বইপত্র

মুনতাসীর মামুনের ‘জয় বাংলা’ উপন্যাস

ধ্রুব এষ
 | প্রকাশিত : ২৫ আগস্ট ২০১৮, ০৮:৫৬

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস। লিখেছেন অনেকে, লিখছেন অনেকে। সব লেখা আমি পড়েছি তা না, যে কটা পড়েছি, বেশির ভাগই আমার মনে হয়েছে ফর্মুলা লেখা। এটা অবশ্য আমার পঠন-পাঠনের দুর্বলতাও হতে পারে। ভালো লেখাগুলো হয়তো আমি পাইনি বা জোগাড় করতে পারিনি। পেলে নিশ্চয় পড়ব। আপাতত যা পড়েছি তার প্রেক্ষিতে বলি। অধিকাংশই ফর্মুলা লেখা। সহজ ফর্মুলা। গল্পে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা থাকবে গল্পের শেষে যে শহীদ হয়ে যাবে। অধিকাংশ লেখক এই কাজ করেছেন। কেন? যুদ্ধে গিয়ে শুধু শহীদই হতে হবে কেন কিশোর যোদ্ধাদের? নাকি হয়েছে? যুদ্ধ জয় করে কোনো কিশোর ফিরেনি? হাতের কাছের উদাহরণ দিতে পারি একটা। আমাদের একজন প্রকাশকই সক্রিয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বিদ্যাপ্রকাশের প্রকাশক খোকা ভাই, মজিবর রহমান খোকা। আরও অনেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, দেশের নানা অঞ্চলে তারা আছেন এখনো। তাদের এত কম উপস্থিতি কেন আমাদের দেশের কিশোর সাহিত্যে? বিশেষ করে গল্প- উপন্যাসে? দেশ স্বাধীন করে কিশোর তরুণ কত মুক্তিযোদ্ধা ঘরে ফিরেছেন, তাদের নিয়ে মনে হয় আরও অনেক লেখা দরকার আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য।

আঙ্গিকেও একই ছলচাতুরী। ফর্মুলা। গল্প লিখে উপন্যাস বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই উপন্যাসের কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে আবার গ্রামের ছেলেদের সর্দার হতেই হবে, না হলে রাস্তার ছেলেদের লিডার। হায়রে ফর্মুলা! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে লেখার কিছুই কি নেই শিশু-কিশোরদের জন্য?

আফসোসের কথা যাক। ‘জয় বাংলা’র কথা বলি। ‘জয় বাংলা’ মুনতাসীর মামুনের উপন্যাস। লিখেছেন কিশোর-তরুণদের জন্য। সুবর্ণ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সুবর্ণ প্রকাশিত মুনতাসীর মামুনের কিশোর সমগ্র, ২য় খ-েও অন্তর্ভুক্তি আছে।

গবেষক প্রাবন্ধিক মুনতাসীর মামুন। মুক্তিযুদ্ধ এবং ঢাকার ইতিহাস নিয়ে যেসব কাজ করেছেন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এহেন লেখক যখন ‘জয় বাংলা’ লিখেন... না, গবেষক প্রাবন্ধিক মুনতাসীর মামুন না ‘জয় বাংলা’ লিখেছেন আমাদের ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’-এর লেখক মুনতাসীর মামুন।

মফস্বলের ছেলে, মফস্বলের ইশকুলে-কলেজে পড়েছি। সম্ভবত তখন পড়ি এইটে। মৃদুলের বড় ভাই মিন্টু মামা কবি। জীয়ন কুমার দাস। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ঢাকায় গেলেই বই নিয়ে আসে। নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, শামসুর রাহমানের কবিতার বই। সেবার ছোটদের দুটো বই আনল। শাহরিয়ার কবিরের ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ এবং মুনতাসীর মামুনের ‘দীপ দ্বীপান্তর’। রফা হলো মৃদুল প্রথম ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় পড়বে। আমি ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’ পড়ব। আমাদের জগৎ তখন রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ শাসিত। তার বাইরের বইও পড়ি। এক রাতে ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’ নিয়ে গেল আর এক জগতে। দস্যু সিরিজের ফ্যান্টাসি না, এ আরেক রকমের রোমাঞ্চ!

পরদিন আমি ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ এবং মৃদুল পড়ল, ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’। বিকালে আমাদের নদীর পারে বসে আমি আর মৃদুল ঠিক করলাম, নুলিয়াছড়িতে নেলী খালার মোটেল দেখতে যাব আমরা কখনো এবং টাসমানিয়া যাব কখনো, অজানা দ্বীপের রহস্যময় বেহালাবাদকের বেহালা শুনব।

এখন আমার একটা অনুযোগ। হালে আমাদের কিশোর সাহিত্যের এমন ম্যাড়ম্যাড়ে অবস্থা কেন? পাঠক হিসেবে এজন্য আমি সবসময়ই দায়ী করি তিনজন লেখককে। তারা হলেন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন এবং আলী ইমাম। ধারাবাহিকভাবে তিনজনের একজনও কিশোর সাহিত্যের সঙ্গে থাকলেন না। এত বছরে তাদের মতো করে একটা লেখাও আর লিখল না কেউ। শাহরিয়ার কবির এবং মুনতাসীর মামুন ব্যাপৃত হলেন অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে, ঠিক আছে। আলী ইমাম পড়লেন বিজ্ঞান-লেখা নিয়ে। পপুলার সায়েন্স। দেশে বিজ্ঞান-লেখার লোকের অভাব পড়েছিল আর কি!

যাক, এসব আফসোসের জায়গা না এটা। ‘জয় বাংলা’র কথা বলছিলাম, বলি। ‘জয় বাংলা’ উপন্যাস লিখেছেন ‘দ্বীপ-দ্বীপান্তর’-এর লেখক মুনতাসীর মামুন। রোমাঞ্চ কাহিনি না মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিশোর উপন্যাস। পড়া শেষ করে মনে হলো কী, রোমাঞ্চ কাহিনি না কেন বলি? এ তো আশ্চর্য এক রোমাঞ্চ কাহিনিও। সংগ্রাম এবং বিজয়ের রোমাঞ্চ কাহিনি।

‘জয় বাংলা’ উপন্যাস শুরু হয়েছে খুব সাধারণ একটা বাক্য দিয়ে, ‘এই যে কবি সাহেব, ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছেন?’

আর কিছু বলব না। কোনো বই পড়ে ভালো লাগলে আমি বইটা পড়তে বলি পরিচিতজনদের। তাদের গল্পের কিছু বলি না। কেউ পড়ে, কেউ পড়ে না। যারা পড়ে তাদের সঙ্গে তখন পাঠ-অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করি। এখানে ‘জয় বাংলা’র কথা যেহেতু আমি পাঠক হিসেবে লিখছি, গল্পের আর কিছু বলব না। আবার একটা দুটো বিষয় ‘লিক’ করার লোভও সংবরণ করতে পারছি না। বলেই ফেলি। শাহরিয়ার কবির, আলী ইমামও আছেন এই উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে। বঙ্গবন্ধু আছেন, ভাসানী আছেন। আর আছে সংগ্রামী মহাজনতা। কাহিনির সঙ্গে বহমান ইতিহাস। ঝুঁকি থাকে এই ধরনের লেখায়। আনাড়ি হাতে পড়লে এই ‘জয় বাংলা’ই ইতিহাসের পাঠ্যবই হয়ে যেতে পারত। তা হয়নি। যদিও ঔপন্যাসিক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে এখানে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনও দারুণভাবে উপস্থিত। সেটা কাহিনির প্রয়োজনেই।

নির্লোভ, নির্মোহ বর্ণনা, টানটান। গল্প টেনে-হিঁচড়ে উপন্যাস বানানো হয়নি, উপন্যাসই লেখা হয়েছে। নামপত্র এবং ভূমিকা বাদ দিলেন, অলঙ্করণসহ ১৪৮ পৃষ্ঠার আখ্যান। আরে! কামালের কথা তো বলাই হয়নি। উপন্যাসের কামাল। শাহরিয়ার কবির, আলী ইমামের বন্ধু। এই কামাল কে?

পড়ে পাঠক কিছু আন্দাজ করতে পারবেন। সেই আন্দাজ সত্যি হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। আমিও আন্দাজ করেছি। কে বলব? না।

পাঠকের কিছু অধিকার আছে। মুগ্ধ পাঠক সনদ দিতে পারে লেখককে! তাতে বেয়াদবি কিছু হয় না। মুনতাসীর মামুনের ‘জয় বাংলা’ পড়ে আমার হায় আফসোস মিটেছে অনেকটাই। পড়তে চাই মুক্তিযুদ্ধের এরকম আখ্যানই।

ইতিহাসের, সংগ্রামের এবং যুদ্ধজয়ের গল্প লিখেছেন মুনতাসীর মামুন ‘জয় বাংলা’য়। বানোয়াট মনে হয় না একটা শব্দও। লেখকের লেখার সার্থকতা নিশ্চয়ই এই বিশ্বাসযোগ্যতাতেই।

‘জয় বাংলা’ উপন্যাসের জন্য আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ থাকব মুনতাসীর মামুনের কাছে। কিশোর তরুণরা অনেক পড়ুক এই বইটা।

মুনতাসীর মামুনের কিশোর সমগ্র ৫ম খ-ের ভূমিকা থেকে উঠিয়ে দিচ্ছি শেষান্তে, ‘আমার (মুনতাসীর মামুনের) বন্ধু আহমেদ মাহফুজুল হক আমার অনেক বইয়ের প্রকাশক। তিনি মনে করেন নিয়মিত আমাদের ছোটদের জন্য লিখে যাওয়া উচিত।’

শ্রদ্ধেয় মুনতাসীর মামুনের প্রতি সবিনয় নিবেদন, আমরাও তাই মনে করি।

(ঢাকাটাইমস/২৫আগস্ট/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :