গে তুমি এত নিষ্ঠুর আচরণ করছো কেন? তোমার জন্য ও রাগ করে বেরিয়ে গেছে, আর হয়তো সহজে ফিরবে না। ওর সাথে দ্বিতীয়বার দেখা করারও আর উপায় রইলো না। মান্টো খুব ঠোঁটকাটা। এখন ও যদি উল্টোসিধে কিছু বলে বসে, আমাদের বন্ধুত্বটাই ভেঙে যাবে।

চুগতাইও ভাবতেন, তাই তো! একটু বেশিই বোধহয় কঠিন কথা বলে ফেলেছে। এতে স্বামী শহীদের সঙ্গে মান্টোর বন্ধুত্ব ভেঙে যেতে পারে। আর মান্টোর চেয়েও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠা সাফিয়ার সাথেও বুঝি আর দেখাসাক্ষাৎ হবে না। কিন্তু না, মেঘ সরে গিয়ে ঠিকঠিকই সূর্য দেখা দিতো। দেখা গেলো সকালে তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছে, ওইদিন বিকেলে যদি আবার দেখা হতো, মান্টো এমনভাবে উষ্ণ সংবর্ধনা জানিয়ে কথা বলতেন, যেন কিছুই হয়নি সকালে। দুজনেই বেশ ভদ্র ও মার্জিত রুচির পরিচয় দিয়ে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে ক্লান্তি চলে আসতো। দুজনেই বুঝতে পারতেন বেশিক্ষণ এই ভদ্রতার অভিনয় তারা করতে পারছেন না। অতএব কোনো একটা বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য হতে যতটুকু দেরি, কিন্তু একে অপরকে আক্রমণ করে কথা বলতে একটুও দেরি হতো না। চুগতাই এটাকে মনে করতেন একে অপরের সঙ্গে বুদ্ধি ঝালাই করে নেয়ার এক অনুশীলন। মাথা নাকি পরিষ্কার হয়ে যেত এসব বাহাসের পর! যদিও লোকে খেপাতো। নানা কথা বলতো। কিচ্ছু যায় আসেনি তাতে। যতই লড়াই চলুক, তারা ভালো বন্ধু, এটাই সত্য। চুগতাই বলছেন, তারা তর্ক করতেন, কারণ তারা তর্ক করতে ভালোবাসতেন, এই বাহাস অন্যদের বিনোদন দেয়ার জন্য করতেন না।

মান্টো তর্ক করতে ভালোবাসতেন। মান্টো প্রশংসা শুনতেও ভালোবাসতেন। তবে এই প্রশংসা শুধু একা একা উপভোগ করতেন না। পাশে যদি ইসমত চুগতাই থাকতেন তাহলে তার প্রশংসাও করতেন খোলা মনে। এবং সেটার মাত্রাও এতটা হয়ে যেত যে, শুনলে মনে হতো মান্টো আর চুগতাইয়ের চেয়ে ভালো লেখক বুঝি এই গোটা ভারতে নেই। মান্টো প্রায়ই কৃষণ চন্দর আর দেবেন্দর সত্যরতির কঠোর সমালোচনা করতেন। আর কেউ যদি তার সামনে ওই দুজনের প্রশংসা করতো তাহলে রেগেমেগে চোখ লাল করে ফেলতেন মান্টো।

চুগতাই মান্টোকে বলতেন, আপনি তো আর সমালোচক নন, কাজেই আপনার সমালোচনাও গ্রহণযোগ্য নয়। তখন সমালোচকদেরও এক হাত নিতেন মান্টো। বলতেন, এরা যা তা লেখে। বলে একটা, লেখে ঠিক উল্টোটা। এই সমালোচকরা আমার গল্পে আপত্তি জানায়, আবার গোপনে গোপনে ঠিকই পড়ে। সেসব গল্প থেকে শেখার বদলে সুড়সুড়ি খোঁজে, তারপর অপরাধ বোধে ভোগে। এই অপরাধ বোধ দূর করতে এরপর এরা যা ইচ্ছা তাই লেখে।

মান্টো গল্প লিখে, চুগতাইয়ের মতোই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। দুই পর্বে তিনবার করে মোট ছয়বার তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। দেশভাগের আগে ভারতে ‘ধুয়ান’, ‘বু’ আর ‘কালি সালওয়ার’ এই তিনটি গল্পের জন্য। আর ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানে ‘খোলদো’, ‘ঠান্ডা গোশত’ ও ‘উপার নিচে ডারমিয়াঁ’ এই তিন গল্পের জন্য। একটি মামলায় তাকে জরিমানাও গুনতে হয়েছিল। বিরক্ত হয়ে মান্টো বলেছিলেন, তিনি গল্প লেখক, পর্নোগ্রাফার নন। কে শোনে কার কথা?

দেশভাগের পরপর মান্টো ও চুগতাই দুজনই ভারতীয় চলচ্চিত্রে কাজ করতে শুরু করেন পুরোদমে। সেসময় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। এখান সেখান থেকে দাঙ্গার খবর আসতে থাকে তাদের কানে। মান্টোর পরিবার থেকে চাপ আসে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার জন্য। ইসমতকেও পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা বলেন মান্টো। তখন চুগতাইকে মান্টো বলতেন, পাকিস্তানেই তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ওখানে যারা বড় বড় অট্টালিকা ফেলে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের সেসব বাসস্থান তারা পাবেন। তাদের উন্নতি হবে তরতর করে।

ঠিক এখানেই মান্টোর সঙ্গে ঐক্যের সুর কেটে যায় চুগতাইয়ের। ছন্দপতন ঘটে বন্ধুত্বের। তিনি লিখছেন, তখন আমি অনুভব করলাম মান্টো কি ভীরু ছিলেন। তিনি যেকোনো মূল্যে নিজের জান বাঁচাতে চাইছেন। কয়েক প্রজন্ম ধরে গড়ে তোলা অন্যের সম্পদ দখল করে তিনি নিজে বড়লোক হতে চাইছেন। তখন থেকে আমি তাকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। একদিন তিনি পাকিস্তানের জন্য দেশ ছাড়লেন। আমার সাথে দেখা না করেই এমনকি কোনো কথা বলা ছাড়াই।

চুগতাইয়ের কথা হলো, মানুষের খারাপ দিন যায়, ভালো দিন আসে। খারাপ দিন এসে ছিল বলে তিনি দেশত্যাগ করেননি। মান্টো জন্মভূমি ছেড়েছিলেন বলে মনোক্ষুণœ হন চুগতাই। তাই মান্টোর পাঠানো চিঠিগুলো তিনি ছিড়ে ফেলেন। পরে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি ঠিকই খোঁজখবর নিতেন মান্টোর। পাকিস্তান অনেক লোক আসতো ভারতে, তাদের কাছ থেকে জানতে পারতেন আগের বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছে মান্টোকে, নতুন পাওয়া বাড়িটাও খারাপ নয়। দ্বিতীয় কন্যার পিতা হয়েছেন মান্টো, এর পরের বছর আরো একটি কন্যা সন্তান। এটাও জানা গেলো গল্প লিখে সাজাও পেয়েছেন তিনি। চুগতাই দুঃখ করে বলছেন, সে সময় মান্টোর পক্ষে পাকিস্তানে কেউ টু-শব্দটি উচ্চারণ করেননি। বরং খুশিই হয়েছে তারা, মান্টোর ‘উচিত শিক্ষা’ হয়েছে বলে।

একদিন চুগতাই শুনতে পেলেন, মাথায় গ-গোল দেখা দিয়েছে মান্টোর। তাকে পাগলাগারদে রেখে এসেছে পরিবারের লোকজন। এরপর একদিন আবারো মান্টোর কাছ থেকে চিঠি এলো। একেবারে স্বাভাবিক মানুষের চিঠি। তিনি লিখছেন, আমি একদম ঠিক আছি। খুব ভালো হয় আপনি যদি মুখার্জির অফিসগুলোর একটি থেকে আমাকে বম্বে আসতে বলেন।

মুখার্জি বলতে মান্টো শশধর মুখোপাধ্যায়কে বুঝিয়েছেন। এই শশধর ছিলেন ফিল্মিস্তান স্টুডিওর একজন কর্ণধার। এই স্টুডিওতেই মান্টো কাজ করতেন দেশভাগের আগে। মান্টো এই স্টুডিও থেকেই আমন্ত্রণ প্রত্যাশী ছিলেন। সেটাই লিখে জানিয়েছিলেন চুগতাইকে। এরপর দীর্ঘদিন চুগতাইয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল না মান্টোর। পাকিস্তান থেকে যারা আসতেন তারা সকলেই মান্টোর খবর আনতেন। খারাপ খবরই আসতো বেশি। যেমনÑ মান্টো মদের নেশায় ডুবে গেছেন, এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে তিনি ঋণ করেননি। পত্রিকার লোকজন বসে থেকে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে নগদ অর্থ দিতেন। কারণ অগ্রিম টাকা দিলে মান্টো তা খরচ করে ফেলতেন।

মান্টোর কাছ থেকে আসা শেষ চিঠিতে অনুরোধ ছিল, যেন চুগতাই তাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এটা দেখে মনের অজান্তেই চুগতাই বলে ফেলেছিলেন ‘অশুভ’ কথা: লিখবো আপনার মৃত্যুর পর। সেটাই সত্যি হলো। চুগতাই যখন ‘আমার দোস্ত, আমার দুশমন’ লিখছেন তখন মান্টো মৃত। মান্টোর অকাল প্রয়াণে কি আমারও হাত আছে? এই প্রশ্নটাই মনের কোনে জেগে ওঠে চুগতাইয়ের। অদৃশ্য রক্তের ধারা চুগতাই যেন প্রত্যক্ষ করেন নিজের হাতে। মান্টোর অসময়ে চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি চুগতাই। একটা অপরাধ বোধ কাজ করতো তার ভেতর। যে দুনিয়ায় তিনি বেঁচে আছেন, সে দুনিয়ায় মান্টো বেঁচে নেই বলেই কি এই অনুভূতি হতো? আজ হয়তো মান্টোর সময় এসেছে। কাল তার আসবে। ‘সেদিন অন্য লোকেরাও শোক করবে। সভার আয়োজন করবে চাঁদা তুলে, এরপর সময়ের অভাবে আর আসতেই পারবে না লোকজন। সময় অতিবাহিত হবে, দুঃখের বোঝা হাল্কা হবে। এরপর সকলেই সব ভুলে যাবে।’

ইসমত চুগতাই মারা যান ১৯৯১ সালের ২৪ অক্টোবর, মুম্বাইতে। তিনি বেঁচেছিলেন ৭৬ বছর পর্যন্ত। ১৯১৫ সালের ২১ আগস্ট উত্তর প্রদেশে জন্ম নেয়া এই আকৈশোর বিদ্রোহী নারী ছিলেন প্রগতিশীল শিবিরের ‘ইসলাহ পসন্দ’। চুগতাই যে গভীরতা নিয়ে মান্টোকে বুঝতে পেরেছিলেন, যে জায়গায় স্থান দিয়েছিলেন, দেয়াটাই স্বাভাবিক, যেহেতু দুজনই সমাজের অচলায়তনকে ভাঙার পণ করেছিলেন, সেই বিশ্বাস, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সবটাই ফিকে হয়ে যায় দেশভাগের পর মান্টোর দেশত্যাগের সিদ্ধান্তে। চুগতাই পছন্দ করেননি মান্টো অন্যের জমানো সম্পত্তির ওপর লোভ করুক। চুগতাই চেয়েছিলেন মান্টো যেন দেশে থেকেই সাহিত্যচর্চা করেন। অবশ্য তাতে যে খুব ফারাক পড়তো তাও নয়, কারণ পাকিস্তান যাওয়ার আগেও তো লেখালেখি নিয়ে বৈরী পরিস্থিতি মুখে পড়তে হয়েছিল মান্টোকে।

মান্টো যেমন সাধারণ মানুষের মনের কথা তর্জমা করে গল্পে রূপ দিতেন, চুগতাইও তাই, তিনি কখনো সাহিত্যের ভাষায় গল্প লেখেননি, সবসময় সাধারণের ভাষাতেই, সাধারণের কথা বয়ান করেছেন। এ কারণেই এই দুজন অমর স্থান পেয়েছেন সাহিত্যে। অমর হয়েছে তাদের বন্ধুত্বও।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :