দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কি বৃদ্ধি পেয়েছে?

সাদ্দাম হোসেন
 | প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:২৬

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ৩০ আগস্ট ‘সেবাখাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সেবাপ্রদানকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান হতে সেবা গ্রহণকালে যে অসদাচরণ, হয়রানি, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালীর অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ, ঘুষ প্রভৃতির শিকার হন জরিপটিতে সেসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিজ্ঞতা বিবেচিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে রাজনীতি, প্রশাসন ও বেসরকারি খাতের প্রভাবশালীদের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থের অবৈধ লেনদেন অর্থাৎ বৃহৎ দুর্নীতিসমূহ এ জরিপের আওতাভুক্ত না থাকলেও সাধারণ মানুষ তথা সেবাগ্রহীতাদের তুলনামূলক ক্ষুদ্র দুর্নীতির যেসব অভিজ্ঞতা এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে এবং রাষ্ট্রের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সে বিবেচনায় জরিপটি সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের খানা জরিপে ৭০.৯ শতাংশ খানা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না’কারণটির কথা উল্লেখ করলেও এ বছর জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৮৯ শতাংশ খানা ঘুষ দেওয়ার পেছনে এ কারণটির কথা উল্লেখ করেছে। ঘুষ প্রদান ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে না- এমন মনোভাব পোষণকারী খানার হার প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধির তথ্য শুধু হতাশা ও উদ্বেগজনকই নয়, এটি আতঙ্কিত হবার মতো একটি ঘটনা। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সেবাগ্রহীতাদের আস্থা কোন পর্যায়ে নেমে আসলে একটি দেশের ৮৯ শতাংশ খানা এরকম ধারণা পোষণ করে, তা সহজেই অনুমেয়।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণের সময় দেশের ৬৬.৫ শতাংশ খানা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে, ২০১৫ সালে যার হার ছিল ৬৭.৮ শতাংশ। ২০১৫ সালের তুলনায় এ বছর দুর্নীতির শিকার খানার হার সামান্য কমেছে বলে মনে হলেও পরিসংখ্যানগতভাবে এই হ্রাস তাৎপর্যপূর্ণ নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ৪৯.৮ শতাংশ খানা সেবাগ্রহণকালে ঘুষ প্রদানে বাধ্য হয়েছে। ২০১৭ সালে খানা প্রতি বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের তুলনায় ১৩৯২ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫,৯৩০ টাকায় পৌঁছানোর তথ্য জরিপে উঠে এসেছে। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০,৬৮৮.৯ কোটি টাকা, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ৩.৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৫ শতাংশ। টিআইবির ২০১৫ সালের খানা জরিপে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ছিল ৮,৮২১.৮ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৭ সালে ১৮৬৭.১ কোটি টাকা বা ২১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সেবাখাতে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রকোপ বৃদ্ধির স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

জরিপে অন্তর্ভুক্ত সর্বাধিক সংখ্যক খানা ((৭২.৫ শতাংশ) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা দুর্নীতির শিকার হয়েছে বিধায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাঁদের ওপর অর্পিত, তাঁরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পাসপোর্ট খাত, যেখানে ৬৭.৩ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে যথাক্রমে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও বিচারিক সেবা খাত জরিপে চিহ্নিত হয়েছে। ভূমি সেবা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও উচ্চ মাত্রায় দুর্নীতির উপস্থিতির তথ্য জরিপে পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্নীতির কালো থাবা থেকে সমাজের কোনো ব্যক্তিই রেহাই পাচ্ছেন না। যিনি নিজে দুর্নীতি করছেন, তিনিও অন্যের দ্বারা দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। শিক্ষাবঞ্চিত, স্বাক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন, স্বল্পশিক্ষিত, মধ্যম পর্যায়ের শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত- সকল শ্রেণির মানুষকেই সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক সুবিধা ভোগ করার ক্ষেত্রে অর্থাৎ সেবা গ্রহণকালে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে।

সেবাগ্রহীতাদের পেশা বিবেচনায় কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন নিম্ন আয়ের পেশার মানুষকে যেমন দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে তেমনি চিকিৎসক, প্রকৌশলী , আইনজীবিসহ উচ্চ আয়ের পেশার মানুষকেও দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে। দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে কেউই মুক্ত নন। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ উচ্চ আয়ের মানুষের তুলনায় বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন এবং বেশি অর্থ ব্যয় করছেন বলে জরিপে তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি বৈষম্যের ওপর পুনর্বৈষম্য বলে মনে হয়।

বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের শিকার খানার হার বিবেচনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে জরিপে চিহ্নিত হলেও শুধু ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের শিকার খানার সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০১৭ সালে সেবা নিতে গিয়ে সড়ক পরিবহন খাতে সর্বাধিক খানা (৬৩.১ শতাংশ) ঘুষের শিকার হয়েছে। ঘুষের শিকার হওয়া খানার সংখ্যা বিবেচনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট সেবা চিহ্নিত হয়েছে এবং এ খাত দু’টিতে ঘুষের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ৬০.৭ শতাংশ ও ৫৯.৩ শতাংশ খানা। তবে খাতওয়ারী হিসেবে বিভিন্ন খাতে খানা প্রতি প্রদত্ত গড় ঘুষের পরিমাণ বিবেচনায় দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করছে গ্যাস খাত। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান পঞ্চম। ২০১৭ সালের খাতওয়ারী হিসেবে প্রতিটি খানা গ্যাস খাতে সেবাপ্রাপ্তির জন্য গড়ে ৩৩৮০৫ টাকা ঘুষ প্রদান করেছে। এছাড়া ২০১৭ সালে প্রতিটি খানা গড়ে বিচারিক সেবা খাতে ১৬৩১৪ টাকা, বিমা খাতে ১৪৮৬৫ টাকা, ভূমি সেবা খাতে ১১৪৫৮ টাকা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খাতে ৬৯৭২ টাকা ঘুষ দিয়েছে।

তবে এতসব নেতিবাচক দিকের পাশাপাশি জরিপে কিছু ইতিবাচক ও আশাজাগানিয়া তথ্যও উঠে এসেছে। যেমন, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া এবং অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ঘুষ দেওয়া খানার সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫ সালে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য ১২.৬ শতাংশ খানা ঘুষ প্রদান করলেও ২০১৭ সালে এ ধরনের খানার হার ৪.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আবার অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ২০১৫ সালে ৪.৪ শতাংশ খানা ঘুষ প্রদান করলেও ২০১৭ সালে এ ধরনের খানার হার ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

জরিপে উঠে আসা আরও একটি ইতিবাচক দিক হলো দেশের প্রবীণদের তুলনায় তরুণরা দুর্নীতির শিকার কম হচ্ছে। এর কারণ হতে পারে, তরুণরা কোন প্রতিবাদ ছাড়াই নীরবে দুর্নীতি মেনে নেয় না। তরুণরা দুর্নীতির প্রতিবাদ করার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। জরিপে ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী অংশগ্রহণকারীদের ৪৪.১ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হওয়ার বিপরীতে ১৭ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী অংশগ্রহণকারীদের ৩২.৬ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হওয়ার তথ্য আশাব্যঞ্চক এই অর্থে যে তরুণ সমাজই দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোর-তরুণদের সাম্প্রতিক সুশৃঙ্খল আন্দোলন তরুণ প্রজন্মের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আবার ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও সার্বিভাবে ঘুষের শিকার খানার হার এ বছর হ্রাস পেয়েছে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাতে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিভিন্ন খাতে সরকারের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, তদারকি বৃদ্ধি এবং স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন জরিপে চিহ্নিত হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ, তথ্যের উন্মুক্ততা, তদারকি কার্যক্রম, ডিজিটাইজড প্রক্রিয়ায় সেবা প্রদান প্রভৃতি ব্যবস্থা অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সকল সেবাখাতে এসব ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করা গেলে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দুর্নীতি দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য দূর করার পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছ। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ বা হ্রাসের কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। পাশাপাশি তদারকি ও নজরদারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিকারীদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করে দুর্নীতির অপরাধে শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীসহ সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর এ আন্দোলনে তরুণরা নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :