নির্বাচনের রাজনীতিতে কে কোথায়

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ৩১ আগস্ট ২০১৮, ০৯:০২

নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে এ বছরই হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, আসছে অক্টোবরেই তারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে। সে হিসাবে আর দেড়-দুই মাসের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে নির্বাচনি পরিস্থিতি। নির্বাচনে কোন কোন রাজনৈতিক দল প্রার্থী হবে, হলে কিভাবে হবে, সব দলের অংশ নেয়ার মতো পরিস্থিতি থাকবে কি নাÑ সেসবই স্পষ্ট হয়ে যাবে এই সময়ের মধ্যে।

তবে সময় পাল্টে যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগের বাস্তবতার সঙ্গে বর্তমানের মিল খুঁজতে যাওয়া যথাযথ হবে না। কারণ রাজনীতিতে শিওর সাকসেস বলে কোনো ফর্মুলা নেই। যে পদ্ধতি এখন কার্যকর হবে, সেটিই হয়তো দশ বছর পর বুমেরাং হয়ে নিজ গায়েই লাগবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে নিজের অস্ত্রে নিজেই ঘায়েল হয়েছে বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে যদি একতরফা নির্বাচন হিসাবে আখ্যায়িত করি, তাহলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের জন্য আরও বড় কোনো বিশেষণ ব্যবহার করতে হবে। কারণ এ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। ক্ষমতায় যাওয়া মহাজোটের প্রার্থীরা ওয়াকওভার পেয়ে গেছেন। এভাবে বিনাভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি নিয়েই গঠিত হয়েছে জাতীয় সংসদ, হয়েছে সরকার। এমন একটি সরকারই নির্বিঘেœ কাটিয়ে দিলো পাঁচটি বছর। এই যে ভোটারবিহীনভাবে নির্বাচিত একটা সরকারের পক্ষে পাঁচটি বছর ক্ষমতায় থাকতে পারা, তার পিছনে কি কেবলই বিএনপির আন্দোলন করতে না পারার ব্যর্থতাই কাজ করেছে?

আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী-সমর্থক মনে করেন, এরকম একটা সরকারের বিপরীতে বিরোধী দল হিসাবে যদি আওয়ামী লীগ থাকতো, ঠিকই তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে পারতো। এরকম দাবির পিছনে হয়তো কিছু যুক্তি আছে। কিন্তু আমার বিবেচনায়, বিরোধী দলের দুর্বলতা কিংবা সরকারের কঠোরতাই একমাত্র বিষয় নয়, এখানে ‘সময়’ একটা বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। আসলে সময় পাল্টে গেছে। আন্দোলন করতে হলে মানুষ লাগে, সেই মানুষের মনটা পাল্টে গেছে। মানুষ আর আগের মতো করে ভাবে না। ক্ষমতায় গিয়ে আপনি নিজের আখের গোছাবেন, বিদেশে টাকা পাচার করবেন, আর সাধারণ মানুষ আপনাকে ক্ষমতায় পৌঁছে দিতে নিজের বুকের রক্ত দেবে অকাতরেÑ সেই দিন এখন আর নেই। যদি ভোট দেয়ার সুযোগ আসে, মানুষ তাহলে তাদের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটাবে তাতে।

নির্বাচন যে আসন্নÑ সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই কারও। অথবা কেউ কেউ এমনও মনে করেন, নির্বাচন হোক বা না হোক আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা পরিবর্তন অবশ্যই হবে। পরিবর্তন অথবা পুনর্গঠনÑ কিছু একটা হবে। তবে যেটাই হোক, জনমতকে গুরুত্ব দিয়েই হতে হবে। ভোটকে বাইপাস করে কিছু ঘটানো সহজ হবে না। ২০১৪ সালের সেই ফর্মুলার বাস্তবায়ন এবার সহজ হবে না। বিএনপি তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলেই যে হবে না, সেটা যতটা সত্য, তার চেয়েও বেশি সত্য হচ্ছেÑ সময়ই পাল্টে গেছে। মানুষের চিন্তাও পাল্টে গেছে।

আমার কেন যেন মনে হয়, বিষয়টা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই তো কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে এ নিয়ে কথা বলতে শোনা গেল। তিনি স্পষ্টই বলে দিলেন, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে হলে এলাকায় যেতে হবে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের সুখ-দুঃখের কথা জানতে হবে। অর্থাৎ জনগণ যাদেরকে তাদের কাছের মানুষ মনে করবে, তাদেরকেই মনোনয়ন দেবে দল। কে কত বড় নেতা, সেটা বিবেচ্য নয়, বিবেচনা করা হবে এলাকায় কে সাধারণ মানুষের কত কাছের মানুষ, সেটা। নির্বাচনের আগে আগে দলীয়প্রধানের এমন বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, ক্ষমতায় থাকার পরও এই দলটি শর্টকাট পথে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে না, বরং উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস, তাই টিকে থাকতে হলে জনগণের মন জয় করেই থাকতে হবে।

প্রধান বিরোধীদল বিএনপির প্রস্তুতিটা এখনো কিছুটা ধোঁয়াশায় ঘেরা। তাদের স্ট্র্যাটেজি হয়তো তারা প্রকাশ করতে চাইছে না। তবে এতটুকু পরিষ্কার যে, ২০১৪ সালের ঘটনা থেকে তারা বেশ ভালোভাবেই শিক্ষা নিয়েছে। তাই ওই ভুল তারা আর দ্বিতীয়বার করবে না। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দাবি আর বক্তব্যের কথা যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে বিএনপির রাজনীতি এখনো আবর্তিত হচ্ছে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নেতাকর্মীদের উপর থেকে মামলা প্রত্যাহার এবং সর্বোপরি নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিকে কেন্দ্র করে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছেÑ এই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালেই দিয়েছিল বিএনপিকে। এমনকি তখন এমন কথাও বলেছিলÑ বিএনপি যে যে মন্ত্রণালয় চায় তাদেরকে তা দেয়া হবে। কিন্তু বিএনপি তখন অনড় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে। সেবার যেটা তারা গ্রহণ করেনি, এবার তারা উদ্বিগ্ন সেই অবহেলায় ফেলে দেয়া প্রস্তাবগুলো পাওয়া নিয়েই। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে কেউ কেউ বলেও দিয়েছেনÑ নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির থাকার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে সংসদে থাকা দলগুলোর মধ্যে থেকে। বিএনপি তো সংসদেই নেই!

তবে এসব রাজনৈতিক চালÑপাল্টা চালের মধ্যেও বিএনপির নির্বাচনি প্রস্তুতি কিন্তু ঠিকই চলছে। তারা মনে করে, একবার তারা জনগণের সামনে ভোটের জন্য যেতে পারলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তাদের এমনও ধারণাÑ বিএনপির কর্মী-সমর্থক হয়তো তেমন সক্রিয় নেই এখন, কিন্তু দেশজুড়ে তাদের রয়েছে বিপুল নীরব ভোটার। যারা আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করে, তাদের সামনে বিকল্প হিসাবে বিএনপি ছাড়া আর কেউ নেই। এরা হয়তো এমনিতে তেমন একটা সরব নয়, কিন্তু ভোটের সময় ঠিকই পাল্টে দেবে সব হিসাব-নিকাশ। এরই মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের সেই কৌশলের বাস্তবায়ন দেখেছে পর্যন্ত। সেখানে জামায়াত প্রার্থী শেষ পর্যন্ত লড়েছেন, কিন্তু ভোটের অঙ্কে কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে পারেনি। এমন একটা ফলাফলের পরও আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি যে জামায়াতকে ছাড়াই নির্বাচনি জোট করবে, তেমনটি মনে হয় না।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি মানসিকতাই অবশ্য এখন জোটনির্ভর হয়ে গেছে। বিগত নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সবাই কোনো না কোনো জোটের মধ্যে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বিশ দল, বাইশ দলÑ এভাবে জোটে দলের সংখ্যা বাড়াতে পারাকে সাফল্য মনে করে। সে কারণেই ধারণা করা যায়, এবারো হয়তো একাধিক নির্বাচনি জোট থাকবে। সংসদে বিরোধী দল হিসাবে তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ তো এরই মধ্যে বলেই দিয়েছেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে আলাদা হয়ে লড়বে। অর্থাৎ পুরাই সুবিধাবাদী অবস্থান। এখানে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নাই, মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতার অংশীদার হতে পারা। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জিতলে ক্ষমতার অংশ পাওয়া যাবে, বিএনপির অনুপস্থিতিতে বিরোধী দলে থাকলেও মন্ত্রিসভায় যে জায়গা পাওয়া যায়, সেটা তো এখনই দেখা যাচ্ছে।

জাতীয় পার্টির নেতাদের নিয়ে যত হাস্যকৌতুকই করা হোক না কেন, এটা কিন্তু সত্য যে, তাদের কিছু ভোট রয়েছে। কেবল উত্তরবঙ্গেই নয়, সারা দেশেই আছে। সে তুলনায় বাম দলগুলোর ভোটব্যাংকের অবস্থা কিন্তু খুবই করুণ। আলাদা নির্বাচন করলে, তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থীটিও যে জামানত হারাবে, সেটি বলার জন্য খুব একটা রাজনীতি বিশেষজ্ঞও হতে হয় না। আর জোটের মধ্যে থেকে নির্বাচন করলে দলের শীর্ষ ব্যক্তির অন্তত কোনো একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গত দুটি সরকারে সেরকম উদাহরণ দেখাও গেছে। আর কোনো সম্ভাবনা ছাড়াই মন্ত্রী হতে পারার মজা যে একবার পেয়েছে, সে যে সেটা আবারও পেতে চাইবে, এটাও তো স্বাভাবিক। কাজেই যেকোনো শর্তে এ দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।

এর বাইরে বি. চোধুরীর বিকল্প ধারা, ড. কামালের গণফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ কিংবা মান্নার নাগরিক ঐক্যÑ এরকম ছোট ছোট দল মিলে হয়তো নতুন কোনো জোট হতে পারে। এমনকি এর সঙ্গে আ স ম রবের জেএসডিও যুক্ত হতে পারে। এ রকম জোট অবশ্য গত কিছুদিন ধরেই হতে দেখা যাচ্ছে। একবার একটা হয়, পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে কিছু লেখালেখি হয়, তারপর আবার হারিয়ে যায়। কিছুদিন আগে হলো ‘যুক্তফ্রন্ট’। গত দু-তিন মাসে তার কোনো অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি জাতীয় রাজনীতিতে। তারপরও এসব দল থাকবে, জোট গড়বে, তবে নির্বাচনে এরা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না।

সব মিলিয়ে নির্বাচনটা কেমন হবে সেটা নির্ভর করবেÑ প্রথমত, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না তার উপর। তবে এখন পর্যন্ত যতদূর মনে হচ্ছে, যেকোনো বিনিময়েই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের ভূমিকা- এসবও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে আগামী দিনগুলোতে।

মাসুদ কামাল: লেখক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :