উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য কী?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৪৬ | প্রকাশিত : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৪৪

চীনের জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পবিত্র জন্মস্থান গোপালগঞ্জ জেলায় অবস্থিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আনিসুর রহমান তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, ‘উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন, প্রচলিত একাডেমিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন, গবেষণার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার আবহ আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃতির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের প্রয়োজন। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে গতিশীল, সময়োপযোগী, বিদ্যমান আইন পরিবর্তন-পরিবর্ধন, মানসম্মত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের অপরিহার্যতা সময়ের দাবি। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আরও বেশি সমৃদ্ধশালী হবে- এ প্রচেষ্টা আমাদের সবার থাকা দরকার’(সমকাল: ফেব্রুয়ারি ৭:২০১৮)।

বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণরত একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আনিসুর রহমান খুবই বাস্তবসম্মত, দূরদর্শী ও স্বাপ্নিক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু দেশের আমলাতন্ত্র কি শিক্ষক, গবেষক আনিসুর রহমানের মতো ভাবনা থেকেই উচ্চশিক্ষা কমিশনের কথা ভাবছে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওপর কলেজ শিক্ষকদের মতো নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যবস্থা হিসেবে আমলাতন্ত্রের ‘ব্রেইন চাইল্ড’ হিসেবে এই উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা হচ্ছে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে আলাদা করে বাংলাদেশের জন্ম যতগুলো কারণে দিয়েছিলেন তার অন্যতম কারণ এই আধিপত্যবাদী আমলাতন্ত্র। ব্রিটিশ আমলের আমলাতন্ত্র বিলোপকল্পে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। আবার পাকিস্তান আমলের আমলাতন্ত্র বিলোপকল্পে বাংলাদেশের জন্ম হয়। সবক্ষেত্রে এক বিশেষ শ্রেণির আমলাদের দৌরাত্ম আর আধিপত্য দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ কি উপনিবেশ আর পরাধীন যুগের আমলাতন্ত্র থেকে মুক্তি পেয়েছে? নাকি বাংলাদেশ দিন দিন আধিপত্যবাদী, সর্বগ্রাসী আমলাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান গর্ভে বিলীন হয়ে পড়ছে?

আনিসুর রহমানের লেখা থেকে জানা যায়, ‘২০১২ সালের ৩ মে প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন, উৎকর্ষ সাধন এবং বিস্তৃতির লক্ষ্যে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন-২০১২-এর খসড়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের মন্তব্যসহ মতামত দেয় ইউজিসি। ২০১৩ সালের ১০ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। নীতিগত অনুমোদনের জন্য খসড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপিত হলে সেটিকে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে (!) রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তরের বিষয়ে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল। অধীনস্থতা আর স্বায়ত্তশাসন একসঙ্গে চলে কি? তখন ইউজিসি বলেছিল, এই খসড়ায় কমিশনকে ক্ষমতায়িত করা হয়নি। উচ্চশিক্ষা কমিশন আইনের সর্বশেষ খসড়ায় বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেই কাজ করবে। কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্য ও সচিবের পদমর্যাদা সরকারই নির্ধারণ করবে। সরকারের অনুমোদনক্রমে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। ইউজিসির তৈরি খসড়ায় বলা হয়েছিল, কমিশন হবে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীনে। স্বাধীনভাবে এই কমিশন যেকোনো প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কমিশনের চেয়ারম্যান একজন পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন, পাঁচ সদস্য প্রতিমন্ত্রীর এবং কমিশনের সচিব সরকারের সচিবের মর্যাদা পাবেন।

দেশের উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নাম পরিবর্তন ও এর প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে 'উচ্চশিক্ষা কমিশন' গঠন করার প্রস্তাব দিয়ে একটি খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের পরে এটি পুরোপুরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতামুক্ত হবে। ফলে এটি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে। মন্ত্রণালয়ের একটি উইংয়ের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সম্ভব নয় বলে কমিশন মনে করে। কমিশন যে খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল, তা সংশোধন করে ১৩টি স্থানে 'সরকারের অনুমোদনক্রমে' বাক্যাংশ যোগ করা হয়েছে। ফলে কমিশনের যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। ইউজিসি নিজস্ব পদ সৃষ্টি, যোগ্যতা নির্ধারণ ও নিয়োগ- সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে; কিন্তু কমিশন গঠনের পর সে ক্ষমতাও থাকবে না। সিলেবাস কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ও তাদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। তখন উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ হবে আরও ভয়াবহ। ভেঙে পড়বে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অবকাঠামো।’ (সমকাল: ফেব্রুয়ারি ৭:২০১৮)।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিবেক আর বুদ্ধি-মেধার স্বাধীনতা দিয়ে ৭৩ এর অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ জুলাই সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ২০১৭’ প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ‘উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আর এই প্রকল্পের অর্থায়নে ৪২২টি রিসার্চ প্রজেক্ট দুটি টেকনোলজি ট্রান্সফার অফিস, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্চুয়াল ক্লাসরুম ছাড়াও ক্যাম্পাস নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গবেষণার প্রকৃত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এসব কিছু দেখার জন্যে মঞ্জুরি কমিশন রয়েছে। তবে, তা যে আকারে আছে তাতে এটা সম্ভব না। সে কারণে আমরা একটা উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করবো। তবে, যা কিছু হবে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথেই হবে।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে কি দেশের শীর্ষ আমলারা কাজ করছেন? উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় দেশের শীর্ষ আমলাদের ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু কমিশনের গঠনকাঠামোতে আমলাদের আধিপত্য কোনোভাবেই একটি মুক্ত ও প্রগতিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক হতে পারে না। আমলারা চলেন সুনির্দিষ্ট আমলাতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন মেনে। আর শিক্ষকতা আর গবেষণা সম্পূর্ণ ভিন্ন চেতনা ও পদ্ধতিনির্ভর কর্মপ্রণালী। ‘বস ইজ অলঅয়েজ রাইট’ জাতীয় ব্রিটিশ কলোনিয়াল মানসিকতা নিয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা চলে না। ভালো শিক্ষক ও গবেষক হতে হলে মন ও মগজের স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

এই কলাম যখন লিখছিলাম, তখন ইউজিসি থেকে পাঠানো একটি পরিপত্র হস্তগত হয় । পরিপত্রের ৯নং নির্দেশনায় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বাড়ি ভাড়া ঢাকা শহরের হারে আর দেয়া হবে না বলে বলা হয়েছে। খবর নিয়ে জানলাম, মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হার থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত এসেছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট থেকে ইতোমধ্যে বিশাল অংক কেটে রাখা হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১২৩ ভাগ বাড়িয়েছিলেন বলে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস, পরীক্ষা, গবেষণা করতে পারছিলাম। কিছুটা হলেও সংসারে সচ্ছলতা এসেছিল। এখন যদি বাড়ি ভাড়া ৩৫ শতাংশ করা হয়, তাহলে ঢাকায় কীভাবে বাড়ি-ভাড়া দেব? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বউ-বাচ্চা নিয়ে ১৪/১৫ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকায় কোথায় একটা ভালো বাসায় থাকতে পারবে, এই খোঁজ দিতে পারবেন কেউ?

ইউজিসির পরিপত্রের ৮নং নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সকল শিক্ষকদের প্রদত্ত গবেষণা ভাতা, ইন্টারনেট ভাতা, মোবাইল ভাতা প্রদান বন্ধ করতে হবে। গবেষণা ভাতা হিসেবে আমরা মাসে ২/৩ হাজার টাকা এখন পাই, আগে আরও কম ছিল। এই গবেষণা ভাতাও বন্ধ করে দিবে সরকার? একদিকে বাড়ি ভাড়া কমিয়ে, ইন্টারনেট ভাতা, গবেষণা ভাতা বন্ধ করে দিয়ে সরকার কী ধরনের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে চাচ্ছে? পেটে ভাত না থাকলে, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাতে না পারলে একজন শিক্ষক কী করে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করবেন? কেউ কি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন প্লিজ?

১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমলাতন্ত্রের দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছিলেন, ‘যে সিস্টেম আজকে আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াল সিস্টেম। এতে দেশের মঙ্গল হতে দেখি না। এটাতে আমরা কনভিনসড। ব্রিটিশ সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করবার জন্য যে সিস্টেম দেশের এডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে চালু করে গিয়েছিল-সেই এডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন সব কিছু পরিবর্তন করবার নামই বিপ্লব।’

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :