অনুবাদ গল্প

উল্কি

মূল: সিলভিয়া প্লাথ অনুবাদ: অস্ট্রিক আর্যু
 | প্রকাশিত : ২৫ আগস্ট ২০১৮, ১০:০৫

ম্যাডিগান মোড়ে বেশ কয়েকটা উল্কি আঁকার দোকান আছে। দোকানগুলোর মধ্যে কারমির দোকানটা আলাদা। উল্কি আঁকায় সে এক জাতশিল্পী। পাতি মাস্তান, ডক শ্রমিক, পর্যটক জুটি, এমন সব পাবলিক এসে ঢোকে কারমির ওখানে। দোকানের একমাত্র জানালার রোয়াকে রাখা এক পাত্র বিয়ারের জন্য সে হাত বাড়ায়। প্রতিবারই কারমি এইভাবে শুরু করেÑ ‘তোমার একটা স্বপ্ন আছে’ বলে, তারপরপরই বলবে ‘কোনো কথা নয়, করে নাও, মনটা যা চায়। কুত্তা, শিয়াল, ঘোড়া, সিংহÑযা খুশি। মেয়েদের জন্য আছে প্রজাপতি, পাখি, শিশুর মুখ অথবা চোখের কোনায় অশ্রুধারা বা যেকোনো ধরনের গোলাপ- বড়, ছোট, কুঁড়ি, প্রস্ফুটিত, নাম খোদাইসহ গোলাপ অথবা কাঁটাসহ। পাতি মাস্তানদের জন্য রয়েছে সাপ ও ড্রাগন। আরও বলব? চুনি-স্তন অথবা খোলা বুকে, যা তোমার মন চায়, সবই করে নিতে পার। আর গোটা পিঠটা যদি দিতে পার, তবে ওখানে ক্রুশবিদ্ধ যিশুরও ঠাঁই হয়ে যাবে।’

কারমির কামরার তিন দেয়ালে, সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত আঁকা বিশাল চিত্রগুলো বাইরে থেকে দেখা যায়।

‘ওই ময়ূরগুলোকে দেখ, কি অদ্ভুত সুন্দর!’

‘ধূর, উল্কি আঁকার জন্য খরচ করার কোনো মানে হয়। জীবনে একবারই ওটা করেছিলাম আমি। একটা অজগর আঁকিয়েছিলাম বাহুতে।’

‘একটা হৃদয় চাও না তুমি? বলবো ওকে কোথায় আঁকবে সেটা?’

কারমির এই উল্কি আঁকার দোকান নিয়ে অনেক কিছুই লেখা যাবে। কিন্তু ছোট্ট এই শহরের আশ্চর্য মানুষটার বিষয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। কারমির চোখ দুটো যেন সমুদ্রের মতো গভীর নীল, আর উদার আকাশের মতো ।

‘ষোল বছর ধরে এ কাজটা করছি’ ছবির বইয়ের দিকে ঝুঁকে বলে কারমি ‘বলা যায় এখনো শিখছি। আমার প্রথম কাজ ছিল যুদ্ধের সময় সৈনিকদের শরীরে সংখ্যা লেখা।’

‘ওরা কেউ কি ভয় পেত না?’

‘তা তো অবশ্যই, কেউ তো পাইতই। আবার অনেকে ফিরাও আইত। একদিন ওই রকম দু’জন আইসা উসখুস করা শুরু করে। ওদের কইলাম, তোমরা তো মিয়া হেইদিনও আইছিলা, সমস্যা কি, কী করাইবা?’

‘কী করাতে চাই তা কোনো সমস্যা না, কোথায় চাই সেটাই...’

‘ঠিক আছে, তাইলে আমার উপর ছাইড়া দেও’ আমি কই, ‘একজন ডাক্তারের মতো ভাবতে পারো আমারে, কত শত মেয়েমানুষও ঘেঁটেছি, তাতে কি হইছে?’ ‘ঠিক আছে, আমি তিনটা গোলাপ চাই।’ ওদের একজন বলে, ‘একটা পেটে, বাকি দুটো আমার বন্দুকের কাঠের দুপাশে।’

‘বড় না ছোট?’

‘ওই যে ওগুলোর মতো।’

ওদের ইচ্ছে মতো কাজটা করি।

একটার পিছে একটা ধোঁয়ার রিং তৈরি করে ঘরময় ছড়িয়ে দেয় কারমি। অলস সময় কাটায় ক্ষুদে টমোলিলোকে নিয়ে। আমার বন্ধু নেড ও আমি যোগ দেই ওদের সঙ্গে।

‘একটা ফালতু নিয়ম জানতে চাও?’ ও বলে, ‘তোমার যেকোনো জায়গায় উল্কি এঁকে দিতে পারি, সব খানে, কিন্তু মুখ, হাত ও পায়ের পাতায় আঁকা যাবে না।’

‘এটা কি সরকারি আইন?’ ‘তাই।’

‘একটা বাজে আইন। গণতন্ত্রে এমন আইন থাকে কেমনে। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কোনো নারী যদি হাতের উল্টোপিঠে একটা গোলাপ আঁকতে চায়, আমার মনে হয়...

‘ওকে তাই করতে দেয়া উচিত’ কিছুটা উত্তেজিতভাবে বলে কারমি।

একজন নাবিক পনেরো ডলারে একটা ঈগল আঁকিয়ে নেয় ওর বাহুতে। শেষে আসে এক পিচ্চি। সে এক ডলারে নাম লিখিয়ে নেয় ওর কব্জির উল্টো পিঠে। এইভাবে ভালোই যাচ্ছিল দিনটা। উল্কি আঁকার ছবি ঘাঁটতে ঘাঁটতে কারমি বলে, ‘প্রজাপতির ছবি আঁকিয়ে নিতে মেয়েরা খুব আনন্দ পায়।’

‘কিছু কিছু খেপাটে প্রজাপতি আছে, যা কেউ এঁকে দিতে চাইবে না।’ বলতে বলতে নেড আমার তলপেটের দিকে তাকায়। ‘কি ধরনের প্রজাপতি, সেটা কোনো বিষয় না। কথা হচ্ছে, কোথায় আঁকা হচ্ছে ওটা। প্রতি উরুর সামনের দিকে একটা করে ডানা। মনে হবে যেন ফুলে বসা একটা প্রজাপতি কীভাবে ওর ডানায় হিল্লোল তোলে। একটা নারীর শরীরও ওরকম হিল্লোলের ভেতর...’

একটু বেখেয়াল হয়ে পড়ি। ক্ষণিকের জন্য, বিশাল এক প্রজাপতির পাখার হিল্লোল অনুভব করি নিজের দুই উরুতে। সঙ্গে সঙ্গে ওটা ছেড়ে দেই। নিজের প্রতি এক ধরনের বিবমিষা এসে দ্রুত গ্রাস করে নেয় সব কিছু।

‘বেশিরভাগ মেয়েরা ঠিক ওই জায়গাটাতেই প্রজাপতি আঁকিয়ে নিতে চায়।’ বলতে থাকে কারমি, ‘মজার ব্যাপার কি জানো, কাজটা শেষ করার পর ওটার একটা ছবি কেউ ওঠাতে দেবে না। এমনকি কটিদেশের নিচের দিকটারও না। এইটা ভাইব না যে, এমনটা আমি চাই। ওদের ধারণা, ওখানে ওই ছবিটা দেখে দেশের সব পুরুষ ওদের চিনে ফেলবে।’

‘এসব কি কোনোভাবে স্ত্রীদের কাছে টানে?’ লজ্জা মেশানো সুরে জিজ্ঞেস করে টমোলিলো, ‘এটাকে একটা পারিবারিক বিষয় হিসেবে নিলেই হয়?’

‘নাহ্’ মাথা ঝাঁকায় কারমি, ওর চোখে একটা বেদনার ছাপ ফুটে ওঠে। সেই সাথে কণ্ঠস্বর ভারী ও আর্দ্র হয়ে ওঠে, ‘নাহ্, একটা সুই ফোটার শব্দও শুনতে চায় না লরা। এসব সে ঘৃণার চোখে দেখে। ও চায় ওর শরীর হবে জন্মদিনের মতো অলঙ্কারহীন।’

ওই তখন থেকেই আমার কল্পনায় ভেসে রইলো লরা। উল্কিতে সাজানো সারা শরীর। বুকের দুদিকে উড্ডীন ভঙ্গিতে একটা করে প্রজাপতি, পেছনটায় ফুটন্ত গোলাপ, পিঠজুড়ে ড্রাগন, পেটে নৌকাসহ সুদর্শন সিন্দাবাদ। গোটা শরীরে এক জীবনের সকল কল্পনাচিহ্ন।

চার পাশে সিগারেটের ধোঁয়ার কু-লীর ভেতর আমরা চারজন বসে আছি। এইসময় গাট্টাগোট্টা এক মহিলা প্রবেশ করে কারমির দোকানে। আমাদের কারো মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোয় না। ওর ঠিক পেছন-পেছন তেল-চিটচিটে চুলের হারামি-মার্কা চেহারার একজন পুরুষও ঢোকে। সোজাসুজি কারমির সামনে এসে মহিলাটি থামে। পুরুষটাও আমাদের পাছা দেখাইয়া জায়গা করে নেয়। কয়েকটা মুহূর্ত নীরবতার ভেতর কেটে যায় ‘এখানে...’ কাঁপা ও কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে কারমি, ‘আসার কি কারণ ঘটলো?’

মহিলার দিকে আরেকবার তাকিয়ে আস্তে করে উঠে যাই কারমির পাশ থেকে। লোকটা মনে হয় লরার ভাই, নয়তো বডিগার্ড, না হয় প্রাইভেট গোয়েন্দা। ততক্ষণে টমোলিলো ও নেড দরোজায় পৌঁছে গেছে।

‘আমাদের মনে হয় একটা ভোঁ দৌড় দেয়া উচিত’ ফিসফিসিয়ে কথাটা বলি আমি। ‘ওদেরকে সম্ভাষণ জানাও লরা’ আবেদন জানায় কারমি। ওর জন্য আমার একই সাথে দুঃখ আর লজ্জাও হয়। লরা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। আমাদের চলে যাওয়ার জন্য শান্তভাবে অপেক্ষা করে।

আমার কল্পনায় দুলতে থাকে ওর শরীর। শ্বেতপদ্মের মতো অলঙ্কারহীন। ঈগলের হাত থেকে মুক্ত একজন নানের শরীরের মতো। গোলাপের পাঁপড়ির মতো নির্ভার।

আমি যেন দেখতে পাচ্ছি কারমির দোকানের দেয়াল থেকে ছবির প্রাণীগুলো ব্যঙ্গ করছে ওর ভয়াল একাকিত্বে এবং ওই অলঙ্কারহীন মসৃণ শরীরটাকে।

(ঢাকাটাইমস/২৫আগস্ট/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :