স্মৃতিগদ্য

ইসমাইল আর প্রেমের কবিতা

ইরাজ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট ২০১৮, ০৯:৩৫

সে বসতো ক্লাসের পেছন দিকের একটা বেঞ্চে। বিশ^বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। আমিও ক্লাসে বরাবর ব্যাক বেঞ্চার ছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে খুব একটা কথা হতো না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকরা ক্লাসে ক্রমাগত অনুপস্থিতির কারণে আমাকে বিরল প্রজাতির প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাই মাঝে মাঝে ক্লাসে যেতাম। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে একটু আড়াল খুঁজে বসে পড়তাম। তখনই তাকে দেখি আমি। শেষ বেঞ্চের ধারে একা বসে থাকা একটি ছেলে। গায়ের রং কালো, মাথায় কোকড়া চুল, গালে দাড়ি। স্যার যখন ক্লাসে পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা করতেন আমার সেই সহপাঠীকে দেখতাম মাথা নিচু করে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটছে। যতদূর মনে পড়ে ওর নাম ছিল ইসমাইল।

শীতকাল পড়লো। ব্যাকবেঞ্চার ইসমাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে এলো ব্লু ডেনিমের চমৎকার একটা জ্যাকেট পরে। করিডোরে হঠাৎ দেখা। চোখে সানগ্লাস, ইসমাইল একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। এখানে বলে রাখি, ক্লাসে অথবা বাংলা বিভাগে ইসমাইলের কোনো বন্ধু ছিল না। সেদিন কী মনে করে ইসমাইল হাত তুললো আমাকে দেখে। আমাদের কথা শুরু হয়েছিল সেই চমৎকার জ্যাকেট প্রসঙ্গে। তারপর আলাপ গড়ালো লাইব্রেরির সামনে ছোট্ট চায়ের দোকান পর্যন্ত। ইসমাইল ছিল পুরান ঢাকার ছেলে। বাবার মশলার আড়ত আছে। বিশ^বিদ্যালয়ে কোনো বিভাগে ভর্তি হতে না পেরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ছে। বাংলা সাহিত্য বিষয়টা এমনিতেই বেশ কঠিন। মনের মধ্যে আগ্রহ না-থাকলে বিষয়টার ভেতরে প্রবেশ করা বেশ কঠিন। ইসমাইল সেই প্রথম আলাপে বলেছিল মাসুদ রানা ছাড়া অন্য বইপত্র পড়ার ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহও নেই। সহপাঠীর অসহায় অবস্থা দেখে বেশ মায়া হয়েছিল আমার সেদিন।

কবিতা লিখি তখন। মাথার মধ্যে একটাই ঘোর কাজ করে, কবি আবুল হাসানের মতো লিখতে হবে। কিছু কবিতা তখন ছাপা হয়েছে দৈনিক আর সাপ্তাহিক কাগজের সাহিত্য পাতায়। আমি অনেকটা পাখির মতো উড়ে বেড়াই ক্যাম্পাসে। নিজেকে জড়িয়ে ফেলি সাংবাদিকতা আর রাজনীতির সঙ্গেও। পড়াশোনা ছাড়া বাকি অনেক কাজ নিয়ে মহাব্যস্ত আমি। সেই ব্যস্ততার ফাঁকে দেখা হয় ইসমাইলের সঙ্গে। ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় সেই একা দাঁড়ানো। কখনো হেঁটে হেঁটে যায় টিএসসির দিকে। দূর থেকে হাসি বিনিময় হয়।

একদিন টিএসসিতে দুপুরবেলা বসে আছি। হঠাৎ পাশের চেয়ারে বসে ইসমাইল। মুখ শুকনো, চুল উশকো খুশকো। সেদিন হঠাৎ করেই আমাকে ভাত খাওয়ানোর প্রস্তাব দিলো। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। তখন টিএসসিতে সাত টাকায় এক ধরনের পোলাও নামক বস্তু আর মুরগির মাংস পাওয়া যেত। দুজনে খেলাম একসঙ্গে। ইসমাইলকে একটু অন্যমনস্ক দেখে সম্ভবত কারণটা জানতে চেয়েছিলাম। আমার প্রশ্নটা ও এড়িয়ে গিয়েছিল। খাবার শেষ করে বের হয়ে তখনকার দিনের দামি ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে আমার পকেটে গুঁজে দেয়। প্যাকেট ধরে তখন সিগারেট কিনি না। পকেটে তখন অত টাকাও থাকে না। খাই সস্তা স্টার সিগারেট। ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট দেখে আমি অবাক। মনে আছে, প্রথমে নিতে রাজি না হওয়ায় মন খারাপ করেছিল আমার সেই সহপাঠী। তারপর বলেছিল, ওর আসলে উপহার দেয়ার মতো বন্ধু নেই। তাই আমাকে দিতে চায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসমাইল নিজে সিগারেট খেতো না। ওর কথা শুনে সেদিন একটু থমকে গিয়েছিলাম। উপহার দেয়ার জন্য একজন মানুষ বন্ধু খুঁজে পাচ্ছে না! নিঃসঙ্গতার অনুভূতিটা সেদিন টের পেয়েছিলাম। তবে বয়স কম থাকায় পুরোটা হয়তো বোঝা সম্ভব হয়নি। এত বছর পরে ইসমাইলের সেই একাকীত্ব আমাকে এখনো নাড়া দেয়। সেই অদ্ভুত নিঃসঙ্গ ছেলেটি মাঝে মাঝে আমার কবিতা লেখার মধ্যে ফিরে আসে। ইসমাইলকে আমি প্রশ্ন করিনি তার সেই বন্ধুহীনতা নিয়ে। ও খুব নিঃশব্দে বিশ^বিদ্যালয়ে আসতো। প্রয়োজনীয় ক্লাস শেষ করে ফিরে চলে যেত। আমাদের সারা দিনের কলরোল, মিছিল, সেøাগান, আড্ডা কোনো কিছু তাকে দলে টানেনি।

মনে আছে, আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। ইসমাইল সবকটি পরীক্ষা দেয়নি। আসলে দিতে পারেনি। হঠাৎ একদিন ক্যাম্পাসে তার সঙ্গে দেখা। আমি অন্যদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ও পাশে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। তারপর এক সময় বলেছিল, আমার সঙ্গে ওর একটু জরুরি কথা আছে। আমার শোনার সময় হবে কি না? গেলাম ইসমাইলের সঙ্গে টিএসসি। ইসমাইল সেদিনও আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসেছিল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওর প্রস্তাব শুনলাম। ইসমাইল প্রেমে পড়েছে খালাতো বোনের সঙ্গে। তাকে মুগ্ধ করার জন্য সে কয়েকটা প্রেমের কবিতা উপহার দিতে চায়। আর আমিই হচ্ছি তার কাছ থেকে দেখা একমাত্র কবি; একমাত্র আমিই পারি তাকে উদ্ধার করতে। সেই করুণ এবং লজ্জিত মুখটা আমি আজো ভুলিনি। ইসমাইলের শর্ত ছিল, প্রেমিকা সেই খালাতো বোনকে সে জানাবে কবিতাগুলো তার নিজের লেখা। বেশ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলাম সেই প্রস্তাবে। ঝট করে আমিও রাজি।

কথামতো পরদিন সকালে ক্যাম্পাসে ইসমাইল এসেছিল কবিতা নিতে। আমিও রাত জেগে লেখা কয়েকটি কবিতা গুঁজে দিয়েছিলাম ওর পকেটে। আমি সত্যি সত্যি কয়েকটা কবিতা লিখে নিয়ে গেছি দেখে সেদিন জন্ম নিয়েই লাফঝাঁপ দেয়া বাছুরের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল ইসমাইল। আমার আজো মনে আছে, কবিতাগুলো টিএসসির একটা টেবিলে বশে বারকয়েক পড়েছিল। তারপর সলজ্জ ভঙ্গিতে একটু হেসে জানিয়েছিল, ও কবিতার কিছু বোঝে না। কিন্তু তারপরও খুব ভালো লেগেছে ওর কবিতাগুলো। আমাকে কবিতা লেখার পারিশ্রমিক হিসেবে আবারও এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে সেদিন বিদায় নিয়েছিল ইসমাইল। সেদিন কি ইসমাইলের জন্য আমার করুণা হয়েছিল? হয়েছিল কিছুটা। আমার মনে একটা প্রশ্ন বারবার ভেসে উঠছিল-ধার করে ভালোবাসা যায়?

ইসমাইল অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আর ভর্তি হয়নি। বাংলা সাহিত্যের সমুদ্রে ওর সাঁতার ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে বলেছিল, ওদের পরিবারে কেউ স্কুলের গন্ডি পার হয়নি। আর পড়াশোনার বিষয়টা আড়ত মালিক পরিবারের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। পরীক্ষায় পাস না করলেও ক্যাম্পাসে আসতো প্রায় নিয়মিত। আসতো আমার কাছে কবিতা নিতে। আমিও জানতে চাইতাম ওর প্রেমিকার খবর। ইসমাইল জানিয়েছিল, একদিন লালবাগের কেল্লায় বেড়াতে গিয়ে সেই মেয়েটিকে ও আমার কবিতা পড়ে শুনিয়েছে। মাঝে কয়েকদিন আর ক্যাম্পাসে আসেনি ইসমাইল। আমিও তখন নানা ধরনের ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে ভুলে গেছি ইসমাইলের কথা। হঠাৎ একদিন ইসমাইল এসে হাজির হাকিম ভাইয়ের চায়ের দোকানে। সেদিন ওর চেহারা দেখেই আমার মনে হয়েছিল দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইসমাইল জানিয়েছিল, সে তার প্রেমিকার সামনে মিথ্যার পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে। মেয়েটিকে জানিয়ে দিয়েছে কবিতা আসলে লিখি আমি। কারণ তার মনে হচ্ছিল মেয়েটি কবিতার প্রেমে পড়ে গেছে। সে কবিতা ভালোবাসে মানে আমাকেই ভালোবাসে। আমি চমকে উঠেছিলাম সেদিন ইসমাইলের কথায়। ভাবতেই পারিনি ইসমাইলের মতো একজন খুব সাধারণ যুবকের মনের মধ্যে এরকম একটি চিন্তা সাবমেরিনের মতো অতল থেকে জেগে উঠবে। ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। সেদিন বেশি কথা বলেনি ইসমাইল। জানিয়েছিল, মেয়েটির সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ভেঙে গেছে মিথ্যা কথা বলায়। নাটকের শেষ অঙ্কে ইসমাইলের আবারো নিঃসঙ্গতায় ফিরে যাওয়া।

বন্ধুহীন ইসমাইল। যার সামনে পুরান ঢাকায় বসে আড়ত পরিচালনা করা আর টাকা গোনা ছাড়া আর কোনো ভবিষ্যৎ খোলা নেই। হয়তো আজো নেই। সেদিন সে একটু কেঁদেও ছিল আমার সামনে। বারবার জানতে চেয়েছিল ও সঠিক কাজটা করেছে কি না। আমি ওকে সমর্থন দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ইসমাইলের আর দেখা হয়নি। আমিও খোঁজ করিনি এই শহরে ইসমাইলকে। হয়তো এই একবিংশ শতাব্দীতে ওর পাতা সংসারের বয়স বেড়েছে অনেক। ইসমাইল ভুলে গেছে সেই ভালোবাসার আখ্যান। কিন্তু আমার মনে রয়ে গেছে ইসমাইল নামের সেই যুবক। রয়ে গেছে তার একাকীত্ব, তার সত্যি কথা বলার সাহস, তার উপলব্ধি করার ক্ষমতা। মাঝে মাঝে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষ এভাবে রয়ে যায় মনের গভীরে। সমুদ্রের মতো মনও ফিরিয়ে দেয় তার স্মৃতি।

(ঢাকাটাইমস/২৬আগস্ট/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :